২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে নির্মম নির্যাতন এবং গুম-গণহত্যা চালানোর কাণ্ডে ফেঁসে যাচ্ছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন শতাধিক কর্মকর্তা। ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউটে’র নাম দিয়ে মধ্যরাতে সড়কের আলো নিভিয়ে অন্ধকারে হত্যার পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নকারীদের বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে। তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ থেকে শুরু করে থানার ওসি পর্যন্ত কর্মকর্তাদের তালিকা করা হচ্ছে। ২০১৩ সালের ৫-৬ মে ডিএমপির মোতায়েনকৃত ফোর্সের অবস্থান, শাপলা চত্বরে অভিযান পরিকল্পনার সত্যায়িত কপি এবং কর্মকর্তাদের তথ্য চেয়ে বর্তমান ডিএমপি কমিশনারকে চিঠি দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। ট্রাইব্যুনালের চাহিদা অনুযায়ী তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে ডিএমপি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের আওতায় আনতে তালিকা তৈরির কাজ শুরু করেছে তদন্ত সংস্থাটি। ব্ল্যাক আউট করে ‘অপারেশন ফ্ল্যাশ আউটে’র গণহত্যায় পুলিশের কার কার নির্দেশে গুলি করা হয়েছিল, কারা কত গুলি করেছিল, মাঠ পুলিশের কোন কোন সদস্য আন্দোলন দমনে অংশ নিয়েছিল তার বিস্তারিত তথ্য জানতে তদন্তকাজ শুরু করেছে অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর অপরাধের মাত্রানুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের দপ্তর সম্পাদক মাওলানা আফসার মাহমুদ গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, শাপলা চত্বরে যে গণহত্যা চালানো হয়েছে, দেশের নাগরিক হিসেবে এটার বিচার পাওয়া আমাদের অধিকার। আমরা এতদিন মজলুম ছিলাম। আমাদের ওপর হওয়া জুলুমের ইনসাফভিত্তিক বিচার চাই। আমরা শহীদদের তালিকা নতুন করে করতে শুরু করেছি। দ্রুতই এটি সম্পন্ন হবে। শাপলা চত্বরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর
পর আমাদের কান্নারও উপায় ছিল না। তিনি এও বলেন, বিচারের উদ্যোগের কারণে কেউ যেন জুলুমের শিকার না হন, সেটিও লক্ষ রাখতে হবে।
গত ১৪ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ডিএমপি বরাবর পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, হেফাজতে ইসলাম আয়োজিত সমাবেশে সাবেক সরকারের বিভিন্ন বাহিনী, আওয়ামী লীগ ও দলীয় সশস্ত্র ব্যক্তিরা পরিকল্পিতভাবে শাপলা চত্বর, মতিঝিল ও এর আশপাশের এলাকা বৈদু্যুতিক ‘ব্ল্যাক আউট’ করে নেতাকর্মীদের ওপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। নেতাকর্মীদের ওপর বিভিন্ন বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যা, গণহত্যা ও গুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে তদন্তে প্রকাশ পায়। গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে মর্মে প্রাপ্ত অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল অ্যাক্ট ১৯৭৩ মূলে অত্র সংস্থায় তদন্তাধীন রয়েছে।
গত ৮ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সহকারী পরিচালক ও তদন্তকারী কর্মকর্তা ফতেহ মো. ইফতেখারুল আলম স্বাক্ষরিত চিঠিতে ডিএমপির কাছে ট্রাইব্যুনালে রুজুকৃত মামলাটি সুষ্ঠু ও যথাযথ তদন্তের স্বার্থে দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাদের নাম, বিপি নম্বর, পদবি, স্থায়ী ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া আরও চাওয়া হয়েছেÑ নিরাপত্তা ডিউটির জন্য প্রস্তুতকৃত নিরাপত্তা পরিকল্পনার সত্যায়িত কপি; দৈনিক বাংলা, শাহবাগে নিরাপত্তা ডিউটিতে ব্যবহৃত এপিসি এবং কমান্ড ভেহিক্যালের তথ্য, এপিসি ও কমান্ড ভেহিক্যাল চালকদের নাম, বিপি নম্বর, পদবি, স্থায়ী ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর; অপারেশন ফ্ল্যাশ আউট পরিচালনাকালে ব্যবহৃত এপিসি, কমান্ড ভেহিক্যাল ও রায়ট কার এবং এগুলোর চালকের নাম, বিপি নম্বর, পদবি, স্থায়ী ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর; শাপলা চত্বরে নিরাপত্তা ডিউটিতে এবং অপারেশন ফ্ল্যাশ আউটে ব্যবহারের জন্য ইস্যুকৃত অস্ত্রের ধরন এবং ব্যবহৃত গুলি ও অন্যান্য গোলাবারুদের হিসাব বা পরিমাণ। এ ছাড়া হেফাজতের ঘটনায় রুজু হওয়া মামলার এফআইআর, পুলিশ রিপোর্ট ও গুলিবর্ষণের ঘটনায় কোনো প্রশাসনিক তদন্ত হয়ে থাকলে তদন্তের প্রতিবেদনের সত্যায়িত কপিও দিতে বলা হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালের পক্ষ থেকে মতিঝিলের আশপাশের ৮টি স্থানে ডিউটিতে থাকা কমান্ড সার্টিফিকেট (সিসি) চাওয়া হয়েছে। স্থানগুলো হলোÑ পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, বায়তুল মোকাররম উত্তর গেট, ইউবিএল ক্রসিং, বঙ্গভবন শাওয়ার পয়েন্ট, পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন স্ট্যান্ডবাই।
হেফাজতের বিরুদ্ধে অপারেশনের সময় দায়িত্বে থাকা ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার বেনজীর আহমেদসহ শতাধিক পুলিশ কর্মকর্তার নাম, ঠিকানা, বিপি নম্বর ও পরিচয় জানতে চেয়েছে অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে দায়িত্বে থাকা তৎকালীন ১০ জন পুলিশ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তারা হলেন- ডিএমপির তৎকালীন মতিঝিল বিভাগের এডিসি এস এম মেহেদী হাসান ও মো. আসাদুজ্জামান, ট্রাফিক পূর্ব বিভাগের এডিসি মাইনুল হাসান, রমনা বিভাগের এডিসি মনজুর রহমান ও আনোয়ার হোসেন, ডিসি খান মুহাম্মদ রেজোয়ান, লালবাগ বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ, ডিবি পশ্চিমের এডিসি মশিউর রহমান ও ডিবি দক্ষিণের কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন খান। এ ছাড়া তৎকালীন দায়িত্বে থাকা ডিএমপির সব অতিরিক্ত কমিশনার, যুগ্ম কমিশনার, ডিবির উপকমিশনার, ডিএমপির মতিঝিল, রমনা ও ওয়ারী বিভাগের ডিসিসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার থানার ওসি, এসি, এডিসিসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
ডিএমপির একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ডিএমপিতে দায়িত্ব পালন করা কর্মকর্তাদের বিষয়ে তথ্য উপাত্ত চাওয়া হয়েছে। তথ্য সংগ্রহের কাজ শেষ হলে ডিএমপি সদরদপ্তরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চাহিদানুযায়ী তথ্য পাঠানো হবে।
২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে ডিএমপির দায়িত্বে থাকা একাধিক কর্মকর্তা আমাদের সময়কে বলেন, হেফাজতে ইসলামকে শাপলা চত্বর থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক। বিশেষ করে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ ও র্যাব কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান অভিযানের নেতৃত্ব দেন। তখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা মাঠে ছিলেন, তারা যেভাবে নির্দেশনা দিয়েছেন সেভাবে মাঠে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তাদের অনেকেই পালিয়ে গেছেন। কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়েছেন।
এদিকে শাপলা চত্বরে গণহত্যার অভিযোগে গত ১৮ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী যে মামলা করেছিলেন, তাতে রাজনৈতিক নেতা ছাড়াও তৎকালীন পুলিশ কর্মকর্তাদের আসামি করা হয়। মামলার আসামি পুলিশ কর্মকর্তারা হলেনÑ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, হাসান মাহমুদ খন্দকার, এ কে এম শহীদুল হক, এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার, মতিঝিল থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওমর ফারুক, মতিঝিল জোনের সাবেক উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম, মতিঝিল জোনের সাবেক উপকমিশনার আশরাফুজ্জামান ও ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) জিয়াউল আহসান।
জানা গেছে, পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে গুমের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৪ কর্মকর্তার পাসপোর্ট স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকর্তার একটি বড় অংশ শাপলা চত্বরে হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন