দুই বছর আগে ব্যাংকে টাকা রাখলে যে পরিমাণ সুদ পাওয়া যেতো, এখন তার চেয়ে তিন গুণ বেশি সুদ দিচ্ছে ব্যাংকগুলো। তবুও মানুষেরা ব্যাংকে টাকা রাখার বদলে নিজের কাছে রাখছেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত মার্চ মাসের শেষে ব্যাংক ব্যবস্থার বাইরে মানুষের হাতে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ১৯৫ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে এর পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা। এই হিসাবে ফেব্রুয়ারির তুলনায় মার্চে মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬২১ কোটি টাকা। যদিও ওই সময়ে ব্যাংকগুলো ১০ শতাংশের কাছাকাছি সুদে আমানত সংগ্রহ করেছে।
সাধারণত মানুষজন তার প্রয়োজনে ব্যাংক থেকে টাকা তোলে, আবার কোনও না কোনও ব্যাংক হিসাবেই (অ্যাকাউন্ট) জমা দেয়। কখনও কখনও কয়েক হাত ঘুরেও ব্যাংকে টাকা জমা হয়। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, গত মার্চ মাসে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার পর অন্তত ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকে ফেরত আসেনি। ধারণা করা হচ্ছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকে সঞ্চয় ভাঙাচ্ছেন। আবার সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে আতঙ্কিত হয়েও অনেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাম প্রকাশ না বলেন, সাধারণত টাকা বিভিন্ন হাত ঘুরে ব্যাংকে ফিরে আসে। সম্প্রতি একীভূত হওয়ার খবরে নির্দিষ্ট কয়েকটি ব্যাংক থেকে আতঙ্কিত হয়ে অনেকে টাকা তুলেছেন। এ ছাড়া উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণেও অনেকে সঞ্চয় ভাঙছেন।
ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, মার্চে বেশ কয়েকটি ব্যাংককে একীভূত করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বেসিক ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংক থেকে অনেকে আমানত তুলে নেন। এছাড়া গত মার্চ ছিল রোজার মাস। সাধারণত রোজার সময় টাকার চাহিদা বাড়ে। ফলে মানুষের হাতে নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে গেছে।
এতে করে ব্যাংকে কিছুটা তারল্য সংকটও দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো আমদানি দায় মেটাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনার কারণে টাকার একটি অংশ আটকে যাচ্ছে। অবশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে সহজ শর্তে তারল্য সহায়তা দিয়ে বাজার স্থিতিশীল রেখেছে।
এই পরিস্থিতিতে বেশকিছু ব্যাংক আমানত সংগ্রহে অসুস্থ প্রতিযোগিতা শুরু করেছে। বেশিরভাগ ব্যাংক এখন ১০ থেকে ১১ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহ করছে। ডজনখানেক ব্যাংক পাঁচ বছরে দ্বিগুণ টাকা দেওয়ার শর্তে আমানত গ্রহণ করছে। যেমন- এবি ব্যাংক সাড়ে ৫ বছরে দ্বিগুণ টাকা দিচ্ছে আমানতকারীদের। ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক ছয় বছরে টাকা দ্বিগুণ করার শর্তে আমানত সংগ্রহ করছে। প্রিমিয়ার ব্যাংক সাড়ে পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণ করার শর্তে আমানত নিচ্ছে। এনআরবি ব্যাংকও পাঁচ বছরে টাকা দ্বিগুণের শর্তে আমানত নিচ্ছে। মধুমতি ব্যাংক ছয় বছরে টাকা দ্বিগুণ হওয়ার ঘোষণা দিয়ে আমানত নিচ্ছে। বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংকও পাঁচ বছর তিন মাসে টাকা দ্বিগুণ করার শর্তে আমানত গ্রহণ করছে। যমুনা ব্যাংকসহ বেশ কয়েকটি ব্যাংকের আমানতের সুদহার ১০ দশমিক ৪০ শতাংশে উঠেছে। এর ফলে ঋণের সুদ হার ১৫ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে।
অথচ, দুই বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালে আমানতের সুদহার ৪ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছিল। ওই বছরের জুন মাসের শেষে আমানতের সুদহার কমে দাঁড়ায় ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশ। ওই এসময় ঋণের সুদহার ৭ দশমিক ০৯ শতাংশে নেমে এসেছিল। ওই বছরের মার্চ মাসে ঋণের গড় সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১১ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দুই বছরের ব্যবধানে আমানতের সঙ্গে ঋণের সুদহার দ্বিগুণেরও বেশি, অর্থাৎ ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। হঠাৎ সুদহার এত বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন গাড়ি-বাড়ির জন্য ঋণ নেওয়া গ্রাহকদের পাশাপাশি বড় ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তারা।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে ব্যাংক খাতে গত ডিসেম্বরের তুলনায় জানুয়ারিতে— অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে আমানত কমেছে ১৩ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বরে ব্যাংকগুলোতে আমানতের স্থিতি ছিল ১৭ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। জানুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ লাখ ৫৭ হাজার কোটি টাকা। আমানতকারীদের সঞ্চয়ী হিসাবে জমা অর্থের বিপরীতে অবণ্টিত সুদ ও মুনাফাসহ এ হিসাব করা হয়েছে। অবশ্য অবণ্টিত সুদ ও মুনাফা বাদ দিলে এক মাসে আমানত কমেছে ৯ হাজার কোটি টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত ডিসেম্বরে অনেক সঞ্চয়ী হিসাবের মেয়াদপূর্তি হয়েছে। এগুলোর একটি বড় অংশ গ্রাহকরা তুলে নিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান-বিআইডিএসের গবেষক ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মার্চ মাসে বেশি টাকা ব্যাংকের বাইরে থাকায় ব্যাংকিং খাতে সমস্যা হচ্ছে, ব্যাপারটা এমন নয়।’ তিনি বলেন, ‘টাকা ব্যাংকের বাইরে থাকলেও আমানত বৃদ্ধির হার বেড়েছে। সুতরাং, মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিচ্ছে এবং সেই টাকা আর ব্যাংকে ফেরত আসছে না, এমনটি মনে করা উচিত হবে না। তবে ইসলামি ধারার কিছু ব্যাংকের বিষয়ে আস্থায় চিড় ধরা ও ব্যাংক একীভূতকরণ সংক্রান্ত ঘোষণার পর কোনও কোনও ব্যাংক থেকে আমানতকারীরা বড় অঙ্কের আমানত তুলে নিলেও বাস্তবতা হলো, সেই টাকা অন্য ব্যাংকে জমা হয়েছে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন