বিগত রাজনৈতিক সরকারগুলোর আমলে দলীয় বলয়ের মধ্যে থাকায় পুলিশ ‘জনবান্ধব’ হয়ে উঠতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দলগুলো মাঠ পর্যায়ে কাজ করা এই বাহিনীকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে।
পাশাপাশি ক্ষমতালোভী পুলিশ সদস্যদের দুর্নীতি ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের কারণে আস্থা হারিয়েছে জনগণের বন্ধু হতে চাওয়া এই বাহিনী। প্রতিনিয়ত মানুষের ভেতর পুলিশের প্রতি জন্ম নিয়েছে রাগ- ক্ষোভ, যার প্রতিফলন দেখা গেছে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময়।
বছরের পর বছর ধরে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা পুলিশ বাহিনীকে সবশেষ জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে জনমানুষের বিপরীতে দাঁড় করিয়েছিল ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ। আইনের প্রতি আনুগত্য ও নিরপেক্ষ থাকার শপথ নেওয়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীটি দলীয় প্রভাবের কারণে গুলি করে হত্যা করেছে শত-শত ছাত্র-জনতাকে।
এ কারণে সাধারণ মানুষের আক্রোশের শিকার হয়েছে পুলিশ নিজেও।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সারা দেশে ৪৪ জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই হাজার সদস্য। এ ছাড়া থানা ও ফাঁড়িসহ পুলিশের অসংখ্য স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে, মনোবল হারিয়েছেন বাহিনীর সদস্যরা। ৫ আগস্টের পর বেশ কিছুদিন তাদের কাজেই ফেরানো যায়নি।
এ অবস্থায় পুলিশের মনোবল ফেরাতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গঠন করা হয়েছে পুলিশ সংস্কার কমিশন। সাবেক সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বে ১১ সদস্যের পুলিশ সংস্কার কমিশন ইতোমধ্যে বাহিনীটির সংস্কারে কাজও শুরু করেছে।
সম্প্রতি ‘কেমন পুলিশ চাই’ শীর্ষক একটি জনমত জরিপও করেছে এই কমিশন। গত মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) ফল প্রকাশ করা এই জরিপে নিজেদের মতামত দিয়েছে সাধারণ মানুষ।
গত ৩১ অক্টোবর থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত অনলাইনে চালানো এই জরিপে সারা দেশ থেকে ২৪ হাজার ৪৪২ জন মতামত দেন। তাদের মধ্যে ২৩ হাজার ১৯১ জন (৯৪.৯ শতাংশ) পুরুষ ও ১ হাজার ২৫১ জন (৫.১ শতাংশ) নারী। মতামত দাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় ৮৬.৬ শতাংশের বয়স ছিল ১৮ থেকে ৪৪ বছর।
জরিপে ১৪টি পেশার মানুষ তাদের মতামত দিয়েছেন। যার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ৩৬.৪ শতাংশ চাকরিজীবী, ২৭.২ শতাংশ ছাত্র, ৭.৬ শতাংশ ব্যবসায়ী ও ৭.১ শতাংশ ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ২০.৩ শতাংশ (৪ হাজার ৯৬৮ জন) মতামত আসে ঢাকা জেলা থেকে।
এরপরে যথাক্রমে চট্টগ্রাম জেলা থেকে ৭.৫ শতাংশ (১ হাজার ৮৩৮ জন) ও কুমিল্লা জেলা থেকে ৫ শতাংশ (১ হাজার ২২৮ জন) মতামত আসে। সবচেয়ে কম ০.১ শতাংশ মতামত আসে বান্দরবান জেল থেকে। যেখানে মাত্র ৩১ জন মানুষ তাদের মতামত জানান।
জরিপের ফলাফল
সংস্কারের মাধ্যমে কেমন পুলিশ দেখতে চান? জরিপে এমন প্রশ্নের জবাবে সবচেয়ে বেশি ৮৮.৭ শতাংশ মানুষ রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত পুলিশ দেখতে চেয়েছেন। ৮৬.২ শতাংশ মানুষ দেখতে চেয়েছেন নিরপেক্ষ ও আইনের প্রতি অনুগত পুলিশ। ৮৪ শতাংশ মানুষ দুর্নীতিমুক্ত পুলিশ দেখতে চেয়েছেন।
এ ছাড়া ৭৮.৮ শতাংশ মানুষ জবাবদিহিমূলক, ৭৫.২ শতাংশ মানুষ জনবান্ধব, ৭৫ শতাংশ মানুষ দক্ষ ও আধুনিক এবং ৭০.১ শতাংশ মানুষ মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল পুলিশ দেখতে চেয়েছেন।
কোন কোন ক্ষেত্রে সংস্কার খুব জরুরি মনে করেন? এমন প্রশ্নের জবাবে সবচেয়ে বেশি ৮৯.৫ শতাংশ মানুষ পুলিশকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের অবসান চেয়ে মতামত দিয়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে পুলিশের দুর্নীতি বন্ধ চেয়েছেন ৭৭.৯ শতাংশ মানুষ।
গুম ও বিচারবহির্ভুত হত্যাকাণ্ডের মতো চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী পুলিশকে জবাবদিহি ও শাস্তির আওতায় আনার পক্ষে মত দিয়েছেন ৭৪.৯ শতাংশ মানুষ।
বিগত কর্তৃত্ববাদী সরকারের আমলে ‘গায়েবি বা ভুয়া মামলা’ দিয়ে বিরোধী দলমত দমন করে আইনের অপব্যবহারের সংস্কৃতি চালু করেছিল পুলিশ। আইনের এই অপরাধ রোধে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৮৯৮ এর সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংস্কার চেয়েছেন ৯৫ শতাংশ মানুষ। ৫ শতাংশ মানুষ এই ধারা সংস্কার চাননি।
শতকরা ৮২.৫ শতাংশ মানুষ ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারার বিধানকে সহজে অপব্যবহারযোগ্য বলে মনে করেন। ৪৬.২ শতাংশ মানুষ ধারাটির যুগোপযোগী সংস্কার চান। এক্ষেত্রে ৩৯.৭ শতাংশ মানুষ উচ্চ আদালতের সুপারিশমতে ৫৪ ধারা সংশোধনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন।
রাতের বেলা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাসায় তল্লাশির সময় পরিচয় দিতে অস্বীকার করলে বা বিনা সার্চ ওয়ারেন্টে তল্লাশি করতে চাইলে তার প্রতিকার হিসেবে একটি কার্যকর কল সার্ভিস চালুর পক্ষে মতামত দিয়েছেন ৮৭ শতাংশ মানুষ। অভিযানের সময় জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম ও ভিডিও রেকর্ডিং ডিভাইসসহ পোশাক পরিধানের ওপর জোর দিয়েছেন ৭৭.৪ শতাংশ মানুষ।
রাতের বেলায় বাসা তল্লাশি করার ক্ষেত্রে ম্যাজিস্ট্রেট বা স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি অপরিহার্য করার প্রতি জোর দিয়েছেন ৭৫ শতাংশ মতামতদাতা।
পুলিশের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের তদন্তের জন্য একটি স্বাধীন সংগঠনের মাধ্যমে তদন্তের পক্ষে মতামত দিয়েছেন ৬০ শতাংশ মানুষ বর্তমানে পুলিশের বিরুদ্ধে এই ধরনের অভিযোগ তদন্তে স্বাধীন কোনো সংগঠন নেই।
পুলিশকে জবাবদিহি ও বিভিন্ন প্রভাবমুক্ত রাখার লক্ষ্যে একটি নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বা কমিশনের পক্ষে মতামত দিয়েছেন ৫৮.৯ শতাংশ মানুষ। অন্যদিকে সাংবিধানিক কাঠামোর আওতায় পুলিশের জন্য স্বধীন ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠার পক্ষে মতামত দিয়েছেন বাকি ৪১.১ শতাংশ মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
পুলিশ সংস্কারে জনগণের আকাঙ্ক্ষা পুরোপুরি পূরণ করতে হলে বাহিনীটির ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ওমর ফারুক।
তার মতে, পুলিশের যেসব বিষয় সংস্কারের প্রত্যাশা জনগণ করছে, সেটি স্বল্প সময়ে পূরণ করা কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং। এর জন্য সময়ের প্রয়োজন। তবে এই অল্প সময়ের মধ্যে কীভাবে মৌলিক পরিবর্তনগুলো করা যায় এবং এর জন্য কী কী করণীয় হতে পারে সেটা যাচাই- বাছাইয়ের সুযোগ আছে।
দলীয় সরকারের অধীনে পুলিশের সংস্কার বাধাগ্রস্ত হতে পারে আশঙ্কা করে তিনি বলেন, পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ এবারই প্রথম নেওয়া হয়নি। এর আগেও স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপগুলো ২০০৬-২০০৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক সরকারের আমলে মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগগুলো আর কার্যকর হয়নি।
এখন বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার হয়তো পুলিশ সংস্কার করতে চাইছে, কিন্তু পরবর্তীতে যে রাজনৈতিক দল সরকার পরিচালনা করবে, তারা সেটা চাইবে কি না, সেটা নিয়ে আমি সন্দিহান।
শুধু সংস্কার উদ্যোগ নয়, পুলিশকে জনবান্ধব করতে তাদের নিজেদেরও মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন বলে মনে করেন এই অপরাধ বিজ্ঞানী।
তিনি বলেন, পুলিশ বাহিনী নিজ থেকে যদি তাদের মানসিকতার পরিবর্তন না করে, তাহলে সংস্কার করে খুব বেশি লাভ হবে না। পুলিশকে জনবান্ধব করতে যদি সঠিক কাঠামোগুলো তৈরি করা না যায়, তাহলে যতই সংস্কারের জন্য আইন ও নীতিমালা তৈরি করি—সেগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। সুতরাং, পুলিশকে জনমানুষের করতে বর্তমান অন্তবর্তী সরকার যদি পূর্ণাঙ্গ সংস্কার বা মৌলিক পরিবর্তন করে যেতে পারে, তাহলে হয়তো পুলিশ মানুষের হয়ে ওঠার একটা পর্যায়ে যেতে পারে। তা না হলে সংস্কার আলোর মুখ খুব একটা দেখবে বলে মনে হচ্ছে না।
পুলিশ যা বলছে
তবে পুলিশ সংস্কারের কাজ যদি যথাযথ ও কাঙ্ক্ষিত গতিতে হয় তাহলে সেটি জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করবে বলে মনে করছে পুলিশ বাহিনী।
পুলিশ সংস্কারে সম্পৃক্ত পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত উপ-মহাপরিদর্শক (এডিশনাল ডিআইজি) মো. জালাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী বাংলানিউজকে বলেন, পুলিশ বাহিনীর সংস্কার সম্ভব কিংবা অসম্ভব সেটা সময়ই বলে দেবে। কারণ সম্ভব কিংবা অসম্ভব—এটার সঙ্গে সবার সামগ্রিক সহযোগিতার বিষয়টি সম্পৃক্ত। আমরা চাই, পুলিশ জনগণের আয়, জীবন ও সম্পদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। সেটি সুন্দরভাবে পেশাদারত্ব, সততা ও দক্ষতার সাথে করার জন্য যে বিষয়গুলো দরকার, সেই বিষয়গুলো বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছি। এখন সেই বিষয়গুলো যদি যথাযথভাবে প্রতিফলিত বা বাস্তবায়িত হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই প্রত্যাশা করছি, একটি কাঙ্ক্ষিত মানের সেবা জনগণ পুলিশের কাছ থেকে পাবে।
পুলিশ সংস্কার কমিশন যা বলছে
পুলিশ সংস্কারের স্বল্পমেয়াদি, মধ্যম মেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা ভাবছে কমিশন। কমিশনের সদস্য ও পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. গোলাম রসুল বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের কমিশনের কাজই হচ্ছে জনআকাঙ্ক্ষার পরিপূরকরূপে সুপারিশ দেওয়া। সেই জায়গা থেকে আমরা তিন ধরনের সুপারিশ দেব। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি। যেই সংস্কারটি হয়তো এই মুহূর্তে করা সম্ভব, সেটা এখনই করা হবে। যেটা এখন সম্ভব না বা লম্বা সময় লাগতে পারে, ৫-৭ বছর, সেটা আমরা দীর্ঘমেয়াদিতে রাখব। আসলে সংস্কারগুলোর কিছু হয়তো অন্তর্বর্তী সরকার করবে, স্বল্পমেয়াদি যেগুলো সম্ভব। আর বাকি অংশগুলো পরবর্তী সরকার করবে। আমরা সুপারিশমালা সেভাবেই দেব।
তিনি আরও বলেন, পুলিশ সংস্কার নিয়ে আমরা কাজ করছি। ইতোমধ্যে আমরা পুলিশকে সুপারিশের একটি খসড়াও দিয়েছি। এগুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে। এগুলো নিয়ে আমরা অংশীদারদের সঙ্গে বসব। তখন জনমত জরিপ ও অংশীদারদের মতামত নিয়ে আমরা একটা সুপারিশমালা তৈরি করব।
পুলিশ কমিশন গঠন করতে পারলে পুলিশ সংস্কার সম্ভব হবে বলে প্রত্যাশা করেন ডিআইজি মো. গোলাম রসুল।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন