বিদ্রোহীরা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে বাশার আল–আসাদ ও তাঁর পিতা হাফিজ আল-আসাদের ৫৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়েছেন। আর এই পতনে সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস), তুরস্ক–সমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি (এসএনএ), যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্স এবং আরও কয়েকটি ছোট ছোট দলের সমন্বয়ে গঠিত একটি গোষ্ঠী।
আসাদের পতনে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চোখেমুখে স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বও খুশি। অনেকে মনে করছেন, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের প্রভাবই সুসংহত হলো। এই ধারণা থেকে সিরিয়ার বিদ্রোহ ও আসাদের পতনের পেছনে ইসরায়েলি মদদ দেখতে পাচ্ছেন। অনেকে বলছেন, এতে নিদেনপক্ষে ফিলিস্তিনেরই ক্ষতি হলো। যদিও ফিলিস্তিনের কবি–সাহিত্যিক–বুদ্ধিজীবীরা আসাদের পতনকে ইতিবাচকভাবেই দেখছেন।
আসাদের পতনের ফলে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব–প্রতিপত্তি খর্ব হবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। সেই সঙ্গে পরাশক্তি রাশিয়ার অবস্থানও যে দুর্বল হলো সেটিও নিশ্চিত। এর ফলে আসলেই কী ফিলিস্তিনের ওপর ইসরায়েলের লৌহমুষ্ঠিকে আরও শক্তিশালী হবে? আসাদের পতন এবং সিরিয়ার সম্ভাব্য দুর্বল শাসনব্যবস্থা বা অস্থিরতায় আসলেই ফিলিস্তিনের কি কিছু আসে যায়?
এটি বুঝতে হলে ফিলিস্তিন তথা গাজার প্রতিরোধ যোদ্ধা হামাসের সঙ্গে আসাদের সম্পর্ক এবং ফিলিস্তিন ইস্যুতে আসাদ সরকারের পূর্ব ভূমিকা আরেকবার স্মরণ করা যেতে পারে।
গত বছরের শেষ নাগাদ ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে হামাসের হামলা এবং এরপর গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সর্বাত্মক যুদ্ধের আঞ্চলিক প্রভাব ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে বরাবরই পরাশক্তি ও বিশ্লেষকদের মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষ—হামাস, হিজবুল্লাহ, ইরান এবং সিরিয়ার মধ্যকার বিশেষ ধরনের এক জোটের ওপর।
অবশ্য গত ৭ অক্টোবরের পর থেকে হামাসের পক্ষে হিজবুল্লাহ এবং ইরান সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেও, সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকার হামাসের প্রতি সমর্থন প্রদর্শনে অপেক্ষাকৃত নীরব ভূমিকা পালন করেছে।
২০২২ সালের অক্টোবরেই হামাস আনুষ্ঠানিকভাবে সিরিয়ার বাশার আল–আসাদ সরকারে সঙ্গে তাদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে। সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর বছরগুলোতে হামাস সিরিয়ার বিরোধী পক্ষের বিপ্লবীদের সমর্থন জানিয়েছিল। এতে আসাদ সরকারের সঙ্গে হামাসের সম্পর্ক ভেঙে যায়।
হিজবুল্লাহ এবং ইরানের উৎসাহেই এই পুনর্মিলন ঘটে। এর একটি কারণ ছিল আব্রাহাম অ্যাকর্ডের আওতায় ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলো সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে আগ্রহী হয়ে ওঠা। একের পর এক আরব দেশগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা দিচ্ছিল। এমনকি সৌদি আরবও ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে আলোচনা শুরু করেছে।
২০০৭ সাল থেকে গাজায় ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের মধ্যে হামাস কোণঠাসা হয়ে পড়ে। তখন তারা মরিয়া হয়ে নতুন মিত্র খুঁজতে থাকে। অন্যদিকে, গৃহযুদ্ধে সিরিয়ার অর্থনীতি ধ্বংসপ্রায় এবং সিরীয় অবকাঠামো বারবার ইসরায়েলি বিমান হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তেহরান এবং হিজবুল্লাহর চাপের মুখে দামেস্ক হামাসের সঙ্গে পূর্ববর্তী শত্রুতা বজায় রাখার অবস্থায় ছিল না।
যদিও সিরিয়া হামাসের সামরিক শক্তিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে না এবং গত বছরের ৭ অক্টোবরের হামলায় তাদের কোনো ভূমিকাও ছিল বলে মনে হয় না। তবে ইরান ও হিজবুল্লাহর সঙ্গে বৃহত্তর জোটে সিরিয়ার অবস্থান আঞ্চলিক সংঘাতের ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং করছে।
এইখানে সিরিয়ার ভূরাজনৈতিক অবস্থানও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই কারণেই সিরিয়া তথাকথিত প্রতিরোধ অক্ষের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। হিজবুল্লাহর কাছে অস্ত্র সরবরাহের জন্য সিরিয়া একটি রুট হিসেবে কাজ করে। ইরানের জন্য আরব–ইসরায়েলি রণক্ষেত্রে সিরিয়া কার্যত ঘাঁটি হয়ে উঠেছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলার সুযোগ পাওয়া যায় এবং অঞ্চলজুড়ে মার্কিন অবস্থানগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করার সুযোগ তৈরি হয়।
তবে সিরিয়া এই জোটে ‘নিষ্ক্রিয় অংশগ্রহণকারী’ বলেই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়া প্রায় কোনো স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করেনি। গৃহযুদ্ধে জর্জরিত আসাদ প্রশাসন ইরান বা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল। ফলে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়া থেকে কোনো ফ্রন্ট খুলতে চাইলে হিজবুল্লাহ বা ইরানিপন্থী মিলিশিয়াদের মাধ্যমেই করতে হতো ইরানকে। সিরিয়ার নিজে কোনো যুদ্ধে জড়ানোর মতো সক্ষমতা বা অবস্থায় ছিল না।
এই পরিস্থিতিতে বিশেষ করে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে সিরিয়া ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র এবং ইরান ও ইরান-সমর্থিত মিলিশিয়াদের মধ্যে সংঘাতের মঞ্চে পরিণত হয়।
গত বছর যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী এবং তাদের মিত্রদের ওপর একাধিক বিমান হামলা চালিয়েছে। ইসরায়েল দামেস্ক ও আলেপ্পো বিমানবন্দরে বোমা হামলা করেছে। অন্যদিকে, ইরান–সমর্থিত মিলিশিয়ারা ইরাক ও সিরিয়ায় মার্কিন লক্ষ্যবস্তুতে কমপক্ষে ৪০ বার হামলা চালিয়েছে। চলতি বছরের মাঝামাঝিতে ইসরায়েল সিরিয়ায় ইরানি কনস্যুলেটে হামলা করে। এ নিয়ে ইরান–ইসরায়েল উত্তেজনা চরমে পৌঁছায়।
এই সহিংসতাগুলো সিরিয়ায় আরও অস্থিরতা তৈরি করে। সিরিয়াকে একটি প্রক্সি যুদ্ধের ক্ষেত্রে রূপান্তরিত করার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। প্রকারান্তরে এই পরিস্থিতি সিরিয়ার জনগণের জন্য আরও ভোগান্তি বয়ে আনে।
হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের ভেতর দিয়ে গাজার প্রতি সিরিয়ার সমর্থনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট আসাদ রাজনৈতিকভাবে উপকৃত হতে চেয়েছেন। কিন্তু এ অবস্থান তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াতে কোনো ভূমিকা রাখেনি। অর্থনৈতিক সংকট বাড়তেই থাকে, যেখানে ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে।
পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, গাজার প্রতি সমর্থন দেখিয়ে আসাদ মূলত রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছেন এবং তাঁর মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি আড়াল করতে চেয়েছেন। কিন্তু আরব বিশ্বে আসাদের শাসনব্যবস্থার অতীতের নৃশংসতার স্মৃতি মানুষের মধ্যে তাজা। অনেকে গাজার ওপর ইসরায়েলের অবরোধ ও বোমা বর্ষণের সঙ্গে সিরিয়ার ইয়ারমুক শরণার্থীশিবিরে সংঘটিত অবরোধের মিল খুঁজে পান।
আসাদের পতন কতটা প্রভাব ফেলবে
সিরিয়ার সশস্ত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে ইসলামপন্থী সংগঠন হায়াত তাহরির আল–শাম (এইচটিএস)। এই সংগঠনটির আগে আল–কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল। তবে বর্তমান নেতা আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি এখন আর সেই মতাদর্শ ধারণ করেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমে এটি সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত হলেও তারা এখন এইচটিএসকে নিয়ে সরাসরি আপত্তি তুলছে না। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছেন, উগ্রবাদী ইসলামি সংগঠনগুলো এই বিদ্রোহের সঙ্গে নেই।
অন্যান্য বিদ্রোহী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্কের পৃষ্ঠপোষকতার কথা জানা গেলেও এইচটিএসের সঙ্গে বহিশক্তির কোনো সম্পর্ক স্পষ্ট নয়।
তবে ইসরায়েল এ ক্ষেত্রে সতর্ক অবস্থানই দেখাচ্ছে। তারা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত কুর্দি সংগঠন সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিয়ে আশাবাদী, তবে এইচটিএসকে নিয়ে কিছুটা শঙ্কিত। যদিও এইচটিএস যে ইরানের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেই আগ্রহী সেটি গতকাল প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতায় স্পষ্ট করেছেন আল–জোলানি। তিনি সম্ভবত ইসরায়েলকে আশ্বস্ত করতেই চাচ্ছেন।
এদিকে ইসরায়েল এরই মধ্যে সিরিয়া সীমান্তে তাদের অবস্থান জানান দিতে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে। গোলান মালভূমির অধিকৃত অঞ্চলে ট্যাংক মোতায়েন করেছে। সিরিয়ার সীমান্তের ভেতরে চলে গেছে ইসরায়েলি বাহিনী। সিরিয়ার সীমান্তবাসীকে ঘরে অবস্থানের পরামর্শ দিয়েছে। নেতানিয়াহু বলেছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে এটি ইসরায়েলের সাময়িক আগাম সতর্কতা।
তবে এটি স্পষ্ট যে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ইসরায়েল জানিয়ে দিতে চাচ্ছে, সিরিয়া সীমান্ত তথা সার্বভৌমত্বে ইসরায়েলকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। সিরিয়াতে যে–ই ক্ষমতায় আসুক না কেন ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হবে এমন কোনো উপাদান সহ্য করা হবে না। আর এই অঞ্চলে ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাব খর্ব হওয়ায় ইসরায়েল আরও বেশি ছড়ি ঘোরানোর সুযোগ যে পাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ
সিরিয়াতে আসাদের পতন, ইরান ও হিজবুল্লাহর প্রভাববলয় সংকুচিত হয়ে আসার মধ্য দিয়ে এই অঞ্চলে ইসরায়েলের প্রভাব বাড়বে। তাতে ফিলিস্তিনের মানুষের কী আসে যায়? প্রকৃতপক্ষে, ইরান, হিজবুল্লাহ এবং এই অঞ্চলে ইরানপন্থী মিলিশিয়াগুলো আপাতদৃষ্টিতে ফিলিস্তিনের পক্ষে লড়ে গেলেও গাজায় কিন্তু ধ্বংসযজ্ঞ একটুও কমেনি। এখন পর্যন্ত প্রাণহানি প্রায় অর্ধলক্ষ। গাজা ধ্বংসস্তূপ। হামাস নেতৃত্বশূন্য ক্ষীণবল। যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা থেকে কাতার নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। হামাস নেতাদের দেশ থেকে বের করে দিয়েছে। দুই পক্ষের মধ্যস্থতায় এখন মিসর আর যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ইরানের অংশ কোথায়?
প্রকৃতপক্ষে ইরান লেবাননে তার মিত্র হিজবুল্লাহ ও অন্যান্য মিলিশিয়াগুলোকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে সৌদি আরবকে টেক্কা দিতে এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হওয়ার বাসনা পূর্ণ করতে চায়। এখানে ফিলিস্তিন স্বার্থ দাবার ঘুঁটি মাত্র!
বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিদের ভাগ্য ইরান, হিজবুল্লাহ ও হামাস সহযোগে ‘প্রতিরোধ অক্ষ’–এর হাতে নেই। ফিলিস্তিন–ইসরায়েল সংকট মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক শক্তিগুলোর লড়াই এবং পশ্চিম তথা যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব অক্ষুণ্ন রাখার নিশ্চয়তা প্রত্যাশার মধ্যে নিহিত।
সুতরাং সিরিয়ায় আসাদের পতন এবং ইসলামপন্থী এইচটিএস ও অন্যান্য ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর উত্থানের মধ্যে অস্থিরতার সমূহ আশঙ্কার মধ্যে ফিলিস্তিনিদের ক্ষতিবৃদ্ধির কোনো সম্পর্ক নেই। ফিলিস্তিনিদের রক্তের মূল্য আঞ্চলিক পরাশক্তিদের খায়েশের কাছে অতি নগণ্য!
লেখক: জাহাঙ্গীর আলম, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, আজকের পত্রিকা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন