রাজধানীর বাজারে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না বোতলজাত সয়াবিন তেল। প্রায় উধাও হয়ে গেছে। আর পাওয়া গেলেও শর্তসহ বেশি দাম রাখা হচ্ছে। বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এক থেকে দুই লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই বললেই চলে। এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। এ ছাড়া সামনে রমজান মাসকে কেন্দ্র করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কৃত্রিম সংকট তৈরি করছে বলে একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। রাজধানীর কাওরান বাজার সহ বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে এ তথ্য জানা গেছে।
ক্রেতারা অভিযোগ করছেন, আসন্ন রমজান মাসকে সামনে রেখে সয়াবিন তেলের দাম বৃদ্ধির পাঁয়তারা করছেন ব্যবসায়ীরা। ফলে তেল নিয়ে সরকারের আমদানি শুল্কছাড় কোনো কাজেই আসছে না ব্যবসায়ীদের কারসাজির কারণে। এতে প্রতিদিনই ভোজ্য তেলের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে উঠছে। সরকার ভোজ্যতেল আমদানিতে মূল্য সংযোজন কর ১০ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে করে বাজারে তেলের সরবরাহ স্বাভাবিক ও দাম কমার কথা থাকলেও সেই চিত্র কোথাও নেই। অন্যদিকে বিক্রেতাদের দাবি, ডিলারদের কাছে অর্ডার দিয়ে চাহিদার অর্ধেকও পাওয়া যাচ্ছে না। সরকার শুল্ক-কর কমালেও চাহিদা অনুযায়ী সয়াবিন তেলের আমদানি বাড়েনি।
খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, গত এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে ভোজ্যতেল পরিশোধন কোম্পানিগুলো বোতলজাত সয়াবিন তেল সরবরাহ করছে না। এর মধ্যে দুই-একটি কোম্পানি করলেও তা চাহিদার তুলনায় খুবই কম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বাজারে সরবরাহ কমিয়ে বোতলজাত সয়াবিন তেলের কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হচ্ছে। আগামী রমজানকে সামনে রেখে কোম্পানিগুলো সয়াবিন তেলের দাম বাড়ানোর জন্য এটা করছে বলে তারা অভিযোগ করেছেন।
কাওরান বাজারের রামগঞ্জ জেনারেল স্টোরের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন বলেন, গত এক সপ্তাহ ধরে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ নেই। কোম্পানিগুলো তেল সরবরাহ করছে না।
ভোজ্যতেল প্রক্রিয়াজাতকারী করপোরেট কোম্পানিগুলো খুচরা বিক্রেতাদের সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কম চাহিদাসম্পন্ন পণ্য নিতে বাধ্য করছে। অর্থাৎ কোনো কোম্পানির ভোজ্যতেল ছাড়াও যদি আটা, ময়দা, সুজি বা চিনি থাকে, তাহলে সংশ্লিষ্ট দোকানদারদের এর মধ্যে কম চাহিদাসম্পন্ন পণ্যটি কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।
কাওরান বাজারের ইউসুফ স্টোরের স্বত্বাধিকারী ইউসুফ দেশ জানান, শর্ত দিয়ে তেল বিক্রি করতে গেলে কাস্টমারের সঙ্গে আমাদের বাগ্মিতায় জড়াতে হয়। এতে করে ব্যবসায়িক পরিবেশ নষ্ট হয়। তবে শর্তপূরণ না করলে কোম্পানিগুলো আমাদের তেল দিচ্ছে না। এতে বাজারে এক ধরনের সংকট তৈরি হয়েছে।
রাজধানীর পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের পাইকারি তেল বিক্রেতা ও আমদানিকারকদের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, পাইকারি বাজারে তেলের কোনো সংকট নেই। বড় বড় গ্রুপের মিল মালিকরা ঠিকমতো তেল সরবরাহ দিচ্ছেন না। সময়মতো তেলের সরবরাহ না থাকাই সংকটের প্রধান কারণ। তারা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখীর অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছেন মিল মালিকরা। গত চার মাস হলো মেঘনা ও সিটি গ্রুপ ঠিকমতো সয়াবিন তেলের সরবরাহ করছে না। ৫ই আগস্টের আগে সিটি ও মেঘনা গ্রুপের যে পাম্প ওয়েল চার হাজার ৭৫০ টাকা প্রতি মণ কেনা হতো। বর্তমানে তা কিনতে হচ্ছে ছয় হাজার ২৭০ থেকে ছয় হাজার ৩০০ টাকায়। তাদের মতে, এস আলম গ্রুপ বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কায় অনেকেই তেল সরবরাহ করেননি। ফলে তেলের দাম বেড়ে যায়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী এ কৃত্রিম সংকট তৈরি করেছে।
সয়াবিন তেলের আমদানিকারক ও কমিশন এজেন্ট শ্যামল সাহা বলেন, হোলসেল মার্কেটে তেলের কোনো সংকট নেই। যা সংকট রয়েছে সেগুলো মিল মালিকদের কারসাজি। আমাদের কোনো সিন্ডিকেট নেই বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ গোলাম মাওলা মানবজমিনকে বলেন, খোলা বাজারে তেলের সরবরাহ রয়েছে। কিন্তু মিল মালিকরা নানা অজুহাতে দাম বাড়াচ্ছেন। ফলে আমরা যেভাবে মিল থেকে কিনতেছি, সেভাবেই বিক্রি করছি। অতিরিক্ত দাম রাখলে দোকানে সেটা ভোক্তা অধিকার দেখবেন বলেও জানান তিনি।
আমদানিকারকরা বলেছেন, বর্তমানে বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম বাড়তি। এ অবস্থায় তারা ভোজ্য তেলের দর সমন্বয়ের দাবি জানিয়েছেন।
টিকে গ্রুপের ডিলার মেসার্স শফিক ব্রাদার্সের স্বত্বাধিকারী শফিকুজ্জামান লিটন বলেছেন, বর্তমানে কোম্পানি চাহিদামতো তেল দিতে পারছে না। আগে দুই ট্রাক মাল আসলে, এখন আসছে এক ট্রাক। ফলে, আমরা ঠিকমতো সরবরাহ করতে পারছি না। এখানে আমাদের ভুল বুঝে লাভ নেই।
জানা গেছে, চলতি সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, আগামী মার্চে পবিত্র রমজান শুরু হবে। সেজন্য চাহিদা অনুযায়ী ভোজ্যতেল আমদানির জন্য এখনই প্রয়োজনীয় ঋণপত্র (এলসি) খুলতে হবে। না হলে ভোজ্য তেলের বাজারে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে।
বাজারে সয়াবিন তেলের সংকট সম্পর্কে জানতে চাইলে সিটি গ্রুপের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন তেলের দাম বেড়েছে। সরকার ১০ শতাংশ শুল্ক কমালেও উৎপাদন ব্যয় বেশি। তিনি বলেন, গত ৫ ডিসেম্বর ট্যারিফ কমিশনকে আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে সয়াবিন তেলের দাম বাড়াতে।
ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি এফ এম নাজির হোসেইন বলেছেন, বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির অজুহাতে এখন দেশে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানে বাজারে যে তেল বিক্রি হচ্ছে তা আগে আমদানি করা। তিনি বলেন, ভোক্তাদের জিম্মি করে ভোজ্য তেলের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করা হচ্ছে।
দেশের বাজারে ভোজ্য তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে দুই দফায় আমদানি শুল্ককর কমিয়েছে সরকার। প্রথম দফায় ১৭ই অক্টোবর ও দ্বিতীয় দফায় ১৯শে নভেম্বর শুল্ককর কমিয়ে তা ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। এতে প্রতি কেজি অপরিশোধিত সয়াবিন ও পাম তেলে শুল্ককর কমেছে ১০ থেকে ১১ টাকা। কিন্তু বাজারে এর ইতিবাচক কোনো প্রভাব পড়েনি। শুল্ককর কমানোর ফলে ভোজ্য তেলের আমদানি বাড়ার কথা, উল্টো আমদানি আরও কমেছে।
কাওরান বাজারে এক লিটারের বোতলজাত সয়াবিন কিনতে যান আমিনুল ইসলাম। কিন্তু কয়েক দোকান ঘুরেও তিনি পাননি। পরে বাধ্য হয়ে খোলা সয়াবিন তেল কিনে বাড়ি ফিরেছেন।
কেনাকাটা করতে আসা গৃহিণী কাকলী বেগম বলেন, আমি বাধ্য হয়ে পাঁচ লিটার তেলের বোতল নিচ্ছি। সব সময় দুই লিটারের বোতল নিতাম। দোকানদার বলছে আরও কিছু নেয়ার জন্য। তেলের মূল্য লেখা ৮১৮ টাকা, আর আমার কাছ থেকে ৮৫০ টাকা নিয়েছে। সরকারকে বলব, দ্রুত নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসুন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন