অ্যাপে ফাঁদ পেতে চীনা দুই নাগরিকসহ একটি চক্র গত দুই বছরে প্রায় ২০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব টাকা চীনে পাচার হয়েছে বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
এই চক্রের প্রধান ঝ্যাং জি ঝাহ্যাং (৬০) নামে এক চীনা নাগরিক। তার কাছে থাকা বিভিন্ন সিমে ২৯টি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের তথ্য পেয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিবি) সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ-দক্ষিণ। তার সহযোগী ছিলেন অপর চীনা নাগরিক পিঙ্ক (৪৫)। রাজধানীর হাতিরঝিল ও কাফরুল থানায় হওয়া মামলার তদন্তে নেমে ওই টাকা পাচারের ভয়াবহ তথ্য পায় ডিবি। ২৪ নভেম্বর চক্রটির ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সাইবার ও স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (এডিসি) সাইফুর রহমান আজাদ গতকাল এ প্রতিবেদককে জানান, এ চক্রটির হোতা দুই চীনা নাগরিক। তারা বর্তমানে জামিনে আছেন। বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশে চীনের অন্তত ১২-১৫ হাজার নাগরিক অবস্থান করছেন। তবে এক মাসের অন অ্যারাইভাল ভিসায় আসা চীনা নাগরিকরা বিভিন্ন প্রলোভনে ফেলে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এসব থামাতে চীনা দূতাবাস সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে। ডিবির তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, গত বছরের ছয় মাসে ২৯টি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে ৫০ কোটি টাকারও বেশি পাচার করা হয়েছে। সে হিসেবে দুই বছরে অন্তত ২০০ কোটি টাকা দেশ থেকে পাচার করা হয়েছে। দেশে এখন পর্যন্ত এই চক্রের হাতে অন্তত দেড় হাজার মানুষ প্রতারিত হয়েছে। অ্যাপটি চীনা নাগরিকদের তৈরি। এটির সার্ভার সিঙ্গাপুরে। আর কলসেন্টার বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। পাকিস্তানি নম্বর দিয়ে বাংলাদেশিদের কল করা হয়। আর বাংলাদেশি নম্বর ব্যবহার করে ভারতীয়দের কল করা হতো। ডিবি জানায়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে সহজে ফোন দেওয়ার নামে ফাঁদে পা দিয়ে কেউ চীনা অ্যাপ ডাউনলোড করলেই বিপদে পড়তেন। অ্যাপ ডাউনলোড করার পরেই মোবাইলের ছবি, ভিডিও, কন্ট্রাক্ট লিস্টসহ গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য চক্রের হাতে চলে যায়। এরপর চক্রের সদস্যরা সেগুলো ব্যবহার করে লোন নেওয়া ভুক্তভোগীকে এসব ছবি-ভিডিও ব্যবহার করে ব্ল্যাকমেইল করে। প্রথমে সরাসরি ভুক্তভোগীকে নানাভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করে। তাকে না পেলে বাবা-মাসহ পরিবার, আত্মীয়-স্বজন ও পরিচিতজনদের নম্বরে আপত্তিকর বিভিন্ন ছবি তৈরি করে পাঠাত। একইভাবে মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে ঘরে বসে দিনে ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা আয়ের নানা প্রলোভন দেখাত। এমন এসএমএস পাঠিয়ে বিভিন্নজনকে প্রলোভন দেখানো হতো। আর এই প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়ে নিঃস্ব হন ভুক্তভোগীরা। আর পার্শ্ববর্তী দেশে এসব অ্যাপস থেকে ঋণ নিয়ে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়ে ৬০ জনেরও বেশি আত্মহত্যা করেছেন। জানা গেছে, গত ১৮ নভেম্বর চীনা অ্যাপের ফাঁদে প্রতারিত হয়ে রাজধানীর হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেন হাবিব রাজু নামে এক ব্যবসায়ী। ফেসবুকে একটি লিংক হাবিবের নজরে আসে। লিংকের শিরোনাম ছিল ‘দ্রুত লোন নিন’। হাবিব লিংকে চাপ দিতেই তার মোবাইলফোন বন্ধ হয়ে যায়। আর চালু হয় প্রায় ১০ মিনিট পর। এরও প্রায় ১ ঘণ্টা পর তার মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টের (এমএসএফ) নম্বরে ২৩ হাজার ৪০০ টাকা জমা হয়। পরে একটি বিদেশি নম্বর থেকে তাকে ফোন করে বলা হয়- ঋণের আবেদন করায় তাকে ওই টাকা দেওয়া হয়েছে। এক সপ্তাহ পর সুদসহ ৩৯ হাজার ১৫০ টাকা পরিশোধ করতে হবে। গত বছরের মে মাসে এভাবেই অ্যাপের মাধ্যমে প্রতারকদের খপ্পরে পড়েন হাবিব। টাকা ফেরত দিতে চাইলেও তা না নিয়ে নানাভাবে ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করে চক্রটি। পরে তারা ইচ্ছামতো টাকা চাওয়া শুরু করে। টাকা দিতে না চাইলে তারা তার মোবাইলফোনে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর ও ছবি, আত্মীয়স্বজন এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দেয়। পরে ভুক্তভোগীরা বাধ্য হয় টাকা পরিশোধ করতে। এর আগে একইভাবে টাকা হাতিয়ে নিয়ে পাচারের অভিযোগে গত বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীর চকবাজার থানায় করা একটি মামলার তদন্তে নেমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এক চীনা নাগরিকসহ ১২ জনকে শনাক্ত করে। এর মধ্যে ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন