ইন্ডিয়ামার্ট নামের ই-কমার্স সাইটে গতকাল সোমবার কলকাতায় সাদা চিনির ৫০ কেজির বস্তার দাম ছিল ২ হাজার ২০০ রুপি। সেই হিসাবে প্রতি কেজি চিনির দাম ৪৪ রুপি। রুপির বিনিময় হার অনুযায়ী যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬২ টাকা। একই দিন বাংলাদেশের চালডাল ই-কমার্স সাইটে চিনির দাম প্রতি কেজি ১৩২ টাকা। চোরাচালানের মাধ্যমে ভারতের সীমান্ত পেরুলেই চিনির দাম প্রায় দ্বিগুন হয়ে যায়। এতে সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত এলাকার বেশির ভাগ চোরাকারবারি চিনি চোরাচালানে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে। অল্প সময়ে চিনি চোরাচালান করে সীমান্ত এলাকার অনেকেই কোটিপতি হয়ে যাচ্ছে। এই লোভ পেয়ে বসেছে সীমান্ত এলাকার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের এক শ্রেণির নেতাকর্মীকেও। তারাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চিনি চোরাচালানে হাত পাকাচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, গত এক বছরে ৬ হাজার কোটি টাকার চিনি চোরাচালান হয়েছে।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলা রয়েছে ৩০টি। এই সীমান্তের বড় অংশ দিয়েই এখন অবৈধভাবে সবচেয়ে বেশি আসছে চিনি। অধিক মুনাফার জন্য বৈধ চিনির আড়তদাররাও এখন এসব অবৈধ চিনি বিক্রি করছেন বাজারে। অন্যদিকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সীমান্ত দিয়ে চিনি পাচার থেকে বিক্রি পর্যন্ত প্রশাসন সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ভাগে বনিবনা না হলে কালেভদ্রে কিছু ভারতীয় অবৈধ চিনি ধরা পড়ছে। আবার আটক চিনি নিলামে
চোরাকারবারিদের সিন্ডিকেটই কিনে নিচ্ছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ২০ থেকে ২২ লাখ টন, যার প্রায় বড় অংশই আমদানি করা হয়। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারি (তিন মাসে) মাসে দেশে চিনি আমদানি হয়েছিল ৩ লাখ ৮৮ হাজার টন। সেখানে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে আমদানি হয়েছে ২ লাখ ৩৬ হাজার টন। সেই হিসাবে, এক বছরের ব্যবধানে মাত্র তিন মাসে দেড় লক্ষাধিক টন চিনি কম আমদানি হয়েছে। আর আমদানির এই ঘাটতি পূরণ করা হয়েছে অবৈধ পথে আনা চিনির মাধ্যমে। এ অবস্থায় চোরাচালান বন্ধের দাবি জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছে বাংলাদেশ চিনি আমদানিকারক অ্যাসোসিয়েশন।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি-এপ্রিল) আমদানি করা চিনি থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ২ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। সেখানে চলতি বছরের প্রথম চার মাসে রাজস্ব আদায় হয়েছে ১ হাজার ৮০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ, রাজস্ব আদায় কমেছে ২৪৬ কোটি টাকা। মূলত বৈধ পথে আমদানি কমে যাওয়ায় এই রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে গত শনিবার একজন চিনি চোরাকারবারির সঙ্গে কথা হয় আমাদের সময়ের সঙ্গে। তিনি বলেন, সীমান্তের ওপার থেকে তাদের চক্রের সদস্যরা চিনি কিনেন ৩৮ থেকে ৪০ রুপিতে। সীমান্তের দুই প্রান্তে ঘুষ, চাঁদা ও ভাড়ার দেওয়ার পর প্রতি কেজি চিনির দাম পড়ে ৮০ থেকে ৯০ টাকা। আমরা ১০০ টাকার কাছাকাছিতে আড়তদারদের এখন চিনি সরবরাহ করি। তিনি জানান, জব্দ চিনিও তাদের লোকজনই নিলামে কিনে নেয়।
উত্তরাঞ্চলের একজন চিনির আড়তদার আমাদের সময়কে বলেন, চোরাকারবারিরা তাদের বাকিতে চিনি দেন। ৫-১০ ট্রাক চিনি চোরাকারবারিরা তাদের পাঠিয়ে দেন। পুরো ব্যবসাই বিশ^াসের ওপর। এসব চোরাই চিনি তারা বিভিন্ন বেকারি, জুসের কারখানা ও মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করেন। বাজার দরের চেয়ে তারা প্রতি বস্তা চোরাই চিনি ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা কম দামে বিক্রি করেন। ফলে চাহিদাও বেশি। সবকিছু ম্যানেজ করেই তারা ব্যবসা করেন। তিনি বলেন, এখন টিকে থাকার জন্য অবৈধ চিনি বিক্রি ছাড়া কোনো উপায় নেই। না হলে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে।
আব্দুল মোনেম লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের নেতা মহিউদ্দিন মোনেম গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, অবৈধ পথে চিনি আসায় দেশ রাজস্ব হারাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হচ্ছে। সেই সঙ্গে দেশে যে চিনি শিল্প, সেটি ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গত জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত (পাঁচ মাস) তিন থেকে চার লাখ টন কম আমদানি হয়েছে র-সুগার। চোরাই পথে চিনি ঢোকার কারণে কেউ চিনি বিক্রি করতে পারছে না। তাই আমাদানি কমে গেছে।
কলকাতা ও বাংলাদেশের চিনির দামের তফাৎ প্রায় দ্বিগুন হওয়ার কারণ জানতে চাইলে মহিউদ্দিন মোনেম বলেন, আমরা র-সুগার আমদানি করছি ব্রাজিল থেকে। ব্রাজিলের চিনি আনার পর ৪২ থেকে ৪৪ টাকা প্রতি কেজিতে ডিউটি ইমপ্যাক্ট (শুল্ক) বসে। এরপর প্রক্রিয়াজাতকরণ খরচ, পরিবহন খরচসহ চিনির খরচই পড়ে প্রায় ১৩৫ টাকা। সেখানে বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে ১১৫ থেকে ১১৮ টাকায়। ভারত থেকে পাচার হয়ে আসা চিনির মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তিনি বলেন, এগুলো চিনি না কী কেমিক্যাল, তা পরীক্ষা করারও উপায় নেই। একদিকে সরকার রাজস্ব হারাচ্ছে, আবার অন্যদিকে স্বাস্থ্যও হুমকির মধ্যে পড়ছে। গত বছর ৬ থেকে ৭ লাখ টন চিনি অবৈধ পথে ঢুকেছে, যাতে সরকার ৫ থেকে ৭ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।
এদিকে, দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় চিনির চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগে সিলেটের বিয়ানিবাজারে ছাত্রলীগের দুটি কমিটি বাতিল, নেতাদের গ্রেপ্তার এবং যুবলীগ নেতার নাম এসেছে। কিশোরগঞ্জ জেলায় চিনি চোরাচালানের অভিযোগে এক ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদ বিষয়টি তদন্তে একটি কমিটি করেছে।
সীমান্ত এলাকার একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় প্রশাসন ও ক্ষমতাসীনদের ম্যানেজ করেই চোরাইপথে চিনি দেশে ঢুকছে। ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে চিনি ট্রাক ও পিকআপে করে আনতে ক্ষমতা প্রদর্শনের সঙ্গে ঘাটে ঘাটে টাকা বিলি করতে হয়।
সিলেট জেলার স্থানীয় প্রশাসন ও বাসিন্দারা বলছেন, সীমান্ত উপজেলা কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কানাইঘাট, জকিগঞ্জ ও বিয়ানীবাজার দিয়ে সড়কপথে চিনি ঢুকছে সিলেট নগরীতে। ভারতের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বস্তাপ্রতি চাঁদা দিতে হয়। সীমান্ত থেকে সিলেট নগরীতে আসতে ১০ টনের চিনি বোঝাই প্রতিটি ট্রাকের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর লাইনম্যানকে দিতে হয় ২৫ হাজার টাকা। আর দুই টনের পিকআপের জন্য ৫ হাজার টাকা। স্থানীয় নেতাদের জন্যও প্রায় সমপরিমাণ টাকা বরাদ্দ রাখতে হয়। জেলায় চলতি বছর চিনি চোরাচালানের ৬১টি মামলায় ১৩৬ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
জানা গেছে, সিলেট জেলা ও মহানগর ছাত্রলীগের নেতাদের চিনি চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে ২০২৩ সালের আগস্টে ফেইসবুকে পোস্ট দেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সদস্য ও সিলেট জেলা আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) প্রবাল চৌধুরী পূজন। এরপর ১১ অগাস্ট তার ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় প্রবাল চৌধুরী পূজন সিলেট জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকসহ ছাত্রলীগের ৫৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করলে ছাত্রলীগের চিনি চোরাচালানের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
সম্প্রতি প্রায় দেড় টন চিনি লুটের ঘটনায় ছাত্রলীগের দুই নেতার ফোনালাপ ফাঁস হলে আলোচনা-সমালোচনার মুখে গত ১৪ জুন বিয়ানীবাজার উপজেলা ও পৌর শাখা কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। ওই ঘটনায় চিনির মালিক বদরুল ইসলাম বিয়ানীবাজার থানায় ১১ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় আরো সাত থেকে আটজনকে আসামি করে মামলা করেন। ওই মামলায় উপজেলা ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল হক তাহমিদ ও পৌর ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক সভাপতি আশরাফুল আলম শাকেলসহ মোট চার আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ ছাড়া ৮০ বস্তা চিনি উদ্ধার ও একটি পিকআপ জব্দ করা হয়। এর আগে ৬ জুন পাচারের সময় নগরীর কোম্পানীগঞ্জ-জালালাবাদ সড়কের উমাইরগাঁও এলাকার থেকে ১৪ ট্রাক চোরাই চিনি জব্দ করে সিলেট মহানগর পুলিশ। এ ঘটনার পর উঠে আসে যুবলীগ নেতাদের নাম। গত ১৩ জুন রাতে চোরাই চিনি ছিনতাইকালে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করে নগর পুলিশ। একইদিন জকিগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জ এলাকায় চোরাই চিনি ছিনতাইয়ের অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগের ৯ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। ১৫ জুন জৈন্তাপুরে ৮৫৫ বস্তা ভারতীয় চোরাই চিনিসহ ১১টি পিকঅ্যাপ ও একটি মিনি ট্রাক আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন আমাদের সময়কে বলেন, সংগঠনের কেউ যদি নৈতিকতাবিরোধী কোনো কর্মকা-ে জড়িত হয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের জিরো টলারেন্স নীতি রয়েছে। যে কোনো অভিযোগ আসলে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। যে অভিযোগগুলো এসেছে, আমরা আমলে নিয়েছি। অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে গঠিত তদন্ত কমিটির কাজের অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা কয়েকটি কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করেছি। কিছু জায়গায় কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ছাড় পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন