পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সংস্কার তখনই টেকসই হবে, যখন তারা ‘না’ বলা শিখবে। তাদের মধ্যে এমন মনোভাব তৈরি করতে হবে—যে পর্যায় থেকেই কোনো অবৈধ আদেশ আসুক না কেন, তা মানা যাবে না। শুরুতে এই কাজ হয়তো সহজ হবে না। তবে আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সমুন্নত রাখতে এর বিকল্প নেই। সাম্য ও ন্যায়ের দেশ গড়তে এসবের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সদিচ্ছা লাগবে।
আজ শনিবার সকালে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ: আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গ’ শীর্ষক এক সংলাপে বক্তারা এসব কথা বলেন। সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এই সংলাপের আয়োজন করে।
সংলাপে আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসন আমলে গুম, খুন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের প্রসঙ্গ উঠে আসে। জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুত্থানে পুলিশ ও জনগণের মধ্যে যে দূরত্ব ও ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা নিরসনে করণীয় তুলে ধরেন বক্তারা। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কমানোর দাবি ওঠে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এমন সংকট এড়ানোর উপায় ও বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন বক্তারা।
সংলাপে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেশের উন্নয়ন ও জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সম্পৃক্ত। এ জন্য শুধু পুলিশ নয়, সার্বিকভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে কীভাবে ঠিক করা যায়, তার ওপর নজর দিতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সংস্কারের উদ্যোগ কাজে আসবে না। পাশাপাশি পুলিশকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
সংস্কারের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে যুক্ত করতে হবে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া সংস্কারের উদ্যোগ কাজে আসবে না। পাশাপাশি পুলিশকে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।
—মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান, সভাপতি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এম এনামুল হক বলেন, রাজনৈতিক নেতার আদেশের বিরুদ্ধে ‘না’ বলার সাহস থাকতে হবে। কোনো কিছু বিবেকে বাধলে, অন্যায় হলে সাহসের সঙ্গে ‘না’ বলুন। এই সাহস ছাড়া কোনো কিছু হবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের মধ্যে এখনো অনেকে ভালো আছেন। এই ভালোদের কাজে লাগাতে হবে।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা জহির উদ্দিন স্বপন বলেন, ‘দলগত বা যৌথভাবে যদি আমরা রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পাই, তখন সংস্কারের আলোচনাগুলো আমাদের কাজে লাগবে। জুলাইয়ের আন্দোলনের পর পুরো জাতির মনোজগতে যে পরিবর্তন এসেছে, তা অত্যন্ত ইতিবাচক। পুলিশি সেবা নাকি পুলিশের নিয়ন্ত্রণ—এই অবস্থায় এটা আমাদের মীমাংসা করতে হবে। পুলিশ যে সেবা, সেটা রাজনৈতিক দলগুলোকেও বুঝতে হবে। পুলিশের ওপর নিয়ন্ত্রণ কমাতে হবে।’
অতিরিক্ত বল প্রয়োগ যেন কেউ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, যে ‘রেজিম’ ছিল, তা বিদায় হতোই। এখন প্রশ্ন হলো, এরপরও কেন পুলিশ এমন ব্যবহার করেছে? পুলিশকে আমরা হেনস্তাকারী সংস্থা হিসেবে তৈরি করেছি। তিনি বলেন, পুলিশের যারা অতি উৎসাহী ছিল, তাদের বিচার হতে হবে। তবে শুধু পুলিশই নয়, সবারই বিচার হতে হবে। ক্ষমা শুধু পুলিশ কেন, সবারই চাইতে হবে। যারা নির্দেশ দিয়েছে ও অর্থনীতি ধ্বংস করেছে, তাদেরও ক্ষমা চাইতে হবে ও বিচারের আওতায় আনতে হবে।
সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সভাপতি এ কে আজাদ বলেন, চুয়াত্তরে যাঁরা বাম দল করতেন, জাসদের গণবাহিনী করতেন, তাঁদেরকে ধরে ধরে নিয়ে রক্ষীবাহিনী বেয়নেট দিয়ে হত্যা করত। সিরাজ শিকাদরকে চট্টগ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। এরপর সাভারে তাঁকে নির্যাতন করে মেরে বলা হয়, পুলিশের গাড়ি থেকে পালানোর সময় গুলিতে তিনি মারা গেছেন। দুঃখজনকভাবে তার কোনো বিচার হয়নি। চুয়াত্তরে বিচার হলে পরে যাঁরা সরকারে এসেছেন, এরপর যেসব গণহত্যা হয়েছে, রাতের আঁধারে গুম হয়েছে, এগুলো হতো না। ১৪ বছরে যেসব গুম হয়েছে, তা রোমহর্ষ ঘটনা। নারায়ণগঞ্জ থেকে আমার এক বন্ধুকে র্যাব তুলে নিয়ে হত্যা করেছে, পরে তার লাশও পাওয়া যায়নি। এমন শত শত ঘটনার কথা বেরিয়ে আসছে।
এ কে আজাদ বলেন, যে অভ্যুত্থান হয়েছে, সেটা রাতারাতি হয়নি। দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে এটা হয়েছে। ’৫২ থেকে এই পর্যন্ত পুলিশের তুলনা করে দেখেন তার উন্নতি হয়েছে নাকি অবনতি? পুলিশকে এই পর্যায়ে কে নিয়ে গেল? এগুলো রাজনৈতিক দলগুলো করে থাকে। এ সময় তিনি র্যাব বিলুপ্ত করে তাদের বরাদ্দ পুলিশকে দেওয়ার দাবি জানান।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের চেয়ার মুনিরা খান বলেন, ‘আমার জন্ম ব্রিটিশ আমলে। তখন থেকেই দেখেছি পুলিশ দিয়ে নির্যাতন করানো হয়েছে। পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। যারা অন্যায় করেছে, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। মানুষকে দেখাতে হবে যে বিচারটা হয়েছে।’
বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির সভাপতি ব্যারিস্টার আন্দালিভ রহমান পার্থ বলেন, ‘সব সংস্কারের মূল কথা হলো রাজনীতিবিদেরা ভালো না হলে কোনো কিছুই কাজে আসবে না। আমাদের দেশে একজন ভালো রাজনীতিবিদ দরকার। ভালো মানুষদের সংসদে আসতে হবে, দেশ শাসনে আসতে হবে। খারাপ ভোটার খারাপ মানুষদের ক্ষমতায় আনবে। আর খারাপ মানুষেরা সব ধ্বংস করে দেয়।’
সিজিএসের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের ধারায় ফিরিয়ে আনতে হবে। এখানে সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো সুশাসনের অভাব। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সাধারণ জনগণ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ব্যবসায়ীরা নিরাপদে ব্যবসা করতে পারছেন না, পুলিশ মনোবল হারিয়ে ফেলেছে এবং প্রতিনিয়ত মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক চর্চা ও বিকাশের মনোভাব আনতে হবে উল্লেখ করে গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক বলেন, পুলিশকে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। এটি প্রতিরোধ করার জন্য মানবাধিকার সনদ মানতে হবে। পুলিশের কাঠামো ঠিক করতে হবে। পাশাপাশি রাজনীতির সংস্কার করতে হবে। রাষ্ট্রব্যবস্থায় যে পচন ধরেছে, তার সংস্কার করতে হবে।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসিরুদ্দিন এলান বলেন, পুলিশ গত ১৫ বছর অনেক নিয়ম লঙ্ঘন করেছে। তারা দায়মুক্ত ছিল, যা বিগত সরকার দিয়েছে। এ জন্য জুলাই-আগস্টের পর পুলিশের মনোবল কমে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যে সংস্কারের দিকে যেতে চাচ্ছি, সেদিকে যেতে পারছি না। এরপর যে সরকার আসবে, তারা যদি সংস্কার করতে না পারে, তাহলে আমরা আবার ফ্যাসিজম দেখতে পাব।’
এবি পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ বলেন, রাজনৈতিক দল তার নেতা–কর্মীদের প্রজা, কর্মচারী বা চাকরবাকর মনে করে। কোনো ব্যক্তি তার নেতার সামনে কথা বলে না, সমালোচনা করে না। দলের অভ্যন্তরীণ সংস্কারের বিষয়ে কথা নেই।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম বলেন, রাজনৈতিক নেতারা নিজের দলকে বাইরের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করে থাকে। পুলিশের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ থামা উচিত।
সাবেক সংসদ সদস্য উষাতন তালুকদার বলেন, পুলিশ নিয়োগের ক্ষেত্রে তার দলীয় পরিচয় দেখা যাবে না। যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে। যাঁরা ক্যাডার হন, তাঁরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যান, তাঁদের অনেকের পা যেন মাটিতে পড়ে না। তিনি আরও বলেন, সেনাবাহিনী থেকে র্যাবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। পুলিশের বেতন–ভাতা বাড়ানো নিয়ে চিন্তা করতে হবে। পার্বত্য অঞ্চলে পুলিশের ক্ষমতা জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর করতে হবে। এ সময় তিনি গায়েবি মামলার বিষয়ে সরকারকে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান।
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, ‘রাষ্ট্র পুনর্গঠনের আলোচনার আগে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা তা গঠন করতে পেরেছি কি না। গত ৫৪ বছরে আমরা রাষ্ট্র গঠন করতে পারিনি।’ তিনি বলেন, গত চার মাসে কি খুব পরিবর্তন হয়েছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখনো কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে? যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর বিচার হতে হবে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী রাশনা ইমাম বলেন, আইনের সঠিক প্রয়োগ হলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নেই। বিচার বিভাগে রিট করা হয় যে পুলিশ যেন ছাত্রদের ওপর আক্রমণ না করে। কিন্তু পরে তা খারিজ করে দেওয়া হয়। তখন মারাত্মকভাবে গুলি করা হচ্ছিল।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য (শিক্ষার্থী প্রতিনিধি) মো. জারিফ রহমান বলেন, জুলাই-আগস্ট গণ–অভ্যুথানে পুলিশ ও জনগণের মধ্যে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। পুলিশ তার ভুল স্বীকার করেছে। কিন্তু দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। পুলিশের জন্য কমিশন করলে সেখানে এমন মানুষ থাকতে হবে, যারা চাপিয়ে দেওয়া নির্দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাবেক জজ, কলামিস্ট ও আইনি পরামর্শদাতা ইকতেদার আহমেদ, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) গবেষণা ফেলো সাফকাত মুনির, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মাহবুবুর রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রভাষক সাইমি ওয়াদুদ, সংলাপের শিক্ষার্থী প্রতিনিধি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের কাজী রাকিব হোসেন ও রেজওয়ানা রশীদ।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন