গত ১১ দিন ধরে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রযুক্তি জায়ান্ট স্যামসাং ইলেকট্রনিক্সের প্রায় এক হাজার ৫০০ কর্মী দক্ষিণ ভারতের রাজ্য তামিলনাড়ুতে ধর্মঘট করছে। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে।
শ্রমিকরা প্রতিদিন কারখানার কাছে জড়ো হয়ে ধর্মঘট চালিয়ে যাচ্ছে। একজন প্রতিবাদকারী বলেছেন তিনি প্রতিদিন সকাল ৮টায় প্রতিবাদস্থলে আসেন এবং বিকাল ৫ পর্যন্ত থাকেন।
তাদের নীল স্যামসাং ইন্ডিয়া ইউনিফর্মে শত শত শ্রমিকের সঙ্গে যোগ দেন। ইউনিয়ন প্রতিবাদকারীদের জন্য দুপুরের খাবার এবং পানির ব্যবস্থা করে। এর জন্য স্থাপন করা হয়েছে একটি অস্থায়ী কাপড়ের তাঁবুও। অনুমতি ছাড়া বিক্ষোভ মিছিল করার জন্য পুলিশ প্রায় ১০৪ কর্মীকে আটক করেছিল বলে জানা যায়, তবে সন্ধ্যায় ওই আন্দোলনকারীদের আবার ছেড়ে দেওয়া হয়।
ওই প্রতিবাদকারী আরো বলেন, ‘কারখানাটি স্থাপনের পর থেকে কর্মচারীদের অভিযোগ ইউনিয়ন ছাড়াই কাজ করছে এটি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে পরিস্থিতি খারাপ হচ্ছে এবং এখন আমাদের একটি ইউনিয়নের সমর্থন প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, যা বেতন পান তা দিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না।
ভারতের স্যামসাং-এর দুটি কারখানার মধ্যে একটি চেন্নাই শহরের প্ল্যান্টে প্রায় ২ হাজার কর্মী কাজ করে।
তারা গৃহস্থালীর নানা যন্ত্রপাতি তৈরি করে থাকে, যা ভারতে কম্পানিটির বার্ষিক ১২ বিলিয়ন ডলারের রাজস্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশে অবদান রাখে।
নবগঠিত শ্রমিক ইউনিয়ন ‘স্যামসাং ইন্ডিয়া লেবার ওয়েলফেয়ার ইউনিয়ন (এসআইএলডব্লিউইউ)- কে স্বীকৃতির দাবি জানিয়েছে শ্রমিকরা। তাদের দাবি, শুধুমাত্র একটি ইউনিয়ন তাদের ব্যবস্থাপনার সঙ্গে ভাল মজুরি এবং কাজের সময় নিয়ে আলোচনা করতে সহায়তা করতে পারে।
কারখানা কর্মীদের তিনটি মূল দাবির মধ্যে রয়েছে, স্যামসাংকে অবশ্যই নতুন ইউনিয়নকে স্বীকৃতি দিতে হবে, যৌথ দরকষাকষির অনুমতি দিতে হবে এবং প্রতিযোগী ইউনিয়নগুলো প্রত্যাখ্যান করতে হবে, কারণ প্রায় ৯০শতাংশ কর্মী এসআইএলডব্লিউইউ-এর অন্তর্গত বলে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সমর্থিত সেন্টার অফ ইন্ডিয়ান ট্রেড ইউনিয়নের (সিটু) সদস্য এ সৌন্দররাজন বলেছেন।
তিনি আরো জানান, কম্পানি তাদের দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
সিটুর মতে শ্রমিকরা মাসে গড়ে ২৫ হাজার রুপি উপার্জন করে। তারা আগামী তিন বছরে মোট ৫০ শতাংশ বৃদ্ধির দাবি করছে।
সিটু অভিযোগ তুলেছে, প্ল্যান্টের কর্মীদের প্রতিটি পণ্য - যেমন একটি রেফ্রিজারেটর, ওয়াশিং মেশিন বা টিভির ফিনিশিং ১০ থেকে ১৫ সেকেন্ডের মধ্যে শেষ করার জন্য চাপ দেওয়া হয়। চার থেকে পাঁচ ঘন্টা বিরতিহীনভাবে কাজ করছে শ্রমিকরা এবং অনিরাপদ পরিস্থিতিতেই চাকরি করছে।
সৌন্দররাজন আরো অভিযোগ করে বলেন, শ্রমিকদের নতুন ইউনিয়ন ছেড়ে যাওয়ার জন্য কম্পানির পক্ষ থেকে চাপ দেওয়া হয়েছিল, এমনকি তাদের পরিবারকেও হুমকি দেওয়া হয়।
এদিকে স্যামসং ইন্ডিয়া একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কর্মীদের কল্যাণই তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ছিল। সেখানে আরো বলা হয়, ‘আমরা চেন্নাই প্ল্যান্টে আমাদের কর্মীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছি যাতে তাড়াতাড়ি সব সমস্যা সমাধান করা যায়।’
এ বিষয়ে তামিলনাড়ুর শ্রম কল্যাণ মন্ত্রী সিভি গণেশন বলেছেন, তিনি ইউনিয়ন কর্মকর্তাদের আশ্বস্ত করেছেন যে তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য আলোচনা চলছে। আমরা শ্রমিকদের দাবি পূরণ করব।
২০২০ সাল পর্যন্ত স্যামসাং গ্রুপটি ইউনিয়নগুলোকে তার কর্মীদের প্রতিনিধিত্ব করার অনুমতি দিত না। কিন্তু বাজারের কারসাজি এবং ঘুষের জন্য কম্পানিটির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলে যায়।
অ্যাপল এবং অ্যামাজনের মতো অনেক নামী বহুজাতিক কম্পানি ভারতে কারখানা স্থাপন করেছে। কিন্তু শ্রম অধিকার কর্মীদের অভিযোগ, তাদের মধ্যে অনেকেই তাদের ভারতীয় কর্মচারীদের কম বেতন দেয় এবং অতিরিক্ত কাজ করায়। এ ছাড়া শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্য রাজ্য সরকারের সঙ্গে যোগসাজশ করে।
শ্রম অর্থনীতিবিদ শ্যাম সুন্দর বলেছেন, বহুজাতিক সংস্থাগুলো ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে শ্রমিকদের ইউনিয়ন গঠনে বাধা দেওয়ার জন্য বিভিন্ন ‘মানব সম্পদ কৌশল’ ব্যবহার করে। প্রথমত, তারা শ্রমিকদের বহিরাগত, রাজনৈতিকভাবে-সমর্থিত ইউনিয়নে যোগদানে তীব্র বিরোধিতা করে এবং তাদের ‘শ্রমিক-নেতৃত্বাধীন’ অভ্যন্তরীণ ইউনিয়ন গঠন করতে উত্সাহিত করে। এভাবে তারা নিশ্চিত করতে চায় যে ম্যানেজমেন্টের ইউনিয়নের কার্যক্রমের ওপর কিছু নিয়ন্ত্রণ আছে।
শ্যাম সুন্দর আন্তর্জাতিক শ্রম আইন মেনে চলার জন্য কম্পানিগুলোকে চাপ দেওয়ার জন্য বিশ্বব্যাপী শ্রম ইউনিয়নকে কাজে লাগানোর কথা বলেছেন।
সূত্র : বিবিসি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন