বিমানবন্দর সড়ক মানেই যন্ত্রণা। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এ সড়কে যানজটে অতিষ্ঠ মানুষ। সব ধরণের পরিবহন যানের বিশৃঙ্খলা যেন এই সড়কের বিমানবন্দর গোলচত্বরকে কেন্দ্র করেই। বিমানের যাত্রী ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ এ সড়ক ব্যবহার করে উত্তর ও দক্ষিণের কমপক্ষে ২৬ জেলার যাত্রীবাহী বাস। সে কারণে অব্যস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা জটিল আকার ধারণ করতে সময় লাগে না। অথচ সেদিকে ট্রাফিক পুলিশের এতটুকু নজর নেই।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বড় বড় কংক্রিটের স্ল্যাব ফেলে রাখা হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গোল চত্বরে। এসবের ফাঁকফোকর দিয়ে চলছে গাড়ি। ফেলে রাখা স্ল্যাবগুলো বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের। গাজীপুর-বিমানবন্দরের মধ্যে বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন হচ্ছে এ প্রকল্পের মাধ্যমে। একই সঙ্গে গোলচত্বরের দক্ষিণে বিমানবন্দর-কুড়িল মহাসড়কে নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। পুরোদমে চলছে উড়ালসড়কটির নির্মাণকাজ। শুধু বিআরটি বা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নয়, বিমানবন্দর গোলচত্বর ঘিরে আরো চারটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ছয় মেগা প্রকল্পের মধ্যে দুটির কাজ চলমান। এর মধ্যে মেট্রো রেললাইন-১ আর ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ খুব শিগগিরি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। বিমানবন্দর গোলচত্বরে আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য আহবান করা হয়েছে দরপত্র। অন্যদিকে পরিকল্পনাধীন অবস্থায় রয়েছে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনকে ঘিরে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব নির্মাণ। বিষেজ্ঞদের মতে, উন্নত দেশের মতো বিমানবন্দরকেন্দ্রীক উন্নয়নটা জরুরী। কিন্তু উন্নয়নের ধকলে মানুষের ভোগান্তি যাতে না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। আবার উন্নয়নের নামে বছরের পর বছর কাজ চলতেই থাকলে একটার পর একটা জেনারেশন ভোগান্তি নিয়েই জীবন পার করতে থাকবে। সেটা যেন না হয় সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রফেসর ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ঢাকা শহরের মধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ‘ডিমান্ড মডেল’ তৈরি করা হয়নি। এটা থাকলে বিমানবন্দর গোলচত্বরে এতগুলো প্রকল্পের যৌক্তিকতার বিষয়টি সহজেই যাচাই করা যেত। তিনি বলেন, বিমানবন্দর মোড় ঘিরে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, সেগুলোর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা ও প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের কাজ করা হয়েছে আলাদাভাবে। এক চত্বরে যেহেতু অনেকগুলো প্রকল্প হচ্ছে, সেহেতু সব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের কাজটি সমন্বিতভাবে করা উচিত ছিল। সেটি না হওয়ায় সব প্রকল্প চালু হলে জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ কারণে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সমন্বিতভাবে করার ওপর জোর দেয়া উচিত।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বিমানবন্দর গোলচত্বর ঘিরে বর্তমানে দুটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এর একটি বিআরটি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিমানবন্দর-গাজীপুর অংশে এ প্রকল্পের মাধ্যমে বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন গড়ে তোলা হচ্ছে। ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকার এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাসের জন্য এ বিশেষায়িত লেনটিতে কেবল সরকারি কোম্পানির নির্দিষ্টসংখ্যক বাস চলাচল করবে। এতে গাজীপুর থেকে বিপুলসংখ্যক যাত্রী সহজে ও কম খরচে দ্রুত বিমানবন্দর পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারবে। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। যদিও ধীরগতির নির্মাণকাজের কারণে বাস্তবায়নে আরো বেশি সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ প্রকল্পের কাজের অংশ হিসেবেই বড় বড় কংক্রিটের স্ল্যাব ফেলে রাখা হয়েছে সড়কের উপরে। এতে করে সরু হয়ে গেছে সড়ক। কোনোমতে অলিগলি দিয়ে চলছে গাড়ি। এই সরু সড়কের মধ্যে বিমানবন্দর স্টেশনের কাছে সড়কের দুপাশেই দাঁড়াচ্ছে বাস। যাত্রী ওঠানামা করানো হচ্ছে চালক হেলপারের ইচ্ছেমতো। এতে করে ব্যস্ত সময়ে বাসের সারি হচ্ছে দীর্ঘ। পেছনের গাড়ি তখন আটকে থাকছে সামনে এগুতে না পারায়। আবার একটার পর একটা বাস ছাড়া এবং দাঁড়ানোর জন্যও যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। এই যানজটের দৈর্ঘ্য কখনও কখনও ৪/৫ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব একদিকে উত্তরা হয়ে টঙ্গী-আশুলিয়া এবং অন্যদিকে খিলক্ষেত হয়ে বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-ফার্মগেইট পর্যন্ত পড়ছে। এক পর্যায়ে পুরো রাজধানী আটকে থাকছে যানজটে।
এদিকে, প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হযরত শাহজালাল (রহ.) বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। প্রায় ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়েটি শুরু হয়েছে বিমানবন্দর গোলচত্বরের দক্ষিণ পাশ থেকে। এ প্রকল্পের কাজও ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা। আবার বিমানবন্দর গোলচত্বরের উত্তর পাশ থেকে শুরু হবে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ও ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত করে দেয়া হবে। আর দুই এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগস্থল হবে বিমানবন্দর গোলচত্বর। আগামী মাসেই এর কাজ শুরু করার কথা বলে জানিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। গোলচত্বর সংলগ্ন বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো রেল নির্মাণ করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা খরচ হবে এ প্রকল্পে। মাটির নিচ দিয়ে বিমানবন্দর গোলচত্বর অতিক্রম করবে এ প্রকল্প। এদিকে, বিদ্যমান রেলওয়ে স্টেশনটি বিমানবন্দর গোলচত্বরের ১০০ মিটার সীমার মধ্যেই। স্টেশনটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটিকে গড়ে তোলা হবে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব হিসেবে। এর মাধ্যমে স্টেশন থেকেই একসঙ্গে অনেক ধরনের যানবাহন সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। পাশাপাশি স্টেশনটিতে নানা বাণিজ্যিক কার্যক্রমও পরিচালনা করবে রেলওয়ে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রাথমিক কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে জাপানি প্রতিষ্ঠান কাজিমা করপোরেশন। এ ছাড়া বিমানবন্দর গোলচত্বরের নিচে নির্মাণ করা হবে ৬২০ মিটার দীর্ঘ আন্ডারপাস। এটি হাজি ক্যাম্পের সম্মুখভাগ, বিমানবন্দর রেলস্টেশন, বিআরটি স্টেশন, এমআরটি (মেট্রো রেল)-১ স্টেশন ও বিমানবন্দর টার্মিনাল ১ ও ২-এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে। এটি নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২১ কোটি টাকা। গ্রেটার ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, যেটির মাধ্যমে বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই প্রকল্পের মাধ্যমেই বানানো হবে এ আন্ডারপাস। এরই মধ্যে আন্ডারপাসটি নির্মাণে দরপত্রও আহবান করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। শিগগির কাজ শুরু করার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।
এত বড় বড় কর্মযজ্ঞ যেখানে সেখানে বিশৃঙ্খলা বা অব্যবস্থাপনা হাজার হাজার মানুষকে দুর্ভোগে ফেলবে এটা স্বাভাবিক। এ প্রসঙ্গে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান ইনকিলাবকে বলেন, বিমানবন্দরে ইন্টারকানেক্টিভিটি সিস্টেম থাকা জরুরী। মানুষ বিমানে করে এসে যাতে বাস বা ট্রেনে খুব দ্রুত তার গন্তব্যে যেতে পারেন সে ব্যবস্থা থাকা উচিত। আমাদের বিমানবন্দরে সেটাই হচ্ছে, এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। তবে এতগুলো প্রকল্প একসাথে করা যাবে কি না বা কোনটার পর কোনটা করলে ভাল হবে সেটা অবশ্যই ভাবতে হবে। আবু নাসের বলেন, বিমানবন্দরের মতো ব্যস্ত সড়কে এবং গোলচত্বরে বিআরটি প্রকল্পের বড় বড় কংক্রিটের স্ল্যাব বহুদিন ধরেই রাখা হয়েছে। এগুলো এভাবে সড়কের উপর না রেখে বিকল্প কোথাও রেখে প্রয়োজনের সময় একটা দুটা করে আনা যেতো। তাতে যানবাহন চলাচলে বাধার সৃষ্টি হতো না। তিনি বলেন, ব্যস্ত এলাকার সড়কের উপর বাস দাঁড় করানোর কারণে যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে। যাত্রী, পথচারি সবাই দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। বাসগুলো যাতে এই মেগা প্রকল্প এলাকায় না দাঁড়াতে পারে সেজন্য ট্রাফিক পুলিশকে ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে ব্যস্ত ওই এলাকার জন্য বেশি সংখ্যক ট্রাফিক পুলিশ নিয়োগ করে ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। তা না হলে বছরের পর বছর ধরে একটার পর একটা প্রকল্পের ধকলে মানুষ কষ্ট পেতেই থাকবে। যেটা আমাদের কারও কাম্য নয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন