গ্রিন ও ক্লিন সিটি হিসেবে খ্যাতি রয়েছে রাজশাহীর। সৌন্দর্য ও বাসযোগ্য নগর হিসেবেও আছে গৌরব। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় অপরিকল্পিত নির্মাণকাজের ফলে এই গৌরব ম্লান হতে বসেছে। প্রতি বছর বাতাসে ধুলার দখল বাড়ছে। সেইসঙ্গে শহরের বায়ুতে মানবদেহের ক্ষতিকর ক্ষুদ্র বস্তুকণার মান বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। যা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। সেইসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নগরের বাসিন্দারা।
বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর ক্ষুদ্র বস্তুকণা কমিয়ে বিশ্বসেরা নির্মল বায়ুর খ্যাতি অর্জন করেছিল রাজশাহী। তবে চলতি বছর শহরের বায়ুতে ক্ষতিকর ক্ষুদ্র বস্তুকণার মান বেড়েছে। গত ৩০ নভেম্বর শহরের ছয়টি স্থানের বায়ুর মান পরীক্ষা করে এই তথ্য জানায় বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এর আগে ২০২২, ২০২৩ সালে নগরের পাঁচটি জায়গায় বায়ুর মানের পরীক্ষা চালায় সংগঠনটি। তাদের পরীক্ষার ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, ক্রমেই বায়ুদূষণ বাড়ছে। অথচ বাতাসে ভাসমান মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর কণা দ্রুত কমিয়ে আনায় ২০১৬ সালে বিশ্বসেরা হয়েছিল নগরটি। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) উপাত্তের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই তথ্য তখন প্রকাশ করা হয়েছিল।
গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাজশাহীর বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা (১০ মাইক্রোমিটার আকারের) প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ছিল ১৯৫ মাইক্রোগ্রাম। এটা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কমে ২০১৬ সালে দাঁড়ায় ৬৩ দশমিক ৯ মাইক্রোগ্রামে। দুই বছর আগে আরও ক্ষুদ্র ধূলিকণা (২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার আকারের) প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ছিল ৭০ মাইক্রোগ্রাম। ২০১৬ সালে এটি প্রায় অর্ধেক হয়ে দাঁড়ায় ৩৭ মাইক্রোগ্রাম।
বাংলাদেশে বায়ুর নির্ধারিত মান অনুযায়ী, বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র ধূলিকণা (১০ মাইক্রোমিটার আকারের) প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ১৫০ মাইক্রোগ্রাম এবং আরও ক্ষুদ্র ধূলিকণা (২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার আকারের) প্রতি ঘনমিটার বাতাসে ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত স্বাভাবিক ধরা হয়।
rajsahi-1
নগরায়ণে ধূসর রাজশাহী ক্লিন সিটি
সর্বশেষ পরীক্ষায় নগরের তালাইমারী মোড়ে ১০ মাইক্রোমিটার আকারের কণা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পাওয়া গেছে ১৩০ মাইক্রোগ্রাম। একই স্থানে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার আকারের কণা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পাওয়া গেছে ১০৬ মাইক্রোগ্রাম। এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বরে এই পরিমাণ যথাক্রমে ১৯০ ও ১২৫ মাইক্রোগ্রাম, সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে ১০৩ ও ৭১ মাইক্রোগ্রাম, লক্ষ্মীপুর মোড়ে ৯৩ ও ৬৮ মাইক্রোগ্রাম, বিসিক এলাকায় ১১৭ ও ৯০ এবং বন্ধ গেট এলাকায় ১৪৫ ও ১১৫ মাইক্রোগ্রাম।
গত বছরের নভেম্বরে তালাইমারী মোড়ে ১০ মাইক্রোমিটার আকারের কণা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পাওয়া গেছে ২৪৬ মাইক্রোগ্রাম। একই স্থানে ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার আকারের কণা প্রতি ঘনমিটার বাতাসে পাওয়া গেছে ৯৭ মাইক্রোগ্রাম। এ এইচ এম কামারুজ্জামান চত্বরে এই পরিমাণ যথাক্রমে ২৩১ ও ৯৩ মাইক্রোগ্রাম, সাহেববাজার জিরো পয়েন্টে ২২৫ ও ৮৮ মাইক্রোগ্রাম, লক্ষ্মীপুর মোড়ে ২২৯ ও ৯৪ মাইক্রোগ্রাম, বিসিক মঠপুকুর এলাকায় ২২২ ও ৭৬ মাইক্রোগ্রাম।
রাজশাহীর বরেন্দ্র পরিবেশ উন্নয়ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার পক্ষে পরীক্ষায় নেতৃত্ব দেন গবেষক ও সংগঠনটির সভাপতি মো. জাকির হোসেন। তাকে সহযোগিতা করেন সংগঠনটির কোষাধ্যক্ষ অলি আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ওবায়দুল্লাহ, সদস্য শামসুর রাহমান, কলি আহমেদ প্রমুখ। তারা জানান, ২০২২ সাল থেকে তারা রাজশাহীর বায়ুর মান পরীক্ষা করে আসছেন। প্রতিবার নগরের পাঁচটি স্থানে পরীক্ষা চালালেও এবার বন্ধ গেটেও পরীক্ষা চালানো হয়েছে। তাদের ধারাবাহিক পরীক্ষায় দেখা গেছে, বায়ুদূষণ বেড়েই চলেছে।
যেসব কারণে বায়ুতে ক্ষতিকর বস্তুকণা বাড়ছে
নগরের হড়গ্রাম বাইপাস থেকে কাশিয়াডাঙ্গা, বহরমপুর-তেরখাদিয়া-কলাবাগান-বর্ণালী মোড়, কাদিরগঞ্জ-রেলগেট-শালবাগান-শিরোইল এলাকায় দেড় বছর ধরে নির্মাণ হচ্ছে পাঁচটি রেলওয়ে ওভারপাস। সেইসঙ্গে নগরে বহুতল কয়েকটি ভবনের নির্মাণকাজ চলছে। তবে তারা পরিবেশ আইন মানছে না। পাশাপাশি ছোট-বড় ভবন উঠছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে ক্ষতিকর বস্তুকণা বাড়ছে।
সুইজারল্যান্ডভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (একিউআই) লাইভ রিয়েল টাইম ওয়েবসাইটে রাজশাহীর বায়ুর মানের স্কোর গত দুই সপ্তাহে ‘অস্বাস্থ্যকর’ বলে নির্দেশ করেছে।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ুদূষণের প্রধান উৎস ২ দশমিক ৫ মাইক্রোমিটার ঘনত্বের অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণার পাশাপাশি ১০ মাইক্রোমিটার ধূলিকণা। গত কয়েক বছরে রাজশাহীর বাতাসে এসব বস্তুকণার উপস্থিতি বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে। এ কারণে নগরের বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর হয়ে উঠেছে।
একিউআই পর্ববেক্ষণ অনুযায়ী, বায়ু মান ১০১ থেকে ১৫০ স্কোরকে মাঝারি অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ স্কোর হলে খারাপ অস্বাস্থ্যকর, ১৫১ থেকে ২০০ হলে ঝুঁকিপূর্ণ অস্বাস্থ্যকর, ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১ থেকে ঊর্ধ্বে হলে দুর্যোগপূর্ণ বায়ু মান হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
রাজশাহীতে বায়ুর মান অস্বাস্থ্যকর
রাজশাহীতে গত সপ্তাহে বায়ু মান অস্বাস্থ্যকর ছিল। আবার আগামী সপ্তাহে অস্বাস্থ্যকর হতে পারে বলে একিউআইয়ের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে। কোনও শহরের বায়ুমান স্কোর ৫১ থেকে ১০০-এর মধ্যে থাকলে তাকে গ্রহণযোগ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ৫ ডিসেম্বর বিকালে একিউআই লাইভ রিয়েল টাইম ওয়েবসাইটে রাজশাহীর বায়ু মানের স্কোর পাওয়া গেছে ১৬১।
রাজশাহী পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিকর ভাসমান কণা কমিয়ে আনার জন্য ২০১৬ সালে স্বাস্থ্যকর শহরের তালিকায় রাজশাহীর নাম উঠেছিল। ওই বছর শহরে প্রবাহমান বাতাস ছিল নির্মল ও দূষণমুক্ত। তবে ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর একটি পরিবেশ সংস্থা পরিচালিত বায়ু মান পরীক্ষায় বাতাসে ১০ মাইক্রোমিটার আকারের ভাসমান ক্ষুদ্রকণার উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ছিল ২৩১ মাইক্রোগ্রাম, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপুর্ণ। বর্তমানে নগরের কোনও কোনও স্থানে ধূলিকণার উপস্থিতি ২৪৬ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত। বায়ুদূষণের স্থানীয় উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে যানবাহন ও ছোট-মাঝারি ধরনের কলকারখানার ধোঁয়া, নির্মাণকাজের দূষণ ও আশপাশের ইটভাটার ধোঁয়া। এ ছাড়া অব্যাহতভাবে জলাশয়, পুকুর, দিঘী-নালাসহ অন্যান্য জলাধার কমে যাওয়া। নগরে বড় বড় বৃক্ষ নিধনও বায়ুদূষণের একটি কারণ।
নগরের বাসিন্দা শাহানাজ পারভীন বলেন, ‘সিটি করপোরেশন থেকে আগে নগরে নিয়মিত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা করা হতো। প্রায় প্রতিদিন গাছে পানি দেওয়া হতো। গাছের ধুলাবালুও পরিষ্কার করা হতো। কিন্তু এখন তা বন্ধ। সড়কে চলাচল করলে শরীরে ধুলাবালু লাগছে। এতে শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দিচ্ছে।’
শুষ্ক মৌসুমে বাতাসে ধূলিকণার পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে জানালেন রাজশাহী সিটি করপোরেশনের পরিবেশ উন্নয়ন কর্মকর্তা সৈয়দ মাহমুদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘চলমান মেগা প্রকল্পের নির্মাণকাজের কারণে ধূলিকণার পরিমাণ বেড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে আরও বাড়তে পারে। তবে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানদের নির্দেশনা দেওয়া আছে, তারা যেন পরিবেশ রক্ষার নিয়ম মেনে কাজ করেন।’
যা বলছেন পরিবেশ অধিদফতরের কর্মকর্তারা
রাজশাহী বিভাগীয় পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক কবির হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রাজশাহী মহানগরের রাস্তার পার্শ্ববর্তী স্থানে উন্মুক্তভাবে বালু, ইটের খোয়া, সুরকি ও মাটি যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখার কারণে বায়ুতে ক্ষুদ্র বস্তুকণা সহসাই মিশে যাচ্ছে। এ অবস্থায় রাজশাহী সিটি করপোরেশনকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে নির্মাণাধীন ভবন ও স্থাপনার পাশে দিনে দুবার যেন পানি ছিটানো হয়।’
রাজশাহী দ্রুত বর্ধনশীল নগর উল্লেখ করে কবির হোসেন আরও বলেন, ‘২০১৬ সালের পর থেকে বায়ুদূষণ উদ্বেগজনকহারে খারাপ হচ্ছে। এতে সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে দরিদ্র মানুষ, শিশু ও বয়স্করা। পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সবার উচিত বায়ুদূষণ কমাতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন