আওয়ামী লীগ সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রশাসনের কর্মকর্তা আর দলের অনেক নেতার সঙ্গে ছিল তার সুসম্পর্ক। নিজেকে পরিচয় দিতেন শেখ হাসিনার একান্ত সচিব-২ গাজী হাফিজুর রহমান লিকুর বন্ধু হিসেবে। আনিসুর রহমান সোহাগ নামের এই মানুষটি প্রতারণার মাধ্যমে বানিয়েছেন কোটি কোটি টাকা। দখল করেছেন অনেক সম্পদ।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিরুদ্ধে অর্থদাতা হিসেবে নাম এসেছে তার। এ নিয়ে দুটি হত্যা মামলা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। এত কিছুর পরও বহাল তবিয়তে থাকা আনিসুর রহমান সোহাগ এবার অপচেষ্টা চালাচ্ছেন পরিবর্তিত ক্ষমতাবলয়ের কাছাকাছি যেতে।
ভুক্তভোগী এবং স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
সোহাগের নিকটাত্মীয়রা বলছেন, তার উত্থান আলাদিনের চেরাগকেও হার মানায়। বাবা ছিলেন ইটভাটার শ্রমিক। নিজে চাকরি করতেন পোশাক কারখানায়। পরে ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি। এরপর ধানমন্ডির একটি কনভেনশন সেন্টারের ম্যানেজার হয়ে সেটির ইজারাদার বনে যান সোহাগ।
শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক অল্প দিনেই। ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল দখলে নিয়ে বসে পড়েন অধ্যক্ষের চেয়ারে, যদিও সেই যোগ্যতা নেই তার। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতাদের আশ্রয় পাওয়া সোহাগের বড় শক্তি ছিল মন্ত্রী-এমপি ও তাদের ঘনিষ্ঠরা। তাদের প্রভাব খাটিয়ে বেপরোয়া সোহাগ নিঃস্ব করেন বহু মানুষকে। এমনই নানা অভিযোগ উঠে এসেছে ভুক্তভোগীদের তরফে।
জানা গেছে, ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের পলাতক বিভিন্ন নেতার অর্থসম্পদ দেখভাল করছেন এই সোহাগ। এমনই একজন শেখ হাসিনার এপিএস লিকু। তার রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলার মধু সিটির ১০ তলা বাড়ির দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন তিনি।
আন্দোলনের হত্যা মামলা মাথায় নিয়ে ক্ষমতাবলয়ের কাছে যেতে চেষ্টা সোহাগের
বিভিন্ন সূত্রে আরও জানা যায়, লিকুর অবৈধ সম্পদের দেখভালের পাশাপাশি নগদ টাকাও গচ্ছিত রয়েছে সোহাগের কাছে।
এইচএসসি পাস সোহাগ দাবি করতেন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। তার জাল ও ভুয়া সনদের বিষয়টি প্রমাণিত হলেও ক্ষমতাবলয়ে থাকায় তার বিরুদ্ধে তখন ব্যবস্থা নেয়নি শিক্ষা বোর্ড, শিক্ষা অধিদপ্তর ও ইউজিসি।
এদিকে সোহাগ নিজেকে ‘মাতৃভূমির খবর’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদক পরিচয় দেন। তার সাংবাদিকতার নেই কোনো অভিজ্ঞতা। ক্ষমতার পালাবদলে রাতারাতি বোল পাল্টাতে থাকেন তিনি। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের কাছের মানুষ ও নেতাদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন বলে জানায় বিভিন্ন সূত্র।
সোহাগের উত্থানের সিঁড়ি
ঝালকাঠির নলছিটির মগড় ইউনিয়নের খাওখীর গ্রামের বাসিন্দা আনিসুর রহমান সোহাগ। তার বাবা মোহাম্মদ আলী খান ইটভাটায় কাজ করতেন। তার অভিজ্ঞতা সামনে রেখে ‘যমুনা ব্রিকস’নামে একটি ইটভাটা গড়ে তোলেন সোহাগ। স্থানীয়দের কম দামে ইট দেওয়ার কথা বলে বহু জনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেন। কিন্তু পরে আর ইট দেননি তাদের। এই নিয়ে মামলা হয় তার বিরুদ্ধে।
এর আগে সোহাগকে চাকরি পাইয়ে দেন স্থানীয় আমিরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের সময় প্রয়াত আব্দুর রব খান এবং আমি ম্যারিয়টের এমডি মোহাম্মদ মোস্তফাকে বলে তাকে (সোহাগ) ঢাকায় চাকরি পাইয়ে দিই। এখন ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়িসহ বিপুল টাকার মালিক সে। এত সম্পদের উৎস কিংবা রহস্য কী, এলাকার লোকজন জানে না।’
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায়, গত সরকারের আমলে ইউনিয়ন পরিষদের চারিত্রিক সনদ জাল করে ভূমিহীনদের ১২০ বিঘা জমি বন্দোবস্ত নেন সোহাগ, তার পরিবার ও স্বজনরা। এ নিয়ে ভুক্তভোগীরা উচ্চ আদালতে রিটের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
সোহাগের কর্মজীবন সম্পর্কে জানা যায়, তিনি পাঁচ হাজার টাকা বেতনে ঢাকার ইপিজেডের একটি পোশাক কারখানায় সুপারভাইজার হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর অপসোনিন ফার্মা নামের ওষুধ কোম্পানির মেডিকেল প্রমোশন অফিসার হিসাবে চাকরি করেন। ২০০৯ সালে ধানমন্ডির ম্যারিয়ট কমিউনিটি সেন্টারে ম্যানেজার হিসাবে চাকরি নেন।
একপর্যায়ে জেড এম রানা, রফিকুল ইসলাম ও সোহাগ ম্যারিয়ট কনভেনশন সেন্টারটি ইজারা নেন। মূল বিনিয়োগকারী জেড এম রানা। সোহাগের কাছে তিনি সাড়ে চার কোটি টাকা পাওনা। সোহাগ হিসাব-নিকাশে বসতে না চাওয়ায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর অভিযোগ জানান জেড এম রানা।
লিকুকে ব্যবহার
২০১৬ সালে গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনায় সরকার পিস স্কুল বন্ধ করে দেয়। আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায় জেড এম রানা ও আনিসুর রহমান সোহাগ লালমাটিয়ায় পিস স্কুল কিনে নিয়ে সেখানে রেডব্রিজ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে পুলিশ সেটিও বন্ধ করে দেয়। এরপর রেডব্রিজ স্কুলটি এভেরোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের সঙ্গে একীভূত হয়।
এ সময় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস হাফিজুর রহমান লিকুর সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন সোহাগ। লিকুর প্রভাব দেখিয়ে সোহাগ জেড এম রানাকে দূরে সরিয়ে রাখেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই নিজেকে ‘হেড অব স্কুল’ ঘোষণা করে অধ্যক্ষের পদে আসীন হন সোহাগ।
সিন্ডিকেট গড়ে তুলে সোহাগ স্কুলের শেয়ার বিক্রির নামে হাতিয়ে নেন বিপুল অঙ্কের টাকা। এ সময় তিনি নিজেকে কেমিস্ট্রিতে অনার্স ও মাস্টার্স পাস দাবির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে মানবসম্পদ বিভাগে স্নাতকোত্তর দাবি করে গণমাধ্যমে আত্মপ্রচারণামূলক প্রতিবেদন ছাপান।
এরপরই মূলত তথ্য উঠে আসে সোহাগ উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর আর পড়ালেখা করেননি। তখন ইবাইস ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ/এমবিএ সনদ সংগ্রহ করেন তিনি, যা পরবর্তীতে জাল বলে প্রমাণিত হয়।
এদিকে সোহাগ তার ব্যবসায়িক পার্টনার জেড এম রানার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনার এপিএস লিকুকে ব্যবহার করে তিনটি মামলা করান। এসব মামলায় এক মাস কারাগারে থাকতে হয় রানাকে। পরবর্তীতে মিথ্যা প্রমাণিত হয় মামলাগুলো। জেড এম রানাকে ঠকানো ছিল এসব মামলার উদ্দেশ্য।
জেড এম রানা ঢাকাটাইমসকে বলেন, 'আমি এক মাস জেলহাজতে থাকার সময় আমার প্রতিষ্ঠান এভেরোজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের মিরপুর শাখাটি দখলে নেন আনিসুর রহমান সোহাগ। এ ছাড়া ডিবির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদকে কাজে লাগিয়ে আমাকে নানাভাবে হয়রানি ও বিপদে ফেলেন তিনি।’
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, উপদেষ্টা মণ্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমুর সঙ্গে সখ্য ছিল সোহাগের। এই সুযোগে তিনি বিগত সরকার আমলে প্রতারণা, দখলবাজিতে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন।
তার বিরুদ্ধে পাওয়া বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য জানতে আনিসুর রহমান সোহাগের ব্যক্তিগত মোবাইলে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তাতে তিনি সাড়া দেননি। হোয়াটসঅ্যাপ বার্তা দেওয়া হলেও উত্তর দেননি তিনি।
ঢাকাটাইমস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন