ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর মধ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) বাদ দিয়ে সংসদ নির্বাচন পুরোটা ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণের ঘোষণা দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে গত বুধবার বিজি প্রেস পরিদর্শন করেছেন নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তারা।
আগামী ২ জানুয়ারি ভোটার তালিকার খসড়া এবং ২ মার্চ চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশের ঘোষণাও দিয়েছে সাংবিধানিক এ সংস্থটি। নির্ভুলভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও দিয়েছে ইসি। গত বুধবার দেশের ১০ অঞ্চল ও জেলার নির্বাচন কর্মকর্তাদের সঙ্গে অনলাইন বৈঠকে এসব নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ও নতুন দলের নিবন্ধন দেওয়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। জানা যায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আইন-বিধি সংস্কার, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হচ্ছে। চলছে নির্বাচনের বাজেট প্রস্তুত করার কাজ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দীন বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরোপুরি প্রস্তুত। ইভিএমে নয়, ব্যালট পেপারে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বর্তমান নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম দিন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে। সুন্দরভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করার জন্য যা যা প্রস্তুতি দরকার তারা তা এগিয়ে নিচ্ছেন। সিইসি আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচনের যে সময় ইঙ্গিত করেছেন, সে অনুযায়ী নির্বাচন করতে আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। সংসদীয় আসনের সীমানা পুনঃনির্ধারণ সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, সীমানা পুনঃনির্ধারণ হবে ন্যায্যতার ভিত্তিতে। অতীতের সীমানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে যদি কোনো অনিয়ম হয় কোনো প্রার্থীকে জেতানোর জন্য বা কাউকে হারানোর জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো সীমানা পুনঃনির্ধারণ হয়ে থাকে, আমরা সেটা অবশ্যই দেখব। সংসদ নির্বাচন বিদ্যমান ভোটার তালিকায় হবে, নাকি নতুন ভোটার তালিকায় করবেন- জানতে চাইলে সিইসি বলেন, দুই মাস পর আমাদের হাতে একটি নতুন চূড়ান্ত ভোটার তালিকা আসবে। এরপর আমরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করব। অনেকে মারা গেছেন, অনেকে বাদ পড়েছেন। অনেক বিদেশি ভোটার হয়েছেন। ডুপ্লিকেশনও হয়েছে। এমন তথ্য আমরা পাচ্ছি। এগুলো যাচাইবাছাই করে আমরা ওই তালিকা সংশোধন করব। ওই সংশোধিত তালিকার আলোকেই ভোট হবে।
যেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসি : নতুন নির্বাচন কমিশন দায়িত্বগ্রহণ করেই নীরবে নির্বাচনের প্রস্তুতিমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। এ জন্য নির্বাচন কমিশনারদের নিয়ে বিভিন্ন কমিটি করে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আইন ও বিধিমালা সংস্কার কমিটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার আবদুর রহমানেল মাছউদ; সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নির্বাচন প্রস্তুতি, ভোট কেন্দ্র স্থাপন, ভোটগ্রহণকারী কর্মকর্তাদের প্যানেল প্রস্তুত ও তদারকি কমিটির প্রধান আনোয়ারুল ইসলাম সরকার; প্রশাসনিক সংস্কার এবং পুনর্বিন্যাস ও দক্ষতা উন্নয়ন সংক্রান্ত কমিটির প্রধান তাহমিদা আহমদ এবং জাতীয় পরিচয়পত্র, ভোটার তালিকা, নির্বাচন ব্যবস্থাপনা তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগ কমিটির প্রধান আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। কমিটির প্রধানরা ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের কাজে একটা গতিশীলতা এসেছে।
ইসি সূত্র জানিয়েছে, জানুয়ারির মধ্যে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রতিবেদন দেখে নির্বাচনি সংস্কারের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে নির্বাচন কমিশন। সংবিধান এবং নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন ও সুপারিশ দেখেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনি রোডম্যাপ চূড়ান্ত করবে সংস্থাটি। জানা যায়, নির্বাচনি সংস্কারের জন্য গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশসহ (আরপিও) অন্যান্য নির্বাচন আইনকানুন সংশোধন করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। সে মোতাবেক ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে নির্বাচনি আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে সংশ্লিষ্ট কমিটি। বিশেষ করে ভোটার তালিকা হালনাগাদের বিষয়ে ইতোমধ্যে চিঠি ইস্যু করেছে নির্বাচন কমিশন। গত রবিবার নির্বাচন কমিশন সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ-সংক্রান্ত বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বৈঠক করেছে। ইসির সূত্রমতে, সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মালামাল সংগ্রহের বিষয়ে কাজ চলছে। নির্বাচনের ব্যালট পেপারের কাগজসহ প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটার পরিকল্পনা প্রায় প্রস্তুত। রাষ্ট্রায়ত্ত কর্ণফুলী পেপার মিলের (কেপিএম) কাছে কাগজ প্রস্তুত রাখতে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি। তবে নির্বাচনের ব্যালট পেপারের কাগজ কেনার পাশাপাশি অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনাকাটার কার্যক্রমও শুরু হবে রোডম্যাপ চূড়ান্ত হলে।
ইভিএমের কী হবে? : ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে দেড় লাখ ইভিএম কেনা হলেও মাত্র ৬টি আসনে তা ব্যবহার করা হয়। এরপরে কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন স্থানীয় সরকারের সিংহভাগ নির্বাচন আয়োজন করে ইভিএমে। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অন্তত দেড় শ আসনে ইভিএমে ভোট করার পরিকল্পনা ছিল। তবে কভিড-পরবর্তী সময়ে আর্থিক সংকটের মধ্যে আরও ২ লাখ নতুন ইভিএম কেনার প্রস্তাবে সরকার সায় দেয়নি। ফলে দ্বাদশ সংসদে ইভিএম ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকে সরে আসে ইসি। এ ছাড়া দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে প্রায় প্রতিটি ইভিএম সেটেই কোনো না কোনো সমস্যা দেখা দেয়। বর্তমানে অধিকাংশ মেশিনেই সমস্যা দেখা দিয়েছে। ফলে আগামীতে ইভিএমগুলোর কী হবে তা বলতে পারছে না কেউ। এদিকে ওয়্যারহাউস না থাকায় সংরক্ষণের জটিলতায় ইভিএম অনেকটাই গলার কাঁটা হয়েছে নির্বাচন কমিশনের জন্য। এখনো ইভিএম সংরক্ষণে কোনো ওয়্যারহাউস নির্মাণ বা ভূমি অধিগ্রহণ করতে পারেনি ইসি। ফলে মাঠপর্যায়ে সংরক্ষিত ইভিএমগুলো নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ অবস্থায় ১০টি অঞ্চলে ইভিএম সংরক্ষণের জন্য ওয়্যারহাউস তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন ইসির সাবেক সচিবরা। তবে সম্প্রতি ইসির সমন্বয় সভায় জানানো হয়, ওয়্যারহাউস নির্মাণের জন্য আঞ্চলিক ও জেলা পর্যায়ের খাস জমির পাশাপাশি সরকারি অন্যান্য সংস্থার জমি দেখে উপযুক্ত ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ জমি অধিগ্রহণের ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম চলমান। এ বিষয়ে ইসির সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ বলেন, আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তাদের ওয়্যারহাউস নির্মাণের জমি অধিগ্রহণের কার্যক্রমের পাশাপাশি বিদ্যমান ভবনগুলো সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ বিষয়ে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের প্রতিবেদন চলতি মাসের মধ্যে কমিশনে জমা দিতে বলা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন