সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধসে পড়েছে। আর সেইসাথে বিদ্রোহীরা রাজধানী দামেস্কে প্রবেশ করতে যাচ্ছে।
দামেস্ক সিটির এক অধিবাসী সিএনএনকে বলেছেন, বিদ্রোহীরা এখন বারজেতে অবস্থান করছে। এখনো সংঘর্ষ চলছে।
তিনি বলেন, 'আমি বিদ্রোহী যোদ্ধাদেরকে বারজের ভেতরের অলিগতিতে দেখতে পাচ্ছি। লড়াইয়ের প্রচণ্ড শব্দ আসছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, ইন্টারনেট খুবই দুর্বল। লোকজন তাদের বাড়িঘরে অবস্থান করছে।
পর্যবেক্ষণকারী ইউনিটগুলো রাতেই দামেস্কে প্রবেশ করেছে। তারা প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সন্ধান করছে। তবে তাকে তারা পায়নি।
একটি সূত্র জানায়, বিদ্রোহীদের বিশেষ ইউনিটগুলো দামেস্কে প্রবেশ করে কৌশলগত স্থানগুলোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করছে।
বিদ্রোহীরা দাবি করেছে, তারা আসাদ সরকারের সিনিয়র সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করছে। এসব সদস্য পক্ষত্যাগ করছে।
শনিবার এক দিনে সিরিয়ার চারটি নগরী দখল করার পর বিদ্রোহীরা রাজধানী দখল করার দিকে মনোযোগ দেয়। দারা, কুনিত্রা, সাওয়াদা ও হোমস শনিবার বিদ্রোহীরা দখল করে।
বিদ্রোহীদের মুখপাত্র লে. কর্নেল হাসান আবদুল গনি রোববার ভোররাতে বলেন, তারা দামেস্কের আশপাশের পুরো এলাকা দখল করে ফেলছেন। তাদের চোখ এখন দামেস্কের দিকে।
বিদ্রোহী বাহিনীর এই অগ্রযাত্রার মুখে সরকার এ রকম গুজব অস্বীকার করতে বাধ্য হয় যে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন।
হোমস হারানো আসাদের জন্য সম্ভাব্য খর্ব করে দেয়ার মতো এক আঘাত। এ শহরটি দামেস্ক এবং সিরিয়ার উপকুলীয় প্রদেশ লাতাকিয়া ও তারতাসের মাঝখানে অবস্থিত। তারতাস হচ্ছে সিরিযার নেতার সমর্থনের ঘাঁটি এবং সেখানেই রয়েছে রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ নৌ ঘাঁটি।
সরকারপন্থী শাম এফএম জানিয়েছে যে সরকারি বাহিনী সিরিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম নগরীর বাইরে তাদের অবস্থান গ্রহণ করেছে। তবে আর কিছু বিস্তারিত জানায়নি। ব্রিটেনভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটারি ফর হিউমান রাইটস’এর প্রধান রামি আব্দুররাহমান বলেন, সিরিয়ার সেনাবাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার সদস্যরা ওই শহর থেকে সরে গেছে এবং বলেছেন যে বিদ্রোহীরা শহরটির কিছু অংশে প্রবেশ করেছে।
হোমস দখল করা বিদ্রোহীদের জন্য একটি বড় রকমের বিজয়। তারা ইতোমধ্যেই আলেপ্পো ও হামা আর সেই সাথে দক্ষিণের এক বিশাল এলাকা দখল করেছে। বিশ্লেষকরা বলছে, বিদ্রোহীদের হাতে হোমস চলে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে পরিস্থিতিটাই পাল্টে যাওয়া।
সিরিয়ার সেনাবাহিনী দেশের দক্ষিণের অনেকটাই ছেড়ে আসার পর পর্যবেক্ষক ও একজন বিদ্রোহী কমান্ডার জানিয়েছেন যে বিদ্রোহীরা দামেস্কের চার পাশে চলে এসেছে । সেনাবাহিনীর স্থান ত্যাগের কারণে অনেক প্রাদেশিক রাজধানীসহ অনেকখানি এলাকা বিরোধী যোদ্ধাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে।
গত সপ্তাহে বিরোধী এই গোষ্ঠী যতখানি এগিয়ে গেছে তা সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে ছিল সবচেয়ে বেশি এলাকা। এই গোষ্ঠীর উদ্ভব আল কায়েদা থেকে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘ এটিকে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিসেবে বিবেচনা করে।
আসাদ সরকারকে ক্ষমতাচ্যূত করতে হায়াত তাহরির আল শাম বা এইচটিএস গোষ্ঠী সিরিয়ার সেনাবাহিনীর কাছ থেকে তেমন প্রতিরোধের মুখোমুখি হযনি।
দীর্ঘ কালের এই গৃহযুদ্ধে এই প্রথমবার ১৪টি প্রাদেশিক রাজধানীর মধ্যে সরকার নিয়ন্ত্রণ করছে মাত্র তিনটি : দামেস্ক, লাতাকিয়া ও তারতাস।
শনিবার সিরিয়াবিষয়ক জাতিসঙ্ঘ বিশেষ দূত, গেইর পেডারসান 'সুশৃঙ্খলভাবে রাজনৈতিক পরিবর্তন' নিশ্চিত করতে জেনেভায় জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানিয়েছেন। কাতারে বার্ষিক দোহা ফোরামে ভাষণ দেয়ার সময়ে তিনি বলেন সিরিয়ার পরিস্থিতি মিনিটে মিনিটে পাল্টাচ্ছে। আসাদের প্রধান আন্তর্জাতিক সমর্থক দেশ রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সার্গেই লাভরভ বলেন তিনি 'সিরিয়ার জনগণের জন্য দুঃখ বোধ করছেন'।
দামেস্কে লোকজন তাদের সরবরাহ জমিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। হাজার হাজার লোক দেশ ত্যাগের উদ্দেশে লেবাননের সাথে সিরিয়িার সীমান্তের দিকে চলে গেছেন। সেখানকার একজন বাশিন্দা এপিকে জানান যে রাজধানীর বহু দোকান বন্ধ ছিল এবং যেগুলো এখনো খোলা রয়েছে সেখানে চিনির মতো প্রধান খাদ্যের ঘাটতি রয়েছে। কোনো কোনো দোকানে স্বাভাবিক দামের চেয়ে তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি করা হচেছ।
প্রতিশোধের ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাসিন্দা বলেন, ‘পরিস্থিতি বড় অদ্ভূত। আমরা এতে অভ্যস্ত নই। লোকজন উদ্বগিন রয়েছেন যে ( দামেস্কে) লড়াই হবে, কী না।”
২০১৮ সালের পর এই প্রথম বিরোধী বাহিনী দামেস্কের বাইরে পৌঁছে গেছে। সেই সময়ে এক বছর ধরে অবরুদ্ধ থাকার পর সিরীয় বাহিনী ওই সব এলাকা আবার দখল করে নেয়। জাতিসঙ্ঘ বলছে যে সাবধানতা হিসেবে তারা অত্যাবশকীয় নন এমন কর্মীদের সেখান থেকে সরিয়ে নিচ্ছেন।
আসাদের অবস্থান
সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সামাজিক মাধ্যমের এই গুজবকে নাকচ করে দিয়েছে যে আসাদ দেশ ছেড়ে চলে গেছেন। তারা বলছে, তিনি দামেস্কে তার নিয়মিত দায়িত্ব পালন করছেন।
তিনি তার মিত্রদের কাছ থেকে তেমন সাহায্য পাননি। রাশিয়া ইউক্রেনের সাথে তার যুদ্ধ নিয়ে ব্যস্ত। লেবাননের হিজবুল্লাহ ইসরাইলের সাথে এক বছরব্যাপী যুদ্ধে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এক সময়ে তারা আসাদের সৈন্যদের সহায়তায় হাজার হাজার যোদ্ধা পাঠিয়েছিল। ইরান দেখছে, ইসরাইলের বিমান হামলায় তার পক্ষের শক্তিগুলো দুর্বল হয়ে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শনিবার সামাজিক মাধ্যমে দেয়া এক পোস্টে লেখেন যে সিরিয়ায় সামরিকভাবে সম্পৃক্ত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের এড়ানো উচিত।
পেডারসন বলেন, ২০১৫ সালে গৃহীত জাতিসঙ্ঘের একটি প্রস্তাব নিয়ে জেনেভোয় আলোচনার একটি তারিখ পরে ঘোষণা করা হবে। ওই প্রস্তাবে সিরিয়ার নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়েছে।
শনিবার আরো পরে সৌদি আরব, রাশিয়া, মিসর, তুরস্ক ও ইরানসহ আটটি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পদস্থ কুটনীতিকরা এবং পেডারসনও দোহা শীর্ষ বৈঠকের অবকাশে সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। তবে তাত্ক্ষণিকভাবে বিস্তারিত কিছু জানা যায়নি।
এ দিকে ব্রিটেনভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের প্রধান রামি আব্দুররাহমান, যিনি বিরোধীদের যুদ্ধে নজরদারি করছেন, বলেন যে বিদ্রোহীরা দামেস্কের মাদামিয়াহ, জারামানা ও দারায়া উপকন্ঠে প্রবেশ করেছে। তিনি আরো বলেন, তারা দামেস্কের আরেকটি উপশহর হারাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র : সিএনএন, ভিওএ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন