রাজধানীর ধোলাইখালে ট্রাক স্ট্যান্ড সংলগ্ন পশুর হাটে আনুমানিক সাড়ে তিন মণ গোস্ত হবে— এমন একটি গরুর দাম দেড় লাখ টাকা হাঁকিয়েছে বিক্রেতা স্বপন আলী। তার ইচ্ছে অন্তত এক লাখ ৪০ হাজার টাকা হলে তিনি এই গরু বিক্রি করবেন। তার পাশে থাকা এক ভদ্রলোকের কারণে সেই সুযোগ আর হলো না। ভদ্রলোক উদ্দেশ করে বিক্রেতাকে বললেন, আরে কী দাম চাও। দাম এত বেশি কেন! পাশের ব্যবসায়ী তো আরও ভালো গরু কম দামে বিক্রি করছে। তাছাড়া তোমার গরু তো দেখতেও তেমন সুবিধার না। ভদ্রলোকের এসব কথা শোনার পর এক ক্রেতা আগ্রহ হারিয়ে পাশের গরু ব্যবসায়ীর কাছে চলে গেলেন।
ক্রেতা চলে যাওয়ার পর স্বপন আলী ভদ্রলোককে অকথ্য ভাষায় গালি দিলেন। গালিগালাজের কারণ জানতে চাইলে স্বপন আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চুয়াডাঙ্গা থেকে ৬টি গরু নিয়ে তিন দিন আগে এই হাটে এসেছি। এখন পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি করতে পারেনি। কারণ, আমি চাই যে, আমার গরু অন্য কারও সাহায্য ছাড়া নিজেই বিক্রি করবো। কিন্তু তা আর পারলাম না।
একটু আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ তুলে ধরে এই ব্যবসায়ী বলেন, একটু আগে যে লোক বললো, আমার গরু দেখতে সুবিধার না। পাশের ব্যবসায়ীর গরু দেখতে ভালো, উনি আসলে একজন দালাল। আমার কাছে এসে বললো— তোমার গরু বিক্রি করার ব্যবস্থা করে দেবো। পাঁচ হাজার টাকা দিতে হবে। আমি বললাম না, আমার গরু আমি নিজেই বিক্রি করবো। পরে এই দালাল পাশের ব্যবসায়ীর সঙ্গে চুক্তি করছে যে, গরু বিক্রি করে দিতে পারলে তাকে পাঁচ হাজার টাকা দেবে। তাই সেই ব্যবসায়ীর গরু ভালো বলে সুনাম করেছে।
পরে পাশের গরু ব্যবসায়ী ইদ্রিসের কাছ থেকে ১ লাখ ৪৫ হাজার টাকা দিয়ে আনুমানিক চার মণ ওজনের একটি গরু কিনছেন সেই ক্রেতা। গরু বিক্রি শেষে হাসিল দেওয়ার সময় কথা হয় ক্রেতা মাহফুজ আহমেদের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, গরুটি দেখতে সুন্দর। বিক্রেতা বলেছে যে, মাংস চার মণের বেশি হবে। আমার তো আসলে গরু কেনার অত আইডিয়া নেই। পাশে থাকা একটা লোক হেল্প করেছে। পাশে থাকা লোকের সঙ্গে কোন লেনদেন হয়েছে কিনা, প্রশ্নের জবাবে ক্রেতা মাহফুজ বলেন, আরে না না। আমি তো ওনাকে চিনি না। আর কীসের লেনদেন করবো।
গরু বিক্রি শেষে কথা হয় এই গরুটি মালিক-ব্যবসায়ী ইদ্রিসের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, গতবার এই হাটে ১০টা গরু এনেছিলাম। বিক্রি করেছি মাত্র দুটা। সব খরচ বাদ দিয়ে দেখি যে, আমার ২০-২৫ হাজার টাকার মতো লোকসান হয়েছে। এবার গরু এনেছি ৭টা। যেভাবেই হোক টার্গেট আছে— এবার সবগুলো গরু বিক্রি করে বাড়ি ফিরবো। এই গরু বিক্রির পেছনে দালাল জড়িত ছিল কিনা— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি অকপটে স্বীকার করে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ভাই দালাল ছাড়া গরু বিক্রি সম্ভব না। দালালদের দুই-তিন হাজার টাকা দিলেও সবকটি গরু বিক্রি করতে পারলে লাভ হবে। নয়তো গতবারের মতো আবারও গরুগুলো বাড়ি ফেরত নিয়ে লসের মুখে পড়তে হবে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ থেকে ৪টি গরু নিয়ে এসেছেন মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি গরুও বিক্রি করতে পারেননি। দালালদের দৌরাত্ম্যের কারণে অনেক গরুর দাম বাড়ে, আবার অনেক ব্যবসায়ীর মাথায় হাত পড়ে উল্লেখ করে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দূর থেকে দালালরা ইশারা দেয়, অথবা কাছে এসে হাতে টিপ দিয়ে, পায়ের ওপর পা দিয়ে চাপ দেয়, অথবা চোখের ইশারায় জানিয়ে দেয়— গরুর দাম বাড়িয়ে বলার জন্য। আবার অনেক দালাল আগে থেকেই গরু ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কন্টাক্ট করে রাখে। তারপর গরু যখন বিক্রি হয়, সেখান থেকে তাদের কিছু টাকা দিতে হয়। নয়তো পরে সিস্টেমে ক্রেতাকে অন্য গরু ব্যবসায়ীর কাছে পাঠিয়ে দেয়, যেখান থেকে সে টাকা খেয়েছে।
দালালদের কথা না শুনলে কোনও ক্ষতি হয় কিনা, জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম বলেন, এরা গরু বিক্রেতাদের আশেপাশে থাকে। এখন আমি গরুর ব্যাপারী, আমি যদি তারে মূল্যায়ন না করি, তাহলে ক্রেতাদের নানান কথা বলে প্রভাবিত করবে। তারপর কৌশলে অন্য গরু ব্যবসায়ীর কাছে নিয়ে যাবে। অনেক ক্রেতা আসলে গরু সম্পর্কে জানেই না। তারা হাটে আসে শুধু টাকা নিয়ে। আর দালালদের কথা শোনে— এই গরুর জাত ভালো, ওই গরুর এই হইছে সেই হইছে, ইত্যাদি নানান ধরনের প্রলোভন দেয় দালালরা। তারপর অনেক ক্রেতা তাদের কথায় পটে গিয়ে গরু কিনে নেয়। দালালরা বুঝতে পারে কে গরু দেখতে আসছে, আর কে গরু কিনতে আসছে। সেই অনুযায়ী দালালরা ব্যবসায়ীদের ইশারা-ইঙ্গিত দেয় দাম বাড়ানোর জন্য।
এদিকে প্রায় সবগুলো পশুর হাটেই ছোট ও মাঝারি আকারের গরুর দাম লাখ টাকা হাঁকাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। লাখ টাকা দাম চাওয়া আসলে কতটা যৌক্তিক, প্রশ্নের জবাবে বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানান যে, গত বছরের চেয়ে এবার গরু লালনপালনের খরচ বেড়েছে। হাটে তোলার খরচ মিলিয়ে ক্রেতাদের কাছে যে দাম চাওয়া হয়, তা মোটেও বেশি না।
রাজধানীর ধোলাইখালে কোরবানির পশুর হাট, ছবি: প্রতিবেদক
রাজধানীর ধোলাইখালে কোরবানির পশুর হাট, ছবি: প্রতিবেদক
পাটোয়ারী নামে একজন গরু ব্যবসায়ী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত ছয় মাস ধরে আমি ১২টি গরু লালনপালন করছি। প্রতি দিন ন্যূনতম চার হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে এদের পেছনে। তাহলে আপনি হিসাব করেন যে, আমার কত টাকা খরচ হয়েছে। আর এই ছয় মাসের পরিশ্রমের কি কোনও মূল্য নেই! চুয়াডাঙ্গা থেকে এই গরু গুলো ঢাকার এই বাজারে নিয়ে আসতে আমার প্রায় ৩০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। ঢাকার হাটে গরু আনার উদ্দেশ্যই একটু বেশি দামে বিক্রি করতে পারা। কিন্তু এখন তো আমরা বিক্রিই করতে পারছি না।
গরু বিক্রিতে দালালের ভূমিকা নিয়ে ব্যবসায়ীরা বলেন, আমরা যদি লাভে গরু বিক্রি করতে পারি, তাহলে দালালকে দুই-এক হাজার টাকা দিতে গায়ে লাগে না। কিন্তু যখন গরু বিক্রি না হয়, তখন উল্টো বিপদে পড়তে হয়। যারা অল্প গরু এনেছে, বা দুই- তিনটা গরু হাটে এনেছে, দালালের খপ্পরে পড়লে তাদের লোকসান গুনতে হয়। কিন্তু গরুর সংখ্যা যাদের বেশি এবং বিক্রিও যাদের হয় ভালো, তাদের কোনও সমস্যা হয় না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন