অর্থপাচারের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি নতুন তথ্য দেওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক খাতের গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) অর্থপাচার ঠেকাতে কেন বাধা দেয়নি।
বিদেশে অবৈধভাবে টাকা পাঠানো প্রতিরোধে আইন ও বিধিমালা থাকার পরও ব্যাংক খাতের মাধ্যমে অর্থপাচার দিন দিন বেড়েছে; যার দায় আর্থিক খাতের এ দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থা এড়াতে পারে না বলে মনে করেন আর্থিক খাত সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ ছিল অর্থপাচার ঠেকানো। তারা সব জানত। উল্টো ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে তারা অর্থপাচারে সহায়ক হয়ে কাজ করেছেন।
দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্ট্যারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান অর্থপাচারের জন্য সরাসরি নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ’র কর্মকর্তাদের ভূমিকাকে দুষেছেন। আইনি দুর্বলতার চেয়ে তাদের দায় বেশি বলে মনে করেন তিনি।
ছাত্র-জনতার গণ আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে দেশ থেকে গড়ে প্রতিবছর ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হওয়ার ধারণা দেওয়া হয়েছে শ্বেতপত্রে। এ প্রতিবেদন ১ ডিসেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হয়।
দেশের অর্থনীতির হালচাল জানতে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটির পর্যবেক্ষণ হল, আওয়ামী লীগ সরকারের একটানা তিন মেয়াদে ২৪০ বিলিয়ন ডলার বা ২৪ হাজার কোটি ডলার বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে। এ অর্থ বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৮ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
আর্থিক খাতের গোয়েন্দা হিসেবে পরিচিত বিএফআইইউ এ খাতের বিভিন্ন অনিয়ম রোধের পাশাপাশি অর্থপাচার ঠেকানো নিয়ে কাজ করে।
বিপুল পরিমাণের অর্থপাচার ঠেকাতে না পারার বিষয়ে আগের সরকারের মেয়াদে দীর্ঘ সময় ধরে এ বিভাগের প্রধান হিসেবে কাজ করা সাবেক ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান নানা ধরনের চাপ থাকার কথা তুলে ধরেন। রাজনৈতিক ও ঊর্ধ্বতন মহলের বিধিনিষেধের দোহাই থাকার কথা তুলে ধরেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগের শিক্ষক আল আমিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অর্থপাচার বিষয়ক আন্তর্জাতিক গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি (জিএফআই) বলেছে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, সরকার, ব্যবসায়ী ও আমলারা নষ্ট হওয়ায় অর্থপাচার বেড়েছে। রাষ্ট্রের পুরো সিস্টেম এক হয়ে কাজ করেছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো অবশ্যই জানে, কর্মকর্তারাও জানেন কারা অর্থপাচার করেছে।”
বিপুল অর্থপাচারের কাজটি ব্যাংকের মাধ্যমে হচ্ছে বলেই ব্যাংকারসহ সবার ভাষ্য।
এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ যথেষ্ট ছিল কি না, এমন প্রশ্নে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এত বড় ইস্যুতে তাৎক্ষণিক বক্তব্য দেওয়া সম্ভব না। আপনি লিখিত প্রশ্ন জমা দিলে গভর্নরের মতামত নিয়ে জানানো সম্ভব হবে।”
এরপর লিখিত প্রশ্ন দিয়ে এক সপ্তাহের বেশি অপেক্ষা করেও মঙ্গলবার পর্যন্ত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের বক্তব্য জানতে চাইলেও তার দিক থেকে সাড়া মেলেনি।
অর্থ ফেরাতে নতুন উদ্যোগ কী?
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আলোচনায় আসা অর্থপাচার প্রসঙ্গে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর ও সরকারের একাধিক উপদেষ্টা পাচার হওয়া অর্থ বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছেন।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসও এজন্য যুক্তরাজ্য, বিশ্ব ব্যাংক ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহযোগিতা চেয়েছেন।
পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে গভর্নরের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের আন্তঃসংস্থা টাক্সফোর্স পুনর্গঠন করা হয়। এটির উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, বিদেশে পাচার করা সম্পদ দেশে ফেরত আনা এবং অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট।
বিএফআইইউর তৎপরতা নিয়ে প্রশ্ন
আওয়ামী লীগ ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করার সময়েও বিএফআইইউ বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পরিচালিত একটি ইউনিট ছিল।
আন্তর্জাতিক চাপ ও শর্ত পরিপালন করতে গিয়ে স্বতন্ত্র সংস্থা হিসেবে এ ইউনিটের আইনি কাঠামো দেওয়া হয় ২০১২ সালে।
আইন অনুযায়ী স্বতন্ত্র সংস্থা হলেও প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনও বিএফআইইউ পরিচালনায় জনবল, অর্থ ও অবকাঠামো সুবিধা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আইনি কাঠামোতে স্বতন্ত্র হওয়ার পরও বিএফআইইউ’র প্রথম প্রধান নির্বাহী হন বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান। বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে থাকা অবস্থাতেও সংস্থার প্রধান ছিলেন তিনি।
মেয়াদ শেষে একাধিকবার চুক্তি বাড়িয়ে সবশেষ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজী হাসান বিএফআইইউ প্রধান ছিলেন, অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদের সিংহভাগ সময়ে দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
বিপুল পরিমাণের অর্থ পাচার ঠেকাতে না পারার বিষয়ে রাজী হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নানা ধরনের চাপের মধ্যে ছিলাম। রাজনৈতিক ও উপর মহলের বাধা নিষেধ ছিল। এটা করা যাবে না, ওটা ধরা যাবে না। সব দেখা যাবে না ইত্যাদি।’’
‘উপর মহল’ কারা, তাদের বিষয়ে খোলাসা না করে তিনি বলেন, “এর উপর আমাদের আইনি ও নীতিমালার দুর্বলতা ছিল, পলিসি দুর্বল ছিল। ইমপ্লিমেন্টেশনে দুর্বলতা ছিল। সেই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ও প্রভাব খাটিয়ে যে অর্থ পাচার করা হচ্ছে, তা আমরা বুঝতে পারছিলাম।
“রেগুলেটর হিসেবে ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের প্রয়োজন ছিল। ব্যাংকারদের সার্পোট প্রয়োজন ছিল। এক সময় অনেক ব্যাংকে এ জন্য জনবলও ছিল না। এখন তো ক্যাপাসিটি বিল্ডিং অনেকটা হয়েছে,’’ বলেন তিনি।
সরকারের পালাবদলের পর নতুন কাউকে এখনও বিএফআইইউ’র দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন নির্বাহী পরিচালক তা দেখভাল করছেন।
অর্থাপাচার প্রতিরোধে এ সংস্থার ব্যর্থতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্রকে লিখিত প্রশ্ন জমা দেওয়া হলেও এক সপ্তাহে উত্তর মেলেনি।
বিএফআইইউ’র কাজ নিয়ে ক্ষোভ আওয়ামী লীগ সরকারের সময়েও ছিল। ২০১৬ সালের ১১ অগাস্ট অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সংস্থার কাজ নিয়ে আলোচনা হয়।
তখনকার কমিটির সভাপতি আব্দুর রাজ্জাক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “২০১৩ সালে ৯৯৬ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। গত ১০ বছরের প্রতি বছর গড়ে ৫০০ কোটি টাকা করে পাচার হয়েছে। ওভার ইনভয়েস-আন্ডার ভয়েস করে টাকা পাচার হচ্ছে। ফাইনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের কাজটা কী?
“আমরা এ বিষয়টা নিয়ে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেছি। কানাডার বেগম পাড়ায় টাকা পাচার হয়। মালয়েশিয়ায় সেকেন্ড হোম এ আমরা তৃতীয় হয়েছি। এখন পর্যন্ত একজনকেও চিহ্নিত করা যায়নি। একটা কেসও তুলে ধরতে পারেনি,” বলেন তিনি।
সাবেক এই কৃষিমন্ত্রী বলেন, “২০১৫ সালের মে মাসে ৪০০-৫০০ মার্কিন ডলারের চাল ৮০০-১০০০ ডলার দেখিয়ে আমদানি করা হয়েছে। এই বিষয়গুলো তদন্ত করে দেখতে হবে।’’
খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিলে বেড়েছে অর্থপাচার?
মূলত দুইভাবে অর্থপাচার হয়ে থাকে। প্রথমটি হচ্ছে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ওভার-ইনভয়েসিং ও আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে। এ পন্থায় অর্থপাচার হয়ে থাকে ব্যাংকিং চ্যানেলে। বাংলাদেশের পুরো আমদানি-রপ্তানি ও বর্হিবিশ্বের সঙ্গে সব ধরনের বৈধ লেনদেন হয় ব্যাংকিং চ্যানেলে।
লেনদেনের অন্য উপায়টি হলো হুন্ডি, যেখানে কোনো প্রকার বৈধ নথি ছাড়াই ব্যক্তি পর্যায়ে লেনদেন হয়।
অর্থপাচার ঠেকাতে দেশে প্রয়োজনীয় আইন এবং সরকারি উদ্যোগের কমতি নেই বলে অনেকে আগে থেকেই বলে আসছেন বিশ্লেষকরা। দরকার রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সরকারের দিক থেকে প্রভাব খাটানো বন্ধ না হলে সেটি সম্ভব নয় বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিভিন্ন পদক্ষেপের পাশাপাশি অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ ও সন্ত্রাসী কাজে অর্থায়ন প্রতিরোধে জাতীয় সমন্বয় কমিটি রয়েছে। এটির সদস্য গভর্নর, বিএফআইইউ প্রধানসহ আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর প্রধান, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব।
অর্থপাচার ঠেকাতে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন (সংশোধিত) ২০১৫ করা হয়। পরবর্তী সময় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিধিমালা, ২০১৯ করা হয়।
তবে এসব কাগজে কলমেই রয়ে গেছে। দেদারসে পাচার হয়েছে অর্থ।
এজন্য দুর্বল কাঠামো, জনবলের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিল নীতিমালাকেও দায়ী করেন বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান রাজী হাসান।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার খেলাপি ঋণ সিডিউল করার নীতিমালা করেছে। খেলাপিরা টাকা না দিয়ে এসব কী করেছে? তারা টাকা না পেলে পাচার করত কীভাবে। খেলাপি টাকা আদায় না করাতেও পাচার হয়েছে।”
অর্থপচারের জন্য ব্যাংকারদের দায়ী করেছিলেন বিএফআইইউ’র সবশেষ প্রধান মাসুদ বিশ্বাসও। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, “এর পেছনে ব্যাংকাররা দায়ী। তারা তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছেন না।”
দিন দিন অর্থপাচারের ঘটনাগুলো বাড়ছে কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, “অর্থপাচারের ৮০ শতাংশই ট্রেডবেইজড (বৈদেশিক বাণিজ্য তথা আমদানি-রপ্তানি)। অর্থপাচারের জন্য সবচেয়ে ‘ভালনেরেবল (ঝুঁকিপূর্ণ)’ খাত হচ্ছে ব্যাংক।”
খেলাপি হওয়ার পরও খেলাপি না দেখানোকে দায়ী করে তিনি বলেছিলেন, “মানি লন্ডারিং কমছে না আমাদের কারণে। ঋণ শ্রেণিকরণের দায়িত্ব তো ব্যাংকের, তারাই করে থাকে। তারা যদি না করে, তাহলে কীভাবে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক তো সব সময় গিয়ে দেখতে পারে না। অনেক শাখায় তো তিন বছর পরে পরিদর্শন হয়।”
তবে বেসরকারি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) এর চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন ব্যাংক খাতের দুর্দশার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা দায়ী করেছেন।
গত বুধবার ঢাকার মিরপুরে বিআইবিএম (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট) আয়োজিত এক সংলাপে তিনি বলেন, “বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মীদের পদোন্নতি, বদলি, নতুন চাকুরিতে নিজেদের পছন্দের ব্যক্তির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা হস্তক্ষেপ করেন।”
খেলাপি হওয়া ঋণকে নিয়মিত দেখাতে পুনর্গঠন (রিস্ট্রাকচার), পুনঃতফসিল (রিসিডিউল) করার সুযোগ দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
সবশেষ ২০১৫ সালে বিশেষ বিবেচনায় ১৫টি শিল্প গ্রুপের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার খেলাপী ঋণ পুনঃতফসিল করা হয় বিশেষ বিবেচনায়।
তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছিল, ব্যবসায়ীদের দাবির কারণে শিল্প খাত রক্ষায় ২ শতাংশ পরিশোধে এই সুবিধা একবারই দেওয়া হবে।
তবে পরবর্তী সময় ৫০০ কোটি টাকার বেশি পরিমাণের খেলাপি হওয়া ঋণকেও পুনঃতফসিলের সুযোগ দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক; যার বেশির ভাগ ঋণ এখন ফের খেলাপি হয়েছে।
বারবার পুনঃতফসিল করায় খেলাপি হয়েও খেলাপি না দেখানো এসব ঋণসহ মোট খেলাপি ঋনের পরিমাণ গত সেপ্টেম্বর শেষে দুই লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দেখানো খেলাপি ঋণের এ তথ্য নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোও বরাবরই আপত্তি জানিয়ে আসছে।
অর্থনীতির শ্বেতপত্রে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা বলে তুলে ধরা হয়েছে।
খেলাপি হওয়া ঋণের বড় অংশই পাচার হয়ে গেছে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের এমন পর্যবেক্ষণকে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে অন্তবর্তী সরকারের সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টার সাম্প্রতিক সময়ের বক্তব্য।
দেশের ব্যাংক খাত থেকে বিপুল পরিমাণ ঋণ নেওয়া বড় শিল্পগোষ্ঠীর দুটি হচ্ছে বেক্সিমকো ও এস আলম গ্রুপ। এসব ঋণের বড় অংশই এখন খেলাপি হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
গত ৩০ নভেম্বর অর্থনীতি বিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইকনোমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) এর সেমিনারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, বেক্সিমকো ও এস আলমের ব্যাংক হিসাবে কোনো টাকা নেই। তারা বেতন দিতে পারছে না। পুরো ব্যালেন্স শিট ফাঁকা।
এ দুটি শিল্প গ্রুপের মধ্যে বেক্সিমকো গ্রুপের ৩২টি প্রতিষ্ঠানকে শুধু জনতা ব্যাংকই প্রায় ২৭ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ দিয়েছে। অন্যান্য ব্যাংক ও বন্ড মিলিয়ে ব্যাংক খাত থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ ঋণের পরিমাণ ৩৬ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ক্ষমতার পালাবদলের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপদেষ্টা ও বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান গ্রেপ্তার হয়েছেন। তার ব্যাংক হিসাব জব্দ ও গ্রুপের ব্যাংক হিসাবের তথ্য তলব করা হয়েছে।
ঋণের বড় অংশ যে খেলাপি হয়ে যাচ্ছে সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ আছে কি না তা জানতে বেক্সিমকো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ওসমান কায়সার চৌধুরীর সঙ্গে একাধিক উপায়ে যোগাযোগের চেষ্টা করে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম। ক্ষুদে বার্তা পাঠানোর পরে লিখিত প্রশ্নেও কোনো সাড়া দেননি তিনি।
এদিকে বেসরকারি ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি থেকে এস আলম গ্রুপ ঋণ নিয়েছে ৮০ হাজার কোটি টাকা।
এছাড়া তার নিয়ন্ত্রণে থাকার সময়ে শরীয়াহ ধারার অন্য ৭ ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে ঋণ রয়েছে গ্রুপটির।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ঋণ খেলাপি হওয়ার ঝুঁকি দেখছেন কি না, এ প্রশ্নে এস আলম গ্রুপের চট্টগ্রাম অফিসের উপ-মহাব্যবস্থাপক আশীষ কুমার নাথ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভোগ্যপণ্যসহ সব কোম্পানির ব্যবসা স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে। কিছু কোম্পানির ব্যাংক হিসাব সচল হয়নি এখনো।
“সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে ব্যবসায়ীদের বৈঠকে এস আলম গ্রুপের প্রতিনিধিও ছিলেন। আমরা সরকারের কাছ থেকে সহযোগিতা চেয়েছি, প্রশাসনিক সহযোগিতাও প্রয়োজন কোম্পানি সচল ও ব্যাংক ঋণের অর্থ পরিশোধে।”
দায়ী কেন্দ্রীয় ব্যাংক-বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারাও?
অর্থপাচার ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা বিএফআইইউ’র সদ্য সাবেক প্রধান মাসুদ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে চাপের মুখে তিনি গত অগাস্টে পদত্যাগ করেন।
অর্থপাচার হওয়ার পেছনে আইনি দুর্বলতার চেয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ’র কর্মকর্তাদের ভূমিকাকে দুষছেন দুর্নীতিবিরোধী বেসরকারি সংগঠন ট্রান্সপারেন্সি ইন্ট্যারন্যাশল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটা সত্য যে, বিশাল অঙ্কের অর্থপাচার হয়ে গিয়েছে দেশ থেকে। পাচারকারীদের সহায়ক হয়ে কাজ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউ, তারা সব জানে।”
অন্যদিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের চাপে অর্থ পাচার পুরোটা রোধ করা সম্ভব ছিল না বলে দাবি করেন বিএফআইইউ’র সাবেক প্রধান রাজী হাসান।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বিএফআইইউ’র কর্মকর্তারাও অর্থপাচারের সুবিধাভোগী বলে মনে করেন ইফতেখারুজ্জামান।
তিনি বলেন, “বিএফআইইউ’র সদ্য সাবেক প্রধানের (মাসুদ বিশ্বাস) বিরুদ্ধেও অর্থ পাচারের অভিযোগের তদন্ত চলছে। অর্থপাচারকারীরা যেমন সুবিধা নিয়েছেন, তেমনি সহায়তাকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারাও ব্যক্তিগত লাভের জন্য পাচারকারীদের সহযোগিতা করেছেন।
“চাপ তো সব সময়ই আছে, থাকবেও।”
সব কর্মকর্তাই যে অর্থপাচারে সহযোগিতা করেছেন তা নয়, সৎ ও সাহসী কর্মকর্তা আছেন মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “প্রয়োজনে তাদের আইনি নিরাপত্তা বাড়ানো যেতেই পারে। কিন্তু অর্থপাচারের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বিচারের মাধ্যমে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এটি বর্তমান সরকারের সময়ে সম্ভব। যাতে, ভবিষ্যতের জন্য দৃষ্টান্ত থাকে।”
বিএফআইইউ এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে অর্থপাচার প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে বাধা কোথায় ছিল, তা জানতে মাসুদ বিশ্বাসের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন