ঋণ কেলেঙ্কারি, খেলাপি, মুদ্রা পাচারসহ নানা অনিয়মে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত প্রায় নড়বড়ে। এর মধ্যে ১০টির অবস্থা আরো নাজুক। অন্তর্বর্তী সরকার ব্যাংক খাতকে তুলে আনার চেষ্টা করলেও ১০ ব্যাংককে ডোবানোর নেপথ্যের নায়করা এখনো ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। গ্রাহকের আমানত লুটে নেওয়া ‘রুই-কাতলা’দের পাশাপাশি এই অপকর্মের সহযোগী এমডি, ডিএমডি, ঋণ বিভাগের পরিদর্শন কর্মকর্তা, শাখাপ্রধান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার রক্ষকরূপী ভক্ষকদের অনেকেই এখন জার্সি বদলে ফেলেছেন।
বাগাচ্ছেন পদোন্নতিও। অথচ ব্যাংকের দৈন্যদশার সুযোগে ব্যাবসায়িক সুফল চলে যাচ্ছে পার্শবর্তী দেশগুলোতে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র ও অনুসন্ধানে এসব তথ্য জানা গেছে। সম্প্রতি ব্যাংক খাতের অনিয়ম নিয়ে প্রতিবেদন দিয়েছে শ্বেতপত্র কমিটি।
তাদের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী গত ১৫ বছরে ২৪০ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে। কিন্তু যারা পাচার প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা দেখা যাচ্ছে না। শুধু আইএফআইসি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানকে গ্রেপ্তার করা ছাড়া বাকিরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। হদিস নেই এস আলম, নজরুল ইসলাম মজুমদার, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, আ হ ম মুস্তফা কামালদের।
এখনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক, উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সহকারী ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও জিএম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন ওই পাচারের সহযোগীরা। এমনকি ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হওয়ার সময় দায়িত্বরত সাবেক তিন গভর্নরের বিরুদ্ধেও কোনো আইনি পদক্ষেপ দেখা যায়নি।
নিম্নস্তরের কিছু কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানা যায়নি। গত ১৯ আগস্ট ইসলামী ব্যাংকের ২৫০ কর্মকর্তা ও ৩১ অক্টোবর সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৫৭৯ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ভুয়া কাগজপত্র ও নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযথভাবে পরিপালন না করার অভিযোগ ছিল।
১৮ নভেম্বর ২৬২ কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে ইউনিয়ন ব্যাংক। এ ছাড়া বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২১৯ কর্মকর্তার পদোন্নতি স্থগিত করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কারণ তাঁদের বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কাছে। যাঁরা বড় বড় ঋণ কেলেঙ্কারির মূল সুবিধাভোগী, তাঁদের তেমন কোনো শাস্তি দেওয়া হয়নি।
ব্যাংক খাত সংস্কারে গঠিত ব্যাংকিং টাস্কফোর্সের এক সদস্য জানান, ব্যাংক খাতে যা কিছুই হচ্ছে, তাতে ইমেজসংকট তৈরি হচ্ছে। বিদেশে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এর মাধ্যমে আমাদের দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। লাভবান হচ্ছে পার্শবর্তী দেশগুলো। আমরা আমদানিনির্ভরতা কমানোর চেষ্টায় আছি। আর একটি পক্ষ সব সময় দেশে অস্থিরতা তৈরি করতে প্রস্তুত।
এদিকে ব্যাংকে তারল্য সংকটের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ নানা মাধ্যমে অতিরঞ্জিত প্রচারের কারণেও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অপ্রয়োজনে টাকা তুলতে শুরু করে গ্রাহক। এতে নির্দিষ্ট কিছু ব্যাংক গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে না পারলেও তুলনামূলক ভালো ব্যাংকে আমানত বেড়েছে। অর্থাৎ আতঙ্কিত গ্রাহক এক ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য ব্যাংকে রেখেছে। ব্যাংকের স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য মিডিয়া ট্রায়াল নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে বলে মত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
এতে কারখানার মালিক যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, তেমনি দীর্ঘমেয়াদে দেশের রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। তথ্য বলছে, বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির জন্য গুরুত্বপূর্ণ যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ভাটা পড়েছে। তাই সবার আগে ষড়যন্ত্রকারী ও পাচারে সহযোগী কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব কারণে রপ্তানি কমছে যুক্তরাষ্ট্রে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত দেশটিতে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি কমেছে ৩.৩৩ শতাংশ। এর বিপরীতে ভারত, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া থেকে পোশাক আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। গত এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আগের বছরের তুলনায় ভারতের পোশাক রপ্তানি ৩৫ শতাংশ বেড়েছে।
এদিকে সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার ১০ ব্যাংকের ওপর গ্রাহকদের আস্থা কমে তলানিতে ঠেকেছে। চাহিদামতো আমানত ফেরত দিতে পারছে না ব্যাংকগুলো। ফলে অন্য ব্যাংক থেকে ধার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহযোগিতা নিতে হচ্ছে তাদের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংক খাতে তাণ্ডব চালিয়েছে এস আলমসহ একটি গোষ্ঠী। নিরাপত্তাব্যবস্থা না নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ১০টি দুর্বল ব্যাংক ঘোষণার পর থেকে অস্থিরতা আরো বেড়ে যায়।
৮ সেপ্টেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের ১০টি ব্যাংক দেউলিয়া অবস্থায় আছে বলে মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর। তবে দেউলিয়া পর্যায়ে থাকা ব্যাংকগুলোকে ঘুরে দাঁড়াতে বাংলাদেশ ব্যাংক টেকনিক্যাল, অ্যাডভাইজারি ও লিকিউডিটি সুবিধা দেবে বলেও জানিয়েছিলেন তিনি।
তারই অংশ হিসেবে গত এক মাসে মোট ছয় হাজার ৮৫০ কোটি টাকা দুর্বল ব্যাংকগুলোকে ধার দিয়েছে ১০টি তুলনামূলক সবল ব্যাংক। পাশাপাশি ২২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা ছাপিয়ে তারল্য সহায়তা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সংকট কাটাতে সব মিলিয়ে ২৯ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা সহায়তা পেয়েছে ব্যাংকগুলো।
ব্যাংক খাতের সংকট সৃষ্টির একটি চিত্র উঠে এসেছে শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনে বলা হয়, “রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ঋণ প্রদানের অনুশীলন ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীরতর করেছে। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, জালিয়াতি এবং নানা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে দেশের ব্যাংকিং খাত এখন ‘ব্ল্যাকহোলে’ পরিণত হয়েছে।”
এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম (স্বপন) বলেন, ‘বিভিন্ন কারণে আমানতকারীরা আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু আমরা তাঁদের আস্থা ফেরাতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছি। লাখ টাকার আমানত তুলতে এলে এখন কেউ ফেরত যাচ্ছে না। আশা করি আগামী জানুয়ারির মধ্যে কোটি টাকার আমানত ফেরত চাইলেও আমরা ফেরত দিতে পারব।’
আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বিএফআইইউয়ের একজন কর্মকর্তা জানান, শুধু ইসলামী ব্যাংকেই এস আলম গ্রুপের দেড় লাখ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত হয়েছে। কিন্তু ওই ব্যাংকের পুরো তদন্ত এখনো শেষ হয়নি। ইসলামী ব্যাংকসহ অন্য (সোস্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল, ন্যাশনাল প্রভৃতি) ব্যাংগুলোর মাধ্যমে এস আলম তিন লাখ কোটি টাকার বেশি পাচার করেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। শুধু এস আলম নয়; বেক্সিমকো, নাসা, জেমকন, সামিট, শিকদার গ্রুপসহ আরো কিছু ব্যবসায়ী গ্রুপের অর্থপাচার শনাক্ত ও টাকা ফেরত আনতে কাজ করছে সরকার। ব্যাংকগুলোতে চলমান নিরীক্ষা কাজ শেষ হলে প্রকৃত তথ্য জানা যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ব্যাংকগুলোতে অডিট চলছে। তবে অডিটের বিষয়গুলো আমরা এখনই প্রকাশ করতে পারছি না। গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষায় আমরা সব কিছু করছি।
ব্যাংকিং খাত সংস্কারের লক্ষ্যে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। টাস্কফোর্সের একজন সদস্য বলেন, ‘জানুয়ারিতে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলোয় ফরেনসিক অডিট করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটা স্পেশালাইজ একটা অডিট হবে, যেখানে শুধু ব্যাংকের ঋণ-সম্পদ নয়, তাদের অদৃশ্য সম্পদেরও মান যাচাইয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে।’
দুর্বল ব্যাংকের ঘুরে দাঁড়ানোর বিষয়ে জ্যেষ্ঠ ব্যাংকার ও অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার বলেন, ‘দুর্নীতির কবলে পড়ে যেসব ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে যে ব্যাংকের ওপর গ্রাহকের আস্থা যত তাড়াতাড়ি ফিরবে, সে ব্যাংক তত তাড়াতাড়ি ঘুরে দাঁড়াবে। তবে কোনো দুর্বল ব্যাংক সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশে ঘুরে দাঁড়ানোর উদাহরণ বিরল। এর জ্বলন্ত প্রমাণ আমাদের সামনে পদ্মা, বিডিবিএল, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক।’
রাজনৈতিক ঝুঁকি বেড়ে যাওয়া ও প্রবৃদ্ধি সম্ভাবনা কমে যাওয়ায় কমে গেছে বাংলাদেশের ঋণমান। সম্প্রতি প্রকাশিত এক রেটিংস প্রতিবেদন এই তথ্য জানিয়েছে ঋণমান যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান মুডিস। এই ক্রেডিট রেটিং কমানোর অর্থ হলো—দেশের ব্যাংকিং খাত আরো দুর্বল হওয়া। যার ফলে দেশের অর্থনৈতিক পরিবেশ আরো কঠিন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় আছে এবং এর ফলে বিনিয়োগকারীদের জন্য ঝুঁকি আরো বেড়ে যায়।
বিডি প্রতিদিন
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন