মুন্সীগঞ্জে আলুর বাজারে অস্থিরতা কাটছেই না। খাবার আলুর সংকট দেখিয়ে হিমাগার থেকে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৬৪-৬৫ টাকায়। আর কয়েকটি হাত বদল হয়ে খুচরা বাজারে তা ৭৫ থেকে ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আবার নতুন করে আলু আবাদ করতে গিয়ে গত বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি মূল্যে বীজ আলু কিনতে হচ্ছে কৃষকদের। সারের দামেও ব্যবধান বস্তা প্রতি কয়েকশ টাকায়। নামমাত্র অভিযানে মিলছে না কোন সমাধান।
এদিকে কৃষি বিভাগ বলছেন, জেলার সক্রিয় ৫৮টি হিমাগারে এখনও ৩০ হাজার মেট্রিক টন খাবার আলুর ও ৩১ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলু মজুত আছে। তবুও সংকট দেখিয়ে মজুতদাররা সিন্ডিকেট করে হিমাগার থেকে ৬৪ টাকার কমে আলু বিক্রি করছে না। যা কি না খুচরা বাজারে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় কিনে হতাশ ভোক্তারা। বীজ আলু হল্যান্ডের বাক্স আলুর সরকারিভাবে দাম নির্ধারণ না থাকায় তিন গুণ দামে বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা।
সদর উপজেলার মুন্সীরহাট কাঁচা বাজারে সবজি কিনতে আসা মহসিন রেজা জানান, ভরা মৌসুমে শীতকালীন সবজির দাম গত কয়েকদিনের তুলনায় কিছুটা কমলেও আলুর দাম নিয়ে চরমভাবে হতাশার কথা বলেন তিনি।
মহসিন রেজা জানান, আলুর জেলায় মুন্সীগঞ্জে প্রতি কেজি আলু ৮০ টাকায় কিনতে হবে চিন্তাও করা যায় না।
দোকানিদের কাছে আলুর অস্বাভাবিক দামের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, পাইকারদের কাছ থেকে তাদের প্রতি কেজি আলু ৭০ টাকার বেশি দিয়ে কিনতে হয়। এরপর পরিবহন খরচ আর বাছাইয়ে কিছু আলু ফেলে দিয়ে ৪-৫ টাকা লাভে তাদের খুচরা বিক্রি করতে হয়।
মুন্সীরহাট সবজির বাজারের বিক্রেতা আরিফ হোসেন বলেন, আমাদের হিমাগার থেকে কিনে আনতে হয় ৬৮ টাকা করে, সঙ্গে পরিবহন খরচ। আমরা বিক্রি করছি, ৭৫ টাকা করে। হিমাগার ব্যবসায়ীরা বলছে আলুর সংকট তাই দাম বেশি।
মুক্তারপুর ফেরিঘাট সংলগ্ন মাল্টি হিমাগারের এক মজুতদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বাজারে আলুর প্রচুর চাহিদা, তাই দাম বেশি। তাছাড়া হিমাগারে আলুর সংকটের কথাও বলেন এই মজুতদার। ৬৪ টাকা দরে হিমাগার থেকে আলু বিক্রি করছেন তারা।
অন্যদিকে চলতি বছরে নতুন করে এ জেলায় ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সাত হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। বাকি জমি প্রস্তুত করছেন আবাদের উদ্দেশে। কিন্তু গত বছর হল্যান্ডের বীজ আলুর প্রতি বাক্স যেখানে ১০ হাজার টাকায় পেয়েছে কৃষকরা, সে বাক্স এবার কিনতে হচ্ছে ৩০-৩২ হাজার টাকায়। আর হিমাগারে সংরক্ষিত বীজ আলুর ৫০ কেজির বস্তা এবার দ্বিগুণের বেশি দামে পাঁচ হাজার টাকায় কিনতে হচ্ছে তাদের। সারের বস্তার প্রতি খরচ বেড়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকায়। দাম নিয়ে ডিলাররা অহরহ তথ্য গোপন করছেন। তাদের বিক্রিত সঠিক মূল্য বলছে না সাংবাদিকদের কাছে। এরপর জমির ভাড়া বিঘা প্রতি ৫ থেকে ৭ হাজার টাকায় বেড়েছে। শ্রমিক মজুরি বেড়েছে প্রতি জনে ১০০ টাকা।
এমন পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলু আবাদে নেমেছে বলে জানান মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা চরকেওয়ার ইউনিয়নের টরকি গ্রামের আলু চাষি শাওন মিয়া। তিনি জানান, গত বছর প্রতি কেজি আলুর উৎপাদ খরচ ১৫ টাকা ছিল, এবার সেইটা ৩০ টাকায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে। সার বীজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে প্রশাসনকে কড়া নজর দিতে হবে।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা মহাকালী ইউনিয়নের বাগেশ্বর এলাকার আলু চাষি সুজন বেপারি বলেন, আমরা এবার ঝুঁকি নিয়ে আলু আবাদ করছি। গত বছর হল্যান্ডের অ্যাগ্রো কোম্পানির ৫০ কেজি বাক্স আলু কিনেছি ১০ হাজার ৫০০ টাকা। সেই আলু এই বছর কিনতে হয়েছে ২৯ হাজার ৫০০ টাকায়। ইউরিয়া সার ১৩৫০ টাকা সরকারি দাম নির্ধারিত থাকলেও বিক্রি করছে ১৪৫০ টাকা। টিএসপি সার গত বছর ছিল ১৪০০ সেটি এই বছর ১৬৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এমওপি সার ছিল এক হাজার টাকা এই বছর কিনে আনতে হয়েছে সাড়ে ১২ টাকায়। তেমনি সারের দামও প্রতি বস্তা প্রতি ১০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দাম দিয়ে আনতে হয়েছে। বর্তমানে যে পরিস্থিতি গতবার দুই কানি জমিতে আলু রোপণ করেছি। খরচ হয়েছে চার লাখ টাকা এই বছর খরচ হবে সাত লাখ টাকা। এরকম পরিস্থিতি থাকলে আমরা চাষ করে পোষাতে পারবো না।
একই এলাকার কৃষক হাফিজ খান জানান, গত বছর অতিবৃষ্টির কারণে আমার আলু নষ্ট হয়েছে। আমি অনেক লোকসানে পড়েছিলাম। এ বছর আলু বীজের দাম বেশি, তাই একটি জমিতে আবাদ করবো সেটি পিছিয়েছি- দাম কমবে আশায়। তাই বাধ্য হয়েই ৩০ হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে বাক্স আলু আনতে হয়েছে। আমার লাগবে চারটি বাক্স আমি পেয়েছি দুটি। ব্যবসায়ীরা দোকানে বাক্স আলু রাখে না। দামদর করে অন্য জায়গা থেকে এনে দেয়। আবার বিছর আলু যেগুলো আমাদের দেশের সেই আলু গত বছর ছিল দুই হাজার ২২০০ টাকা করে। এবার সেই আলু পাঁচ হাজার টাকা করে আনতে হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এভাবে আলু রোপণ করলে জমিতেই প্রতি কেজি আলুর দাম পড়বে ৩০ টাকা করে। যদি এখানেই এত দাম খরচ হয় তাহলে আমরা বিক্রি করবো কত টাকা, আর আমাদের থাকবে কত টাকা।
মুন্সীগঞ্জ সদরের কৃষি ব্যাংক সংলগ্ন লিয়াকত ট্রেডার্সের পরিচালক লিয়াকত আলী বলেন, এ বছর আলুর চাহিদা অনেক বেশি। আমাদের দেশি বীজ আলুর চাহিদা অনেক কম। হল্যান্ডের অ্যাগ্রো কোম্পানির ৫০ কেজির বাক্স আলু আমরা চেয়েছিলাম ২০০ বাক্স আমাদের তারা দিয়েছে মাত্র ২০টি বাক্স। এখন আমরা এই আলু বিক্রি করছি ২৫ হাজার ৫০০ টাকা করে। আর দেশি বীজ বিক্রি করছি চার হাজার ৫০০ টাকায়।
টঙ্গীবাড়ী বাজারের মহাদেব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী বিপ্লব ঘোষ জানান, এই বছর আলু বীজের অনেক চাহিদা রয়েছে। আমরা প্রথমে এক মাস আগে হল্যান্ডের বাক্স আলু কিনে এনেছি ১৫ হাজার করে। তখন বিক্রি করেছি ২০ হাজার করে। এখন আমাদের আনতে হচ্ছে বেশি দামে আর কিছুটা বাড়িয়ে বিক্রি করতে হবে এটাই তো স্বাভাবিক। তবে আপনারা যা বলছেন ৩২ হাজার টাকায় বিক্রি করছি- সেটি সত্য নয়।
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা বিএডিসি ডিলার মেসার্স গাজী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী জসিম গাজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের সরকারি যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সে দামেই বিক্রি করছি প্রতিটি সার। ইউরিয়া ১৩৫০, টিএসসি ১৩৫০, এমওপি এক হাজার ও ডিএপি এক হাজার ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। গত বছর এই দামেই আমরা সার বিক্রি করেছি।
এ প্রসঙ্গে মুন্সীগঞ্জ জেলা আলু চাষি ও ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের বক্তব্যও প্রায় একই রকম। তবে চলতি বছর মার্চ মাসে মুক্তারপুরস্থ রিভার ভিউ হিমাগারে তাদের সংগঠনের উদ্যোগে স্বপ্রোণোদিত হয়ে জেলা প্রশাসক ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সঙ্গে হিমাগারের আলুর দাম নির্ধারন নিয়ে একটি সভা করেন। যে সভায় আলু ব্যবসায়ীরা নিজেরাই দাবি তুলছিলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রতি কেজি আলুর মূল্য যাতে ৪৩ টাকা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এরপরও এত দাম কেন? জেলা প্রশাসন নিশ্চুপ কেন?
মুন্সীগঞ্জ ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক আসিফ আল আজাদ বাংলা ট্রবিউনকে জানান, হল্যান্ড থেকে যে বাক্স আলু দেশে আসে সেটির নির্ধারিত কোনও দাম নেই। একজন আমদানিকারক নিয়ে আসেন, তার কাছ থেকে আবার ডিলারের কাছে যায়। আবার ডিলারের কাছ থেকে সাব ডিলারের কাছে যায়। সেখান থেকে খুচরা দোকানির কাছে যায়। বীজ আলুতে সরকারের নির্ধারিত মূল্য না থাকায় ডিলাররা ইচ্ছেমতো মূল্য হাঁকিয়ে বীজ আলু বিক্রি করছে। আমরা খোঁজ নিয়ে জেনেছি, এ বছর চাহিদা অনুযায়ী হল্যান্ড থেকে বীজ আলু আসেনি। আর চাহিদা বেশি থাকায় জোগান কম হওয়ায় দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ছাড়া বাজার মনিটরিং জোরদার করতে তাদের লোকবলের প্রচণ্ড রকমের সংকট রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক বিপ্লব কুমার মোহন্ত বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, মুন্সীগঞ্জের প্রধান ফসল হচ্ছে আলু। চলতি বছরে নতুন করে এ জেলায় ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রায় নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতিমধ্যে সাত হাজার হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। বাকি জমি প্রস্তত করছেন কৃষক। এই বছর ২ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ বেশি হচ্ছে। গত বছর ৩৪ হাজার হেক্টর জমিতে চাষাবাদ করা হয়েছিল। এই পর্যন্ত জেলায় খাবার ও বীজ আলুর কোনও সংকট নেই। তবে আমদানি করা যে বীজ আলু সেটির সংকট আছে।
তিনি বলেন, আমরা যেখান থেকে দেশীয় বীজ আলু আনি, সেখানে আবহাওয়া খারাপ থাকার কারণে উৎপাদন কম হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬৫০ মেট্রিক টন বীজ আলু এসেছে। অন্য বছর দুই হাজার ৫০০ থেকে তিন হাজার মেট্রিক টন আসে। সামনের সপ্তাহে মধ্যে আরও আসবে। কম আসার কারণে কোনও কোনও অসাধু দোকানদার বিক্ষুব্ধ ঘটনা ঘটাচ্ছে।
আকাশছোঁয়া এমন দামের বিষয়ে তিনি বলেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। ভোক্তা অধিকার কৃষি বিপণন ও প্রশাসনের সবাইকে বিষয়টি জানিয়েছি। তারা বাজার মনিটরিং করছে। আমাদের কৃষি উপ-সহকারী কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া আছে- এই বিষয়গুলো নজরদারি রাখতে। আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করছি। ইতিমধ্যে কয়েকটি মোবাইল কোর্ট করা হয়েছে।
এ বছর ৫৮টি হিমাগারে ৮২ হাজার মেট্রিক টন বীজ আলু সংরক্ষণ করা ছিল। যদিও আমাদের মুন্সীগঞ্জে চাহিদা ৭০ হাজার মেট্রিক টন আলু। তার মানে আমাদের যে পরিমাণ বীজ আলু দরকার- তার থেকে অনেক বেশি ছিল। তবে সারের বিষয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কথা আসছে- অনেক জায়গায় সারের দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। আমরা এই বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করছি, যদি কোথাও এইরকম প্রমাণসহ পাই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন