জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের ইতিহাসের এক বাঁকবদলের গর্বিত অধ্যায়। দেশের মানুষ আবারও একত্রিত হয়ে, রক্ত দিয়ে হাসিনাশাহীর পতন ঘটিয়েছে। হাজার হাজার মানুষের জীবনের বিনিময়ে দেশ স্বৈরাচার মুক্ত হয়েছে, যেই স্বৈরাচার তার শেষসময়েও দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছে।
নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে গড়া সেই আন্দোলনে ভূমিকা রাখারা নানারকম উদ্যোগ নিয়েছে। তার একটি জাতীয় নাগরিক কমিটি। নানামতের, বিশ্বাসের মানুষেরা এক হয়ে নতুন রকম রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ গঠনের চেষ্টা করছে। স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা, যেকোনো প্রকারে ক্ষমতা ধরে রেখে জনগণকে শোষণ ও লুটপাট চালানোর ফলে প্রবল অবিশ্বাসের জন্ম হয়েছে। এর ফলে জনগণ নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখছে। কিন্তু, ঘরে পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাওয়ার মতো, সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ড আশঙ্কারও জন্ম দিয়েছে। বাংলাদেশে এই ধরনের উদ্যোগ নেওয়ার, একসময়ে আন্দোলনের নায়কেরা পরবর্তীকালে খুনেদের সাথে, লুটেরাদের সাথে হাত মিলিয়েছে এর উদাহরণ অনেক আছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি নিয়েও এমন আশঙ্কার জন্ম হয়েছে। সম্প্রতি একটি অনুষ্ঠানে জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে সারা দেশের সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার অপসারিত কাউন্সিলরদের ‘সর্বোচ্চ সহযোগিতা’চেয়েছেন।
ছাত্র-গণহত্যা ও বৈষম্যবিরোধী সিটি ও পৌর কাউন্সিলরদের জনস্বার্থে পুনর্বহালের দাবিতে ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতা করার লক্ষ্যে’ গত বুধবার ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সমাবেশ হয়। এই সমাবেশের আয়োজক ছিল বাংলাদেশ সিটি ও পৌর কাউন্সিলর অ্যাসোসিয়েশন।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, ‘জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক দল আসছে, সেই দলে আমরা আপনাদের সর্বোচ্চ সহযোগিতা কামনা করছি। আমরা আশা করি, সেই রাজনৈতিক দলে আপনাদের এই ত্যাগ-তিতিক্ষা আমরা মূল্যায়ন করব। জনতা এবং মানুষের মধ্যে যে ভ্রাতৃপ্রতিম সম্পর্ক, সেখানে আমরা আপনাদের পাশে পাব আশা করি। এই কমিটমেন্টের (অঙ্গীকার) মধ্যে যেতে পারলে বাংলাদেশে একটি শক্তিশালী দল আমরা উপহার দিতে পারব।’
অন্যদিকে সমাবেশে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম বলেন, ‘জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে যাঁরা কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবেই থাকুক।‘ জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে পরিচিতি পাওয়া সারজিসের এই বক্তব্যর সঙ্গে সংহতি জানান কাউন্সিলররা।
গত ২৬ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার দেশের ১২ সিটি করপোরেশন ও ৩৩২টি পৌরসভার কাউন্সিলরদের অপসারণ করেছিল। গত বুধবার প্রেসক্লাবের সমাবেশ থেকে নিজেদের পুনর্বহালের দাবি জানিয়ে কাউন্সিলররা বলেন, ‘আমরা এই সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই। আপনাদের সব দাবির সঙ্গে আমরা একাত্মতা ঘোষণা করব।’
কিন্তু, এই ধরনের ঘোষণা জুলাই আন্দোলনের পিঠে ছুরি মারা বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। বিগত ১৫ বছর দেশের মানুষ ভোটাধিকার হারিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জাতীয় পর্যায় থেকে একেবারে নিম্নস্তর পর্যন্ত এমনভাবে ভোটচুরি করেছিল যে তাতে জনতার রায় প্রতিফলিত হয়নি। ফলে, যেসব কাউন্সিলরদের জনপ্রতিনিধি বলা হচ্ছে, তাঁরা আসলে অবৈধ নির্বাচনের সুবিধাভোগী।
এই কারণে, কোনোভাবেই এদের পুনর্বাসন করা যাবে না। জনপ্রতিনিধি না থাকায় প্রশাসনিকসহ নানা ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কার্যক্রম পরিচালনা করতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু, তার মানে এই নয় যে, এই কারণে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসন করতে হবে, যাদের অনেকের বিরুদ্ধে সরাসরি হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ আছে। যদি জনপ্রতিনিধি বসাতেই হয় তবে সুষ্ঠু ও নতুন নির্বাচনের মাধ্যমেই তা করতে হবে।
রাজনৈতিক দল গঠন একটি দীর্ঘ ও আয়াসসাধ্য প্রক্রিয়া। দারুণ একটি গণ-আন্দোলনের ফলে যেই নতুন আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে তার পাটাতনে দাঁড়িয়েও এই কাজটি করা সহজ নয়। কিন্তু, সেই কাজ করতে গিয়ে যদি নির্বাচন পিছিয়ে দেওয়া হয় আর পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের সঙ্গী করা হয়, তবে তা কেবল অন্যায় নয়, জুলাই আন্দোলনের সঙ্গে বেইমানি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন