কর্তৃত্ববাদী শাসকদের কারণে বিশ্বে গণতন্ত্র সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। বাংলাদেশ সহ অনেক স্থানে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে সব রকম প্রতিষ্ঠান। মানুষের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিতে যা যা করার দরকার, তা-ই করেছে দেশগুলোর সরকার। তাদের হাতে ক্ষমতা থাকার কারণে জনমত, ভোটারের তোয়াক্কা করেন নি। তারা নিজেদের আদেশ, নির্দেশকে আইন বানিয়ে ফেলেছেন এবং সে অনুযায়ী তার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। কিন্তু ২০২৪ সালে এসে টিকে থাকতে পারেননি তারা। অনেককেই বিদায় নিতে হয়েছে। শুধু বিদায় নয়। একেবারে অপরাধীর মতো কাউকে কিছু না বলে পালিয়ে যেতে হয়েছে। অহর্নিশ যারা জাবর কাটতেন জনগণের ভোটে ক্ষমতায় তারা, তারাই কিনা সেই জনতার দৌড়ানি খেয়ে পালিয়ে গেছেন। কখন গেছেন? যখন দেখেছেন তাদেরকে পাহারা দেয়া লোকজন হাওয়া। তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই। আগে তারা দম্ভ করলেও পরে তাদেরকে পালাতে হয়েছে। প্রশ্ন এসে যায়- এই যে যাদের ধাওয়া খেয়ে তারা পালালেন, তারা কারা? তারা আর কেউ নন। তারা অধিকারবঞ্চিত, নিপীড়িত, নির্যাতিত সেই দেশবাসী- যাদের কথা কোনোদিন এসব রাষ্ট্রনায়করা কানেই তোলেননি। তাদের কেউ কেউ দম্ভ করে বলেছেন- ভারত আছে, আমরা আছি অথবা ভারতকে আমরা যা দিয়েছি, তা ভারত চিরদিন মনে রাখবে। বাংলাদেশ, সিরিয়া সহ বেশ কিছু দেশে কর্তৃত্ববাদী সরকার কেড়ে নিয়েছিল ভোটারদের ভোটের অধিকার। স্বাধীনতা ছিল বিশেষ কিছু মানুষের। বিগত একটি বছরে বাংলাদেশ সহ অনেক কর্তৃত্ববাদী শাসক রাজনৈতিক অধিকারযোদ্ধাদের মুখোমুখি হয়েছে। কমপক্ষে আটটি স্বৈরশাসক পরিচালিত দেশ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াই চালিয়ে গেছে। এর মধ্যে আছে মালি, মিয়ানমার, চাদ, গায়েনা, সুদান, বুরকিনা ফাসো, নাইজার ও গ্যাবন। এরই মধ্যে বড় রকমের রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। সেই অধিকারযোদ্ধারা ক্ষমতাসীন সরকার ও তার দলকে বিশ্ব জুড়ে পরাজিত করেছেন নির্বাচনে, আন্দোলনে। অনেক দেশে, যেখানে ভোটাধিকার আছে, সেখানে ভোটের মাধ্যমে এমন সরকারকে এ বছর শাসন করেছেন ভোটাররা। এ বছর ৭ই জানুয়ারি বাংলাদেশে কার্যত একদলীয় নির্বাচন হয়। একদলীয় বলছি এ জন্য যে, ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে অন্য যেসব দল নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল- তারা কার্যত সরকারের অংশ। তারা ক্ষমতার হালুয়া-রুটির ভাগ পেয়েছে। এই নির্বাচনকে সুষ্ঠু বলে মেনে নেয়নি যুক্তরাষ্ট্র সহ পশ্চিমারা। তারপরও নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল নামমাত্র। তা আকস্মিকভাবে ‘ঘুমের’ মধ্যে স্বপ্ন দেখার মতো বাড়িয়ে দেখানো হয়। ইকোনমিস্ট, নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, ভারতীয় বিভিন্ন মিডিয়া সহ বিশ্ব মিডিয়া পতিত সরকারের প্রধান শেখ হাসিনাকে স্বৈরাচার বলে আখ্যায়িত করে একাধিক রিপোর্ট প্রকাশ করে। তিনি কমপক্ষে ১৫ বছরে মানুষের ভেতর যে ঘৃণার বীজ বপন করেছিলেন, তার বিস্ফোরণ ঘটে জুলাই-আগস্টে। সে ইতিহাস সবারই জানা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে এ বছর ৫ই আগস্ট পালিয়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হন শেখ হাসিনা। তিনি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। সেই সময়টুকুও পাননি। বুফেতে প্রস্তুত ছিল ১০/১২ রকমের খাবার। তা ছুঁয়েও দেখতে পারলেন না। স্বপ্নের ভেতর মানুষ যেমন প্রাণভয়ে পালাতে থাকে, ঠিক সেরকমভাবে তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলেন। এর মধ্যদিয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে নিজেকে যোজন-যোজন দূরে নিয়ে গেছেন। তার দলকে কার্যত গলা টিপে হত্যা করেছেন বলে বিদেশি মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী তো বলেই দিয়েছেন- শেখ হাসিনার আর রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন অসম্ভব। জনগণ তাকে চায়, তিনি জনগণের সেবক, তার কিছু চাওয়া-পাওয়ার নেই- কথায় কথায় তিনি এ কথা বলতেন। বলতেন, তিনি শুধু মানুষের সেবা করতে চান। জনগণও তাকে চায়। তাই তারা তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে। তাহলে কোন জনগণ ৪ঠা ও ৫ই আগস্ট রাস্তায় বানের পানির মতো মৃত্যুভয়কে উপেক্ষা করে নেমে এসেছিল? কেনই বা তাকে পালাতে হলো?
অনেকটা একই পরিণতি হয়েছে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের ক্ষেত্রেও। শেখ হাসিনার বিমান আকাশে উড়ার পর খবর রটে যায়, তিনি ভারতে যাচ্ছেন। কিন্তু বাশার আল আসাদ যখন পালিয়ে যান তখন ইথারে নানা গুঞ্জন। কেউ বলছিলেন তাকে হত্যা করা হয়েছে। কেউ বলেছেন তিনি রাশিয়া গেছেন। কেউ বলেছেন তাকে বহনকারী বিমান বিধ্বস্ত হয়েছে। প্রায় একদিন পরে জানা গেল তিনি রাশিয়ায় গেছেন। সেখানে তাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেন প্রায় আড়াই দশক ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে পালাতে হলো? তিনি কী বাংলাদেশকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন? এখানে লক্ষ্য রাখার বিষয়- এ বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের কারণে বদলে গেছে বিশ্ব রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক সহ সব রকম ব্যবস্থা। যুক্তরাষ্ট্রে ৫ই নভেম্বরের নির্বাচনে ডনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার ফলে কাঁপন লেগেছে যেমন ভারতে, তেমনি সিরিয়া, ইউক্রেন, ইরান সহ দুর্বল-সবল দেশগুলোতে। ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে যুদ্ধ দ্রুত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। ইউক্রেনকে সহায়তা কমিয়ে দেয়ার কথা বলেছেন। ফলে রাশিয়া বা চীনের কাছ থেকে বাশার আল আসাদ যে সহায়তা পেতেন, তা বন্ধের উপক্রম হয়। তিনি অসহায় হয়ে পড়েন। এমনি হয় স্বৈরশাসকদের পরিণতি। তারা কখনো জনগণের ম্যান্ডেটের ওপর ভরসা করে ক্ষমতায় থাকেন না। তাদেরকে ক্ষমতায় রাখা হয়। যারা রাখে, তারা যখন দেখে আর সম্ভব হচ্ছে না, তখন পাশ থেকে সপাৎ সরে যান।
যদিও বিশ্বের অনেক দেশ কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীনে, তবু তারা বেসামরিক এবং জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে জাহির করে। তারা জবাবদিহিতার ঊর্ধ্বে থাকেন। এর মধ্যে আছে সরাসরি সামরিক শাসন বা তাদের ছায়াসরকার। পাকিস্তানে বর্তমানে যে সরকার আছে, তাকে সেনাবাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট বলে মনে করা হয়। ৮ই ফেব্রুয়ারি সেখানে নির্বাচন হলেও তার আগে আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শাস্তি ভোগ করা সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফকে দেশে ফেরার সুযোগ দেয়া হয়। এরপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই)কে ছলেবলে কৌশলে বাইরে রাখা হয়। ফল হিসেবে ক্ষমতা ভাগাভাগি করে এর আগে ক্ষমতায় থাকা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)। তবে এই কৌশলের নেপথ্যে সেনাবাহিনী কলকাঠি নেড়েছে এটা বোঝার জন্য খুব বড় বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
এই বছরে বহু দেশে জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে, অভিবাসন চাপ বেড়েছে। ফলে বহু সরকারকে মারাত্মক চাপে পড়তে হয়েছে। অনেক দেশে জনপ্রিয় সরকার বা দলকে চিৎপটাং হতে হয়েছে। সর্বশেষ আইসল্যান্ডে মধ্যপন্থি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স ক্ষমতাসীন ইন্ডিপেন্ডেন্ট পার্টিকে পরাজিত করেছে। এসব নির্বাচনে শুধু যে রাজনৈতিক নেতৃত্বে পরিবর্তন এসেছে- এমন নয়। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপ জটিল হয়েছে। জনসংখ্যাতত্ত্ব পাল্টে যাচ্ছে। আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি ফেরাই দেখবো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পর ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হন কমালা হ্যারিস। কিন্তু ব্যাপকমাত্রায় বিতর্কিত, সমালোচিত ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে তিনি মারাত্মকভাবে পরাজিত হন। এর মধ্যদিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় পর্যায়ে বিভক্তি যে বাড়ছে তা স্পষ্ট হয়েছে। বিশেষ করে চলমান রাজনৈতিক মেরূকরণ এক্ষেত্রে অব্যাহত। আছে অভিবাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক উত্তেজনা। ট্রাম্পকে যৌনকর্মীর সঙ্গে সম্পর্কের কারণে অভিযুক্ত করা, ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গা সহ বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করা হলেও সেখানে রাজনীতিতে মেরূকরণের ফলে তিনিই জয়ী হয়েছেন। তার জয়ে বিশ্ব পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে বলা হয় বিশ্বে সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তিনি যেভাবে চাইবেন বিশ্ব সেভাবে আবর্তিত হবে। তার শুল্ক আরোপের ঘোষণায় প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে মেক্সিকো, কানাডা ও চীনে।
বৃটেনে এক দশকের উপরে ক্ষমতায় ছিল কনজারভেটিভ পার্টি। কিন্তু এ সময়ে দলটি মারাত্মক বিতর্কিত অবস্থায় পড়ে। অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে একের পর এক প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তন হতে থাকেন। এরই মধ্যে পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেন লেবার পার্টির নেতা কিয়ের স্টরমার। তার প্রতিশ্রুতিতে দীর্ঘ সময় পর লেবার পার্টির কাছে বড় পরাজয়ের শিকার হয় কনজারভেটিভ পার্টি। লেখার কলেবর সীমিত করার জন্য আমরা এ বছরে যেসব দেশে ক্ষমতাসীনরা ধরাশায়ী হয়েছেন, সংক্ষেপে তাদের পরিচয় তুলে ধরছি। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের সমাপ্তি ঘটার পর থেকে রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে এসেছে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে এ বছরেই প্রথম তারা পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। বিরোধী দলগুলোর একটি জোট ক্ষমতায় এসেছে। এর মধ্যদিয়ে সেখানে দুর্নীতি এবং দুর্বল শাসন নিয়ে ভোটারদের হতাশার প্রকাশ ঘটেছে। জাপানে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে দেশ শাসন করেছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। তারা এ বছর নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়েছে। অর্থনৈতিক বিষয়ে অসন্তোষ এবং জনসংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে সেখানে জনগণের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকে। তার ফল হিসেবে পরাজয়বরণ করে নিতে হয় এলডিপিকে। ফ্রান্সে প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন এ বছর আকস্মিকভাবে আগাম পার্লামেন্ট নির্বাচন ঘোষণা করে বিপদে পড়েন। নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। বামপন্থি ও ডানপন্থি দলগুলোর একটি জোট বিজয় পায়। বিতর্কিত সংস্কারকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অসন্তোষকে ব্যবহার করে তারা এমন সুযোগ নেয়। তবে ভারতে তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টি আবার বিজয়ী হলেও তারা এক দশকের মধ্যে প্রথমবার পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। কংগ্রেসের তরুণ নেতা রাহুল গান্ধী ও প্রিয়াংকা গান্ধী ক্যারিশমা দেখান। তারা কংগ্রেসকে আগের চেয়ে অনেক ভালো অবস্থানে নিয়ে আসেন। ফলে চিন্তার ভাঁজ পড়ে মোদির কপালে। সেনেগালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত হয় প্রেসিডেন্ট ম্যাকি স্যাল-এর জোট। জয় পান বিরোধী নেতা বাসিরু দিওমায়ে ফায়ে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন