ভারতে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা এবং সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর দমন-পীড়ন বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম প্রায়ই সেখানকার সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নের বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিবেদন প্রকাশ করছে।
বিশেষ করে ঐতিহাসিক মসজিদ ভাঙার ঘটনাগুলোকে হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার অংশ হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে গণমাধ্যম। এই উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর ওপর এসবের প্রভাব এবং সংখ্যালঘু মুসলিম নিপীড়নের বিষয়ে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়াও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উঠে আসছে গণমাধ্যমে।
ঐতিহাসিক মুসলিম স্থাপনায় হিন্দুত্ববাদীদের চোখ রাঙানির সবশেষ নজির দেখা গেছে আজমরীর শরিফে। গত ২৭ নভেম্বর হিন্দুস্তান টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, উগ্রবাদীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজমীরের আদালত তিনটি পক্ষকে নোটিশ দেন। ওই আবেদনে বলা হয়, খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরবারের ভেতরে একটি শিব মন্দির রয়েছে।
বিচারক মনমোহন চন্দেলের আদালত ‘সত্য নির্ধারণে’ দরবার কমিটি, সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে (এএসআই) নোটিশ পাঠানোর নির্দেশ দেন।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ ধরনের সাম্প্রদায়িকতার বড় উদাহরণ ১৯৯২ সালে অযোধ্যার বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনাটি। দাঙ্গা বাঁধিয়ে ওই মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়েছিল। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) মতো গোষ্ঠীগুলো দাবি করে, মসজিদটি ‘ভগবান রাম’-এর জন্মস্থানের ওপর নির্মিত। ২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে রাম মন্দির নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হলেও সমালোচকরা বলছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ ইতিহাস পুনর্লিখনের বৈধতা দিচ্ছে এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে উসকে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান এবং আল-জাজিরার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিজেপি সরকার মুসলিম ঐতিহ্য মুছে দিতে শহরের নাম পরিবর্তন, শিক্ষাক্ষেত্রে মুসলিম প্রতিনিধিত্ব কমানো এবং প্রশাসনে প্রান্তিকীকরণে কাজ করছে।
ভারতে মসজিদগুলোর ওপর এমন আক্রমণকে ইসলামী পরিচিতির ওপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয় বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে। এ ধরনের ঘটনাগুলো আশপাশের দেশে হিন্দু সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক সহিংসতার সূত্রপাত ঘটায়। কূটনৈতিক সম্পর্কও এই কারণে উত্তেজনাপূর্ণ হয়ে উঠছে।
ভারতে মুসলিমদের প্রতি এমন আচরণ ভারতবিরোধী বয়ানকে আরও জোরদার করছে বলে মনে করে পাকিস্তানের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। দেশটির বিখ্যাত সংবাদমাধ্যম ডন-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে ঐতিহাসিক মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাগুলো ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছেন পাকিস্তানের রাজনৈতিক নেতারা।
ভারতের তুলনায় নেপালে মুসলিম সম্প্রদায়ের আকারটি বেশ ছোটই। তবে নেপালি সংবাদমাধ্যম কাঠমান্ডু পোস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের ইসলামফোবিয়া নিয়ে নেপালের মুসলিমরা এক ধরনের শঙ্কার মধ্যে আছেন। তাদের ধারণা, ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রভাবের কারণে সাম্প্রদায়িক শান্তি নষ্ট হতে পারে।
মধ্যপ্রাচ্য এবং পশ্চিমা দেশগুলোর মুসলিম প্রবাসীরা ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। অনেকেই তা বৈশ্বিক ইসলামফোবিয়ার অংশ হিসেবে দেখেন। ইসলামিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (ওআইসি) এর মতো সংস্থা এই ঘটনাগুলোর নিন্দা জানিয়েছে এবং ভারতকে তার মুসলিম নাগরিকদের সুরক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। মসজিদের ওপর আক্রমণ কেবল ধর্মীয় বিভেদই নয়, এটি ভারতের বহুত্ববাদী ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে বিকৃত করার একটি প্রয়াস।
মসজিদগুলোকে ঐতিহাসিক আক্রমণের প্রতীক হিসেবে দেখিয়ে ‘আমরা বনাম তারা’ মনোভাবকে আরও শক্তিশালী করা হচ্ছে। দেশের অভ্যন্তরে এটি সাম্প্রদায়িক বিভাজন বাড়িয়ে তোলে, সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে।
আন্তর্জাতিকভাবে এটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র হিসেবে ভারতের সুনামকে ক্ষুণ্ন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ধর্মীয় স্বাধীনতা কমিশন (ইউএসসিআইআরএফ) বারবার ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতার অবনতির বিষয়টি তুলে ধরেছে।
২০১৪ সালে ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতে সংখ্যালঘু মুসলিমরা বৈষম্য, সহিংসতা এবং রাষ্ট্রের মদতে নিপীড়নের শিকার বলে অভিযোগ উঠেছে। দ্য গার্ডিয়ানের ‘হিন্দুত্ববাদীদের ইতিহাস পুনর্লিখন চেষ্টায় টার্গেট হাজারো মসজিদ’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার আওতায় মুসলিমদের ওপর এই নিপীড়ন চলছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডার লক্ষ্য হলো ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র থেকে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তর করা। এই এজেন্ডার আওতায় মুসলিম নাগরিক, কর্মী এবং সাংবাদিকদের ওপর হামলা চালানো হচ্ছে। মুসলমানদের ব্যবসা বর্জন, বিজেপি নেতাদের ইসলামবিদ্বেষী বক্তব্য এবং গণপিটুনির মতো ঘটনাও বেড়েছে।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বিজেপির একজন জ্যেষ্ঠ নেতা দাবি করেছেন, মুঘলরা ৩৬ হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছে এবং সেই মন্দিরগুলো একে একে পুনরুদ্ধার করা হবে।
তবে এই দাবির বিরোধিতা করে ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক রিচার্ড ইটন দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, মুঘলদের দ্বারা প্রায় দুই ডজন মন্দির ধ্বংস হওয়ার ঐতিহাসিক প্রমাণ রয়েছে। হাজার হাজার মন্দির ধ্বংসের দাবি ভিত্তিহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন এবং অসত্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
মুঘল সাম্রাজ্য নিয়ে গবেষণা করা রাটগার্স ইউনিভার্সিটির ইতিহাসের অড্রে ট্রাস্ক হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর কাছ থেকে প্রাণনাশের হুমকি পেয়েছেন বলে গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
ভারতে এই ধরনের অভিযোগ ও কার্যকলাপের মাধ্যমে দেশটির ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিশ্লেষকরা। এই ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।
ভারতের প্রকৃত শক্তি তার বৈচিত্র্যে। সেই ঐতিহ্যের চর্চা এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই ভারতের ভবিষ্যৎ টিকিয়ে রাখা সম্ভব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন