এ বছর বাংলাদেশের একদল শিক্ষার্থী প্রথমবারের মতো অংশ নিল ওয়ার্ল্ড ম্যাথমেটিকস টিম চ্যাম্পিয়নশিপ (ডব্লিউএমটিসি) ২০২৪ প্রতিযোগিতায়। বাংলার ম্যাথের তত্ত্বাবধানে কাতারের দোহায় শিক্ষার্থীরা বিশ্বের নানা দেশের গণিতপ্রেমীদের সঙ্গে মেধার লড়াইয়ে নামে। জিতে নেয় ৬টি স্বর্ণ, ১১টি রৌপ্য, ৭টি ব্রোঞ্জ ও ৩টি মেধা সম্মাননা। দলের ২৭ সদস্যের প্রত্যেকেই কোনো না কোনো পদক জিতে চমকে দিয়েছে সবাইকে।
২৯ নভেম্বর বসেছিল গণিতের এই আন্তর্জাতিক আসর। এর আগেই সারা দেশ থেকে বাংলাদেশ দলের সদস্যদের বাছাই করেছে বাংলার ম্যাথ। জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ঢাকার সাউথ ইস্ট ইউনিভার্সিটিতে। নির্বাচিত দলকে দুই মাসের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে তৈরি করা হয় বিশ্বমঞ্চের জন্য। এবারের আয়োজনে বাংলাদেশ দলের ভ্রমণ সহযোগী ছিল বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ফারহান উদ্দিন, আহমেদ শাহরিয়ার, এস এম মাহতাব হোসাইন ও আশরাফুল আল শাকুর।
শীর্ষ ৩০ শতাংশে বাংলাদেশ
টিম চ্যাম্পিয়নশিপের জুনিয়র পর্যায়ে বেঙ্গল হেক্সাগন, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে রয়েল সিক্স অব বেঙ্গল, ডেল্টা সিক্স ও বেঙ্গল হেক্সা, উচ্চতর শ্রেণিতে বেঙ্গল ট্রাইনোমিয়ালের সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা ডব্লিউএমটিসিতে অংশ নিয়েছে। জুনিয়র পর্যায়ের অহন বনিক, উচ্চমাধ্যমিকে তাহমীদ আল আসাদ, মোবাশ্বির আরিক, প্রজেশ ভৌমিক, সাকিফ মিহরান ও নাশওয়ান হক পেয়েছে স্বর্ণপদক। জুনিয়র পর্যায়ে আরমান মালিক, ফাতিমা জাহরা শেখ, জান্নাতুল ফেরদৌস, উচ্চমাধ্যমিকে লাইবা সাবিনা ইসলাম, আয়ান জামান, উছাইওয়াং মারমা, মো. তাহসিন ইসলাম, মো. সারাফ নুহিল ইসলাম, রাফিদ উন নবী; উচ্চতর পর্যায়ে মোহাম্মদ মারজুক রহমান, সাদ বিন আহমেদ রৌপ্যপদক পেয়েছে। জুনিয়র শ্রেণিতে শেখ আলিমুল হাকিম, উচ্চমাধ্যমিকে মোহাম্মদ সাইফান হায়দার, সাকিন আল সাদাফ, শুভ্র অনিন্দ্য বেপারী, মোহাম্মদ ইবতেসাম ইসলাম, মো. ফাহিম; উচ্চতর শ্রেণিতে ইনতেশার আলম মানামের হাত ধরে এসেছে ব্রোঞ্জপদক। জুনিয়র শ্রেণিতে গৈরিক পাল, উচ্চমাধ্যমিকে হুমায়রা আফিয়া, অহম সাহা মেধা সনদ অর্জন করে। দলগত পর্যায়ের বাংলাদেশের সব কটি দলই শীর্ষ ৩০ শতাংশ দলের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে এবার।
অনন্য অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সবাই
এবারের আয়োজনে দেশের নানা প্রান্তের শিক্ষার্থীরা এক হয়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে। বান্দরবানের কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজের অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী উছাইওয়াং মারমা যেমন জানিয়ে দিয়েছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে বেড়ে উঠলেও গণিতের লড়াইয়ে সে কারও চেয়ে কম যায় না। উছাইওয়াং বলল, ‘আমি এবারই প্রথমবারের মতো গণিত প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছি। বান্দরবানের মতো এলাকা থেকে কাতারের দোহায় যাওয়ার সুযোগ আমার জন্য দারুণ এক অভিজ্ঞতা। রৌপ্যপদক পেয়ে আনন্দ আরও বেড়ে গেছে। প্রশ্ন বেশ কঠিন হলেও বুদ্ধি খাটিয়ে সমাধান করেছি।’
বগুড়া রুরাল সার্ভিস ফাউন্ডেশন গ্রানাডা একাডেমির দশম শ্রেণিতে পড়ছে মো. ফাহিম। সে বলল, ‘প্রথমবার কোনো বড় আয়োজনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেলাম। বইয়ের বাইরের সব গণিতের প্রশ্ন, তাই বেশ রোমাঞ্চিত ছিলাম। কঠিন, কিন্তু সহজে সমাধান করা যায়, এমন প্রশ্নগুলোর উত্তর দিয়েছি। এককভাবে ব্রোঞ্জপদক পেয়ে আমি ভীষণ খুশি।’ বাংলাদেশ দলের আরেক প্রতিনিধি সাদ বিন আহমেদ, পড়ছে সেন্ট গ্রেগরী হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণিতে। তার বক্তব্য, ‘এবারের আয়োজন থেকে আমি রৌপ্য পেয়েছি। একক পর্বে এমসিকিউ ও লিখিত প্রশ্নে প্রতিযোগিতা হয়েছে। লিখিত প্রশ্নে নাম্বার থিওরি, জিওমেট্রি, অ্যালজেবরা ও কম্বিনেটরিকস থেকে প্রশ্ন এসেছিল। এত বড় আয়োজনে অংশ নিতে পারার অভিজ্ঞতা অন্য রকম। নানা দেশ থেকে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী এসেছিল। সেখানে আমি বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে মঞ্চে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। এই অনুভূতি বলে বোঝানো যাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের ডেনিয়াল ও মাইকেল নামের দুজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছে। ওদের বাংলাদেশে আসার দাওয়াত দিয়ে রেখেছি।’
ইন্টারমিডিয়েট ক্যাটাগরিতে স্বর্ণপদকজয়ী তাহমীদ আল আসাদের সঙ্গেও কথা হলো। সেন্ট জোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে সে। বলল, ‘দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ হলো এই প্রথম। আমি নিয়মিত জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিচ্ছি। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বেশ ভালো প্রস্তুতি ছিল। কয়েক ধাপে নির্বাচিত হয়েছি বাংলাদেশ দলের জন্য। ম্যাথমেটিকস টিম চ্যাম্পিয়নশিপের এমসিকিউ পর্বে ১৫টা প্রশ্নের মধ্যে ১০টার সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিলাম। আর লিখিত প্রশ্ন বিভাগে আটটার মধ্যে প্রায় চারটার মতো উত্তর ঠিকঠাক দেওয়ার চেষ্টা করেছি।’
সামনের দিনগুলোতে গণিতের অঙ্গনে আরও বড় বড় পুরস্কারের প্রত্যাশায় আছে এই খুদে গণিতবিদেরা।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন