জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যার দুটি মামলায় সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন পুলিশের একজন তদন্ত কর্মকর্তা। শুধু তাই নয় অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসানকেও। তবে আদালতে ওঠার আগেই বিষয়টি ধরা পড়ে যায়। এখন আবার তদন্ত করা হচ্ছে। আর অব্যাহতি দেওয়ার চেষ্টায় জড়িত ওই তদন্ত কর্মকর্তা দাবি করেছেন, তিনি অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিনের নির্দেশে এই কাজ করেছিলেন। দৈনিক প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে এমনটাই বলা হয়েছে।
নথিপত্র ও পুলিশ সূত্র বলছে, ওই তদন্ত কর্মকর্তা তার ডিবির পরিচয় গোপন করে থানা–পুলিশের কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদনটি আদালতে জমার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি এ ক্ষেত্রে নিয়ম অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নেননি। বিষয়টি জানাজানির পর তিনি অসুস্থতার কথা বলে ছুটিতে চলে গেছেন।
জানা যায়, সবুজ মিয়া ও মো. শাহ-জাহান মিয়া হত্যা মামলায় আনিসুল হক ও সালমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ১৬ জুলাই ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় সবুজকে মারধর করে ও শাহ-জাহানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরের দিন নিউমার্কেট থানায় মামলা হয়। সবুজের চাচাতো ভাই মো. নুরনবী ও শাহ-জাহানের মা আয়শা বেগম মামলার বাদী হন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ১৩ আগস্ট আনিসুল ও সালমানকে আটক করে এই দুই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ১৬ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াকে।
মামলা দুটির তদন্ত করছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) রমনার পরিদর্শক মো. জাহাঙ্গীর আরিফ। তিনি গত ২৩ অক্টোবর দুই মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার চেষ্টা করেন। নথিতে দেখা যায়, চূড়ান্ত প্রতিবেদনে নিজেকে তিনি নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক পরিচয় দিয়েছেন। যদিও তিনি কর্মরত ডিবিতে।
অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, মামলা দুটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার চেষ্টার আগে তদন্ত কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আরিফ সাক্ষ্য–স্মারকলিপিতে (মেমো অব এভিডেন্স বা এমই) ডিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সই নেননি। তদন্ত–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, ডিবি থেকে কোনো মামলায় অভিযোগপত্র বা চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সাক্ষ্য–স্মারকলিপিতে তদন্ত–তদারক কর্মকর্তা সহকারী কমিশনার, অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রশাসন), উপকমিশনার এবং গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত কমিশনার ও ক্ষেত্রবিশেষ কমিশনারের সই লাগে। জাহাঙ্গীর আরিফ কর্মকর্তাদের সই নেওয়া এড়াতে নিজেকে নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক বলে উল্লেখ করেছেন।
এদিকে, ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর থেকে অসুস্থতা দেখিয়ে ছুটিতে রয়েছেন জাহাঙ্গীর আরিফ। বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে তাকে একাধিকবার ফোন করা হয়েছিল। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি। ডিবি সূত্র বলছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদে জাহাঙ্গীর আরিফ দাবি করেছেন, তিনি অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিনের (এখন এপিবিএনে কর্মরত) নির্দেশে কাজটি করেছেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে এডিসি সানজিদা মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, তিনি এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। এ রকম আলোচিত মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার সিদ্ধান্তের এখতিয়ার তার নেই।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে বারডেম হাসপাতাল থেকে তুলে নিয়ে শাহবাগ থানায় আটকে ছাত্রলীগের (বর্তমানে নিষিদ্ধঘোষিত) দুই কেন্দ্রীয় নেতা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে ব্যাপক মারধরের ঘটনায় আলোচনায় এসেছিলেন এডিসি সানজিদা।
ডিএমপি ও ডিবি সূত্র জানিয়েছে, মামলা থেকে আনিসুল ও সালমানকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া চেষ্টার ঘটনায় ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী এডিসি সানজিদার কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছিলেন। সানজিদা ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যা ডিএমপির কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি।
আনিসুল ও সালমানকে অব্যাহতির চেষ্টার ঘটনাটি জানার পরই জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কর্তৃপক্ষকে সুপারিশ করেছেন ডিবির দায়িত্বপ্রাপ্ত ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক। তিনি গত রবিবার বলেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে পরিদর্শক জাহাঙ্গীর আরিফকে রবিবার সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
অন্যদিকে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ডিবির রমনা অঞ্চলের পরিদর্শক মো. মনিরুল ইসলামকে। যদিও সম্প্রতি বিষয়টি জানাজানি হয়। মনিরুল জানিয়েছেন,তিনি তদন্ত করছেন এবং জড়িতদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন