রাজধানীতে বিদ্যমান ট্রাকগুলোকে শৃঙ্খলায় ফেরাতে তিনতলা বিশিষ্ট আধুনিক টার্মিনাল নির্মানের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল ২০১৫ সালে। কিন্তু এমন প্রতিশ্রুতির পর কেটে গেছে এক একে পাঁচটি বছর। তবুও টার্মিনাল নির্মাণ তো দূরের কথা, এখনও জায়গা-ই মেলেনি টার্মিনালের জন্য। ফলে দফায় দফায় উচ্ছেদ কার্যক্রম চালালেও থামছে না রাজধানীর তেজগাঁওয়ের আনিসুল হক সড়কে ট্রাকস্ট্যান্ডের দৌরাত্ম্য। সড়কটি এখনও ট্রাকের দখলে। এমন ট্রাকস্ট্যান্ডের কারণে সচল সড়কটি ক্রমেই সংকুচিত হয়ে পড়ায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। যার ফলে ওই অঞ্চলেও সৃষ্টি হচ্ছে চরম দুর্ভোগ।
তবে সড়ক দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড বানানোর বিষয়টি দৃষ্টিকটু এবং অন্যায় হলেও, আপাদত আর কোনো বিকল্প উপায় নেই বলে দাবি করেছেন ট্রাক মালিক-শ্রমিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা বলছেন, গত কয়েকবছর ধরে প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের আশায় ছিলেন তারা। যে কারণে রাজধানীর অদূরে কাঁচপুর এলাকা, টঙ্গি ও আমিনবাজারের মত এলাকাগুলোতে ট্রাক রাখা হতো। কিন্তু সেসব এলাকাতেও সমস্যা সৃষ্টি হওয়ায় নিরুপায় হয়ে এখন তেঁজগাওয়ের আনিসুল হক সড়কসহ আশপাশের অন্যান্য সড়কেও ট্রাকস্ট্যান্ড করা হচ্ছে। তাই যতদিন পর্যন্ত আধুনিক ট্রাক টার্মিনাল করা না হবে ততদিন এভাবেই চলবে বলে জানালেন তারা। যদিও সড়কে ট্রাকস্ট্যান্ডের কারণে ট্রাফিক পুলিশ প্রতিনিয়ত হয়রানিও করছে বলে অভিযোগ তাদের।
তবে ট্রাফিক পুলিশ বলছেন, ট্রাক কোথায় থাকবে সেটি দেখার দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশের নয়। বরং সড়কে চলাচলের প্রতিবন্ধকতা প্রতিরোধে প্রতিনিয়ত কাজ করাই ট্রাফিকের কাজ। তাই কেউ সড়ক দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড বানালে ট্রাফিক পুলিশ ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন তেঁজগাও ট্রাফিক বিভাগ।
জানা গেছে, ২০১৫ সালের ১০ ডিসেম্বর বিকেলে তেঁজগাও ট্রাকস্ট্যান্ড এলাকায় আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের উপস্থিতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক বলেছিলেন ট্রাক স্ট্যান্ডের জন্য আধুনিক টার্মিনাল বানিয়ে দেওয়া হবে। তৎকালীন রেলপথমন্ত্রী মুজিবল হক, নৌ পরিবহন মন্ত্রী শাহজাহান খান ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে আধুনিক ট্রার্মিনালের বিষয়ে আলাপের বরাত দিয়ে সেদিন আনিসুল হক এ প্রতিশ্রুতি দেন। তার এমন প্রতিশ্রুতিতে সেখানে অবৈধভাবে সড়কের ওপর যত্রতত্র পেলে রাখা ট্রাকগুলো সরিয়ে নেয় ট্রাক মালিকরা।
সেই সঙ্গে ওই সড়কের পাশে বাংলাদেশ রেলওয়ের অধীনে থাকা প্রায় ৩৯ বিঘা খালি জমিতে আধুনিক টার্মিনাল না হওয়া পর্যন্ত ট্রাকগুলো রাখার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর সে সড়কটি মেরামত করে চলাচলের উপযোগী করে জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে সড়কটির নামকরণ করা মেয়র আনিসুল হক সড়ক। এরপর থেকে মাঝে মাঝে ট্রাক মালিকরা সড়কটি দখলের চেষ্টা করলেও ডিএনসিসি অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করতো। কিন্তু এতে বিকল্প কোনো ব্যবস্থা না থাকায় কিছুদিন পর পর সড়কটি ফের দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড বানিয়ে ফেলা হচ্ছে।
আরও জানা গেছে, সম্প্রতি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর সড়ক থেকে ট্রাকস্ট্যান্ড স্থায়ীভাবে সরাতে ফের উদ্যোগ নেন আতিকুল ইসলাম। এ জন্য চলতি বছরের শুরুর দিকে তিনি একাধিকবার গণপূর্ত ও রেলওয়ে এবং রাজউকসহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এতেও এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী সমাধান মেলেনি বলে জানা গেছে।
সরেজমিনে তেঁজগাও শিল্পাঞ্চল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ওই এলাকার প্রতিটি সড়কে কিছু দূর পরপর ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষ করে মেয়র আনিসুল হক সড়কটির অবস্থা আরও নাজুক। সে সড়কে সারিবদ্ধভাবেই একটার পেছনে একটা ট্রাক রাখার কারণে যে কেউ ভাববে এটি ট্রাকস্ট্যান্ড। এই অবস্থা কারওয়ান বাজার পর্যন্ত আনিসুল হক সড়কে। একই অবস্থা কারওয়ান বাজার থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত বিএফডিসি সড়কটিও। সেখানেও অস্থায়ী ভাবে শতশত ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। তবে দিনের তুলনায় রাতে ট্রাকের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
আনিসুল হক সড়কে এক সারিতে ট্রাক রাখার পর আর জায়গা না থাকায় দ্বিতীয় সারি বানিয়ে রাস্তার উপরই ট্রাক রাখলেন চালক ও মালিক বাবুল উদ্দিন। এটি অনিয়ম কি না তার কাছে জানতে চাইলে বাবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনিয়ম তো অবশ্যই। কিন্তু আমাদের উপায় তো নাই। ট্রাক রাখমু কোথায়। যেখানেই যায় সেখানেআ ট্রাফিক পুলিশ মামলা দিতে চায়, জরিমানা করে। তাই এখানে রাখলে একটু নিরাপদ। এখানে পুলিশ কম আসে। যদিও কোনো একটা ট্রাক বের হলেই আমার টা ওই জায়গায় রাখমু। তাই এখন একটু কষ্ট হলেও রাস্তার ওপরে রাখছি।’
তিনি বলেন, ‘এভাবেই শতশত ট্রাক রাস্তায় রাখা হয়। কিছু করার নাই। কারণ আমাদেরকে টার্মিনাল বানিয়ে দেওয়ার কথা বলছে। কিন্তু সেটা এখনও করে নাই।’
এমন স্পষ্ট উত্তর শুধু বাবুলের কাছে নয়, সেখানে অবৈধভাবে ট্রাকস্ট্যান্ড করা প্রতিটি চালকের কাছেই এমন জবাব। এমনকি তারা ক্ষোভ প্রকাশ করেই বলছেন, ট্রাক রাখার জায়গা না থাকলে কোথায় রাখবো? বাড়ির ছাদে?
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ট্রাক ও কভার্ডভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. আবুল কাসেম সারাবাংলাকে বলেন, ‘৫ বছর আগে ৪ মন্ত্রী আমাদেরকে আশ্বাস দিয়েছিলেন আধুনিক টার্মিনাল করে দেওয়া হবে। তাতে তিনতলা বিশিষ্ট হবে। যাতে করে ১৫ থেকে ২০ হাজার ট্রাক ধারণ ক্ষমতা থাকতে পারে। কিন্তু আজও সে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘এখন প্রতিদিন প্রায় ৬-১০ হাজার ট্রাক ঢাকায় আসে এবং বের হয়। তো এসব ট্রাক তো রাস্তায় রাখা যাবে না। তাই এগুলোর কিছু কাঁচপুর ব্রিজ এলাকায়, কিছু টঙ্গী এলাকায় আবার কিছু আমিনবাজারের দিকে রাখা হয়। বাকিগুলো এখানে আসে। কিন্তু এখানেও তো জায়গা হচ্ছে না। তো জায়গাই যখন নেই তখন ট্রাকগুলো কোথায় যাবে? ট্রাকের তো প্রয়োজন রয়েছে। পর্যন্ত ট্রাক না থাকলে তো অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে। তাই যতদিন না বিকল্প ব্যবস্থা করা না হবে ততদিন রাস্তায় ট্রাক রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবুও আমরা সব সময় চেষ্টা করি রাস্তায় না রেখে ভেতরে রাখতে। কারণ রাস্তায় রেখেও শান্তি নেই। সেখানে রাখলে ট্রাফিক পুলিশ হয়রানি করে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা অতিসত্বর চাই আধুনিক টার্মিনালটি হয়ে যাক। এভাবে আজ এ রাস্তায়, কাল অন্য রাস্তায় থাকতে আর ভালো লাগে না।’
আধুনিক টার্মিনাল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি কতদূর? জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. সেলিম রেজা সারাবাংলাকে বলেন, ‘অগ্রগতি কতদূর তা বলা এ মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে যতদ্রুত সম্ভব আধুনিক টার্মিনাল তৈরিতে চেষ্টা চালাচ্ছেন আমাদের মেয়র। তিনি এ জন্য জায়গা খুঁজছেন। জায়গা পেলেই কাজ শুরু হবে। তবে বর্তমানে রেলওয়ের যে জায়গায় অস্থায়ীভাবে ট্রাক রাখা হয় সে জায়গায় বড় প্রকল্পের প্ল্যান রয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের। তাই আমাদেরকে এখন বিকল্প জায়গা খুঁজতে হচ্ছে। তবে কয়েকটি জায়গার সম্ভাব্যতা যাছাই চলছে। আশা করছি খুব শীঘ্রই সমাধান হবে।’
তবে সড়কে ট্রাক স্ট্যান্ড রাখতে দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন শাহেদ আল মাসুদ। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিনিয়ত আমাদের সদস্যরা সড়কে ট্রাক যেন না রাখতে পারে সেজন্য কাজ করছে। কাল আবারও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘ট্রাক কোনোভাবেই রাস্তায় রাখতে দেওয়া হবে না। এ জন্য আমরা কাজ করছি।’
সারাবাংলা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন