বড়দিনের আগের রাতে অর্থাৎ মঙ্গলবার রাতে বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নে ত্রিপুরাদের ১৭টি বসতি আগুনে পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতের গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমেও আলোচনা চলছে।
ইতোমধ্যে ওই ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এই ঘটনায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন চারজন।
এখন ঘটনার পেছনে ঠিক কী কারণ তা নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন উঠছে। উঠে আসছে জমি দখল এবং চাঁদাবাজির মত বিষয়।
তবে, সব ছাপিয়ে অভিযোগের আঙ্গুল উঠছে কথিত এক এসপি বাগানের দিকে, যার সাথে জড়িয়ে আছে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের নাম।
'গুরুতর মানবাধিকার লংঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার' অভিযোগে ২০২১ সালে বেনজীর আহমেদসহ র্যাবের এর ছয়জন কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।
কিন্তু এই ঘটনায় এসপি বাগান এবং বেনজীর আহমেদের নাম কেন আসছে?
কী হয়েছিল ত্রিপুরা পাড়ায়?
সাত-আট মাস আগে সরইয়ের আগুনে ভস্মীভূত টংগঝিরি পাড়াটি স্থাপন করা হয়েছিল।
রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়িতে বসবাসরত ত্রিপুরাদের বড় অংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী হলেও বান্দরবানের ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী সাধারণত খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সাংবাদিক সুফল চাকমা।
টংগঝিরির নতুন পাড়ায় কোনো গির্জা না থাকায় বড়দিন উদযাপনে একই এলাকার 'পুরনো পাড়ায়' যান বাসিন্দারা।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, মঙ্গলবার দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে ঘরগুলোতে আগুন দেয়া হয়।
বাসিন্দাদের অনেকের সন্দেহ এর পেছনে রয়েছে চাঁদাবাজিকেন্দ্রিক পূর্ব শত্রুতা।
মার্জেল ত্রিপুরা নামে একজন স্থানীয় বাসিন্দা বলছিলেন, কয়েকজন ব্যক্তি তাদের কাছে চাঁদা দাবি করেছিল কিছুদিন আগে। এদের নামে স্থানীয় থানায় অভিযোগও জানিয়েছিলেন।
এখন সেই ব্যক্তিদের সন্দেহ করছেন তারা।
"এর আগে হুমকি দিছে টাকা না পেলে ঘর পুড়ে দেবে," এমনটা জানিয়ে পাড়ার আরেক বাসিন্দা অরাতি ত্রিপুরার মন্তব্য, "যদি থাকতাম তাহলে আমরাও মরে যেতাম।"
পাড়া প্রধান পাইসাপ্রু ত্রিপুরা অভিযোগ করেছেন, "কয়েকজন পাহাড়ি ও বাঙালি একজোট হয়ে এর আগে অস্ত্র নিয়ে চাঁদাবাজি করতে এসেছিল। তারাই পাড়ার ১৯টি ঘরের মধ্যে ১৭টি জ্বালিয়ে দিয়েছে।"
ধর্মীয় উৎসবের আগে আগে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ঘর পোড়ানোর এই ঘটনায় চাঞ্চল্য তৈরি হয়।
বাগানের নাম এসপি বাগান কেন?
বান্দরবানের লামার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় উঠে আসছে 'এসপি বাগান' নামে একটি ফলের বাগানের নাম।
এই বাগানের জমি দখলকে কেন্দ্র করেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে সন্দেহ করছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ।
সরই ইউনিয়নের আট নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. জামাল উদ্দিন জানান, স্থানীয়ভাবে কথিত আছে, বাংলাদেশের সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের নাম করে কয়েক বছর আগে ওই বাগানটি গড়ে তোলা হয়।
কিন্তু বাগানটির নাম এসপি বাগান কেন?
এমন প্রশ্নের উত্তরেও মি. উদ্দিন টেনে আনলেন বেনজীর আহমেদের নাম।
বান্দরবানে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি আছে গত বছর এমন খবর প্রকাশের পর তৎকালীন উপজেলা প্রশাসনের নির্দেশে এসপি বাগানে খোঁজখবর নিতে যান মি. উদ্দিন।
"দেখভালের দায়িত্বে থাকা ইব্রাহিম, এটি বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি কী না সে ব্যাপারে কিছু জানেন না। তবে, কোনো এক জেলার এসপি তাকে নিয়োগ দিয়েছেন বলে জানান," বিবিসি বাংলাকে বলেন জামাল উদ্দিন।
তাই সেটি এসপি বাগান নামেই পরিচিতি পায়।
অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় যে মামলা হয়েছে তাতে তালিকাভুক্ত আসামি হিসেবে আরও তিনজনের সঙ্গে মি. ইব্রাহিমকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
বেনজীরের নাম কেন আসছে?
ছোটবেলা থেকেই টংগঝিরি এলাকার শেষপ্রান্তের ওই জমিতে ত্রিপুরাদেরই বসবাস করে আসতে দেখছেন স্থানীয় ইউপি মেম্বার জামাল উদ্দিন।
"১০ থেকে ১২ বছর আগে সেখানে বাগানটি গড়ে ওঠে। মূলত আমগাছ লাগানো হয়েছিল," বলছিলেন মি. উদ্দিন।
এটি বেনজীর আহমেদের বাগান বলে প্রচারণা ছিল স্থানীয়ভাবে। যে কারণে গত বছর মি. উদ্দিনকে ঘটনার সত্যতা খুঁজতে যেতে হয়েছিল। তিনি কেয়ারটেকারের বেনজীরের সম্পৃক্ততা আদৌ আছে কি না সে সম্পর্কে কোনো তথ্য পান নি।
এসপি বাগানের ওই জমিটি মূলত সরকারি খাস জমি, বলছিলেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা রুপায়ন দেব।
মি. দেব উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে নিযুক্ত।
"সরকারি খাস জমিতে ত্রিপুরারা চাষবাস করতেন। পরবর্তীতে দশ বছর ধরে এসপি বাগান নামে জায়গাগুলো দখল করে রাখছিল। কিন্তু, কাগজপত্র নাই। স্টিল এগুলো খাস জমি," বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
"সাত-আট মাস আগে বেনজীর আহমেদকে নিয়ে যখন খবরাখবর ছড়াতে থাকে তখন ওই কেয়ারটেকার এসপি বাগান ছেড়ে চলে যান। সেই সুযোগে ত্রিপুরা পরিবারগুলো জমির দখল নেয়ার পাল্টা চেষ্টা চালায় এবং ঘর তোলে," বলেন মি. দেব।
এই কর্মকর্তা জানান, তাদের ভিন্ন জায়গায় বাড়ি আছে। সেসব বাড়ি দেখে এসেছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, "মূলত দখলের জন্যই নতুন ঘরগুলো তোলা হয়েছিল"।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বেনজীর আহমেদ বা তার পরিবারের সম্পত্তি পাওয়া গেলেও লামা উপজেলায় তাদের নামে কোনো জমি নেই বলে বিবিসি বাংলাকে নিশ্চিত করেছেন ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুপায়ন দেব।
প্রসঙ্গত, দুর্নীতির অভিযোগে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে গত ১২ই জুন আদালতের পক্ষ থেকে নির্দেশ জারি করা হয়।
তার মধ্যে বান্দরবানের সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নে ২৫ একর জমি ছিল। আদালতের নির্দেশের পর ওই চৌঠা জুলাই ওই সম্পত্তি নিজেদের তত্ত্বাবধানে নেয় জেলা প্রশাসন।
আরও যা জানা যাচ্ছে
স্থানীয় বাসিন্দাদের সন্দেহের তালিকায় ঘুরে ফিরেই এসপি বাগানের সাথে সম্পৃক্ত দু'জন বাঙালি ও পাঁচ-ছয়জন ত্রিপুরার নাম উঠে আসছে।
সেসব নাম তারা গণমাধ্যমে বলেছেনও।
ঘর তৈরির সময় এবং বাঁশ ও গাছ বিক্রিকে কেন্দ্র করে কয়েকজনের সঙ্গে তাদের কিছু বিষয়ে বিবাদ দেখা দিয়েছিল গত কয়েক মাসে।
সরই ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, "আগুন কে দিছে, কারা দিছে এখনো পাচ্ছি না।"
১৯৯৬ সালে ওই জমি ইজারা পাওয়ার জন্য ত্রিপুরাদের আরেকটি পক্ষ জেলা পরিষদে আবেদন করেছিল বলে জানিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। কিন্তু, সেই আবেদন নিষ্পত্তি হয়নি।
অর্থাৎ, আগে থেকেই জমি নিয়ে একটি বিরোধ চলে আসছিল।
বৃহস্পতিবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যান বান্দরবানের জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার।
সেখান থেকেই বিবিসি বাংলাকে জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, মামলা হয়েছে এবং চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিটা আইনানুগভাবে দেখা হবে।
বেনজীর আহমেদ প্রসঙ্গে স্থানীয়দের কাছ থেকে তেমন কোনো কিছু শুনেছেন কি না বা কোনো অভিযোগ পেয়েছেন কি না জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, " না, আমরা দেখছি।"
ভুক্তভোগীদের জন্য কম্বলসহ সাময়িক সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
সরকারের প্রতিক্রিয়া
ত্রিপুরা পাড়ায় অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়।
বুধবার রাতে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করা এক বার্তায় বলা হয়, বান্দরবানের লামা উপজেলায় ত্রিপুরাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আমরা তীব্র নিন্দা জানাই।
"ঘটনাস্থলে কর্মকর্তাদের পাঠানোর কথা জানিয়েছে পুলিশ। অপরাধীদের গ্রেফতার করতে অভিযানও চালিয়েছে বলেও জানিয়েছে পুলিশ," বলা হয় বিবৃতিতে।
এদিকে, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা বৃহস্পতিবার বিকেলে বান্দরবানের লামায় অগ্নিসংযোগে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করবেন এবং সেখানকার ত্রিপুরা খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করবেন বলে মন্ত্রণালয়ের তরফে জানানো হয়।
আগুন দেওয়া ঘরগুলো ছিল অস্থায়ী 'টং' ছিল বলে দাবি করা হয় ওই বার্তায়।
বলা হয়, "প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের সদস্যদের দুটি গ্রুপের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে শত্রুতা চলছিল। এই শত্রুতার জেরে অগ্নিসংযোগ করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।"
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন