দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে চীনের তুলনায় ভারতের সক্ষমতা ব্যাপক হ্রাস পাচ্ছে। উল্টো ভারতের নিজেরই ঋণ নেয়ার পরিমাণ বেড়েছে। বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী ভারতের মোট ঋণ গ্রহণের পরিমাণ গত বছর ৩১ বিলিয়ন ডলার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৪৬.৭৯ বিলিয়নে। গত বছর নেয়া ভারতকে এ ঋণের বিপরীতে সুদ দিতে হবে ২২.৫৪ বিলিয়ন ডলার। এর আগের বছর ভারতের নেয়া ঋণে সুদের পরিমাণ ছিল ১৫.০৮ বিলিয়ন ডলার।
গত মঙ্গলবার প্রকাশিত বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন অনুসারে চীন ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোকে ৪৮.১ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, অথচ এসব দেশগুলোকে নয়াদিল্লি যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার পাঁচ গুণেরও বেশি দিয়েছে বেইজিং। আফগানিস্তান, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের বিশ্বব্যাংক এবং অন্যান্য বিদেশী প্রতিষ্ঠানসহ বহিরাগত ঋণদাতাদের কাছে ৩২৪.৬ বিলিয়ন ডলার ঋণ রয়েছে। আর চীন একাই এসব দেশকে দিয়েছে ৪৮.১ বিলিয়ন ডলার। ভারত একই দেশগুলোকে ঋণ দিয়েছে মাত্র ৯ বিলিয়ন ডলার। যা এই দেশগুলোর মোট ঋণের ২.৮ শতাংশ। তবে ভারত এ অঞ্চলে ভুটান ও শ্রীলঙ্কাকে সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো লক্ষ করলে দেখা যায় প্রতিবেশী দেশগুলোকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ভারত পিছিয়ে থাকলেও রাজনৈতিক প্রভাব ও এসব দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে এক ধরনের প্রপাগান্ডা অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হতে সবসময় বাধা সৃষ্টি করেছে। একই কারণে দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা পরিষদ সার্ক কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতেই পারছে না। বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদরা বলে আসছেন ভারতের ‘বিগ ব্রাদার’ নীতির কারণেই আঞ্চলিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিকস বা অন্যান্য আন্তর্জাতিক জোটের মতো কখনোই একাট্টা হয়ে নিজেদের মধ্যে উন্নয়নের অংশীদারিত্ব সৃষ্টি করতে পারছে না।
বিশ্বব্যাংকের সর্বশেষ এই আন্তর্জাতিক ঋণ প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আফগানিস্তানের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ প্রায় ৩.৪ বিলিয়ন ডলার। আর দেশটির সবচেয়ে বড় ঋণদাতা দেশ রাশিয়া। অথচ একসময়ে আফগানিস্তান রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসনের কবলে পড়েছিল। দু’টি দেশই বছরের পর বছর যুদ্ধ করেছে। তবে, বর্তমানে কাবুল মস্কোর কাছে তার মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ ঋণী, যার পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন ডলার। লক্ষ্যণীয় দিক হচ্ছে, আফগানিস্তানের কোনো প্রতিবেশী দেশ নয়, সৌদি আরব ও ইতালিও অন্যান্য বড় দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা। বিশ্বব্যাংকের এই প্রতিবেদনে ভারত বা চীন আফগানিস্তানকে কী পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তার পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। আবার প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, বাংলাদেশ বেইজিং থেকে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে। যা মোট বিদেশী ঋণের ৯ শতাংশ। কিন্তু চীন বাংলাদেশের বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা দেশ নয়। বৃহত্তম ঋণদাতা দেশ হিসেবে জাপানে বাংলাদেশকে ১৫.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে, এরপর আছে রাশিয়া, তৃতীয় বৃহত্তম ঋণদাতা হিসেবে চীন বাংলাদেশকে দিয়েছে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলার ঋণ। একই সাথে বিশ্বব্যাংক (২৬ শতাংশ) এবং এডিবি (২০ শতাংশ) বাংলাদেশের দু’টি বৃহত্তম প্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতা। শুধু বাংলাদেশ নয়, জাপান এ অঞ্চলে নেপাল ও মিয়ানমারেও সর্বোচ্চ ঋণ দাতা ও শ্রীলঙ্কাকে তৃতীয় সর্বোচ্চ ঋণদাতা দেশ। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বিদেশী ঋণগ্রহীতা দেশ পাকিস্তান নিয়েছে ১৩০ বিলিয়ন আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঋণ গ্রহীতা দেশ বাংলাদেশ নিয়েছে ১০১ বিলিয়ন ডলার।
আবার দক্ষিণ এশিয়ায় ভুটানকে ভারত সবচেয়ে বেশি ঋণ দিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের মতে ভুটানের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩.৩ বিলিয়ন ডলার। থিম্পুকে নিখুঁত শর্তে দিল্লির মোট ঋণ প্রায় ২.১ বিলিয়ন। ভুটানের মোট ঋণের প্রায় ৭০ শতাংশ দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতাদের, যার মধ্যে রয়েছে জাপান (৩ শতাংশ) এবং অস্ট্রিয়া (০.২ শতাংশ)। এডিবি (১৫ শতাংশ) এবং বিশ্বব্যাংকসহ (১৪ শতাংশ) বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান দু’টি বড় ঋণদাতা।
এ অঞ্চলে ছোট দেশ হিসেবে মালদ্বীপের মোট ঋণের পরিমাণ চার বিলিয়ন ডলার। দেশটির বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা হলো চীন ও ভারত, যা তার মোট ঋণের প্রায় ৪০ শতাংশ। কিন্তু বহু পক্ষীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মালদ্বীপের মোট ঋণের ১৮ শতাংশ, বন্ডহোল্ডার ও বাণিজ্যিক ঋণসহ ব্যক্তিগত ঋণদাতারা দেশটির মোট ঋণের প্রায় ৩৩ শতাংশ দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে দেশটির কাছে চীনের ৯৬০ মিলিয়ন বা মোট ঋণের ২৪ শতাংশ পাওনা রয়েছে, ভারতের রয়েছে প্রায় ৬৪০ মিলিয়ন বা ১৬ শতাংশ পাওনা।
বিশ্বব্যাংকের হিসেবে মিয়ানমারের মোট ঋণের পরিমাণ প্রায় ১২.১ বিলিয়ন, এর মধ্যে ৬ শতাংশ (৭২০ মিলিয়ন) চীনের কাছে পাওনা। জাপান মিয়ানমারের পাওয়া মোট ঋণের প্রায় ৩৬ শতাংশ দিয়েছে, যার পরিমাণ ৪.৩৫৬ বিলিয়ন। দেশটির প্রায় ১৫ শতাংশ ঋণ বেসরকারি ঋণদাতাদের কাছে পাওনা, এর প্রায় ২৮ শতাংশ বিশ্বব্যাংক ও এডিবিসহ বহু পক্ষীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা।
সম্প্রতি মিয়ানমারে চীন ২.৬ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে মি লিন গিয়াংয়ে এলএনজি পাওয়ার প্ল্যান্টে। এ ছাড়া নিউ ইয়াঙ্গুন প্রকল্পের মতো অবকাঠামোতে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন। এর বিপরীতে ভারত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মূল সংযোগ মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বেশ কিছু অবকাঠামো প্রকল্প বিনিয়োগ বিলম্বিত করেছে। ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ড ত্রিপক্ষীয় মহাসড়ক (আইএমটি হাইওয়ে) এমন একটি প্রকল্প, যা মনিপুরের মোরেহকে থাইল্যান্ডের মায়ে সোটের সাথে মিয়ানমার হয়ে সংযুক্ত করবে। প্রকল্পের বেশির ভাগ যাবে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে।
নেপালের পাওনা বৈদেশিক ঋণের প্রায় ৮৮ শতাংশ বিশ্বব্যাংক ও এডিবির মতো বহু পক্ষীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছে। তাদের মোট ৯.৯ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মজুদের মধ্যে প্রায় ৪৮ শতাংশ বিশ্বব্যাংকের, আর ৩৩ শতাংশ এডিবির কাছ থেকে। দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা হিসেবে ভারত ও চীন উভয়ই নেপালের মোট ঋণের ৩ শতাংশ দিয়েছে, যা ৩০০ মিলিয়ন ডলার। জাপান দেশটিকে দিয়েছে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায় ইসলামাবাদ এই অঞ্চলে চীনা ঋণের বৃহত্তম প্রাপক, বেইজিং থেকে প্রায় ২৮.৬ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে, যা তার মোট ঋণের ২২ শতাংশ। চীন পাকিস্তানের জন্য একক বৃহত্তম ঋণদাতা, যেটি বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইএমএফসহ বিভিন্ন বহুপক্ষীয় প্রতিষ্ঠান থেকেও ঋণ নিয়েছে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, ঋণের ওপর ইসলামাবাদের সুদের অর্থের পরিমাণ তার মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৪৩ শতাংশ, যা বিশ্বের সর্বোচ্চ। এ ছাড়া চীন, সৌদি আরব ও আমিরাতের কাছ থেকে পাকিস্তান ১২ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে। শ্রীলঙ্কাকে ভারত ঋণ দিয়েছে ৬.১ বিলিয়ন ডলার, যা মোট ঋণের ১০ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের মতে, কয়েক বছর ধরে চীন শ্রীলঙ্কাকে ৮.৫৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার মোট ঋণ প্রায় ৬১.৭ বিলিয়ন। জাপান দ্বীপরাষ্ট্রের তৃতীয় বৃহত্তম দ্বিপক্ষীয় ঋণদাতা, যার মোট ঋণের প্রায় ৬ শতাংশ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন