ঢাকা-খুলনা মহাসড়কে ফরিদপুর শহরের প্রবেশমুখে বদরপুরের বাড়িটির নাম ‘আফসানা মঞ্জিল’। পাশাপাশি বাংলো প্যাটার্নের তিনটি বাড়ি নিয়ে আফসানা মঞ্জিল। ইতালিয়ান মার্বেল পাথরে তৈরি এই বাড়িতে এখন কেউ নেই। এখানে একটি সমাধিও আছে। যদিও এটিতে এ পর্যন্ত কাউকে সমাহিত করা হয়নি। বাড়িটি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বেয়াই খন্দকার মোশাররফ হোসেনের।
অভিযোগ রয়েছে, বিলাসবহুল এ বাড়ি নির্মাণে খাসজমি, এমনকি সংখ্যালঘুদের জমিও দখল করেছেন খন্দকার মোশাররফ। আওয়ামী লীগের আমলে এসব দখল নিয়ে ভয়ে কেউ কথা না বললেও এখন অনেকে মুখ খুলছেন।
২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ সরকারের তিন মেয়াদে সংসদ সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশাররফ। প্রথমবার শ্রমমন্ত্রী, পরেরবার প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী এবং সর্বশেষ স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি আর লুটপাটের অভিযোগ। বহুল আলোচিত দুই হাজার কোটি টাকার মানি লন্ডারিংয়ের মামলায় তাঁর সহযোগীদের অনেকে এখনো কারাগারে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সম্প্রতি বদরপুরে সরেজমিনে দেখা যায়, গাছগাছালিতে ঢেকে থাকা আফসানা মঞ্জিলের প্রকৃত রূপ আসলে বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। বড় গেট মাড়িয়ে পিচ ঢালা পথ পেরিয়ে তবেই দেখা মেলে বাংলো প্যাটার্নের এই দৃষ্টিনন্দন বাড়ির। বাড়ির সামনের উঠোনে সরকারি প্রটোকলের গার্ড অব অর্নার নেওয়ার জন্য পতাকার স্ট্যান্ড-সংবলিত বেদি রয়েছে। রয়েছে ছোট্ট একটি চিড়িয়াখানা। এর এক পাশে এই সমাধিসৌধ। উত্তর-পূর্বে গরুর খামার। এর পেছনে ফসলি খেত। অভিযোগ রয়েছে, খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সেখানে মাত্র দুই বিঘা জমি ছিল, এখন রয়েছে প্রায় ৪০ বিঘা। এসব জমি তিনি জোর করে কবজায় নিয়েছেন।
খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
খন্দকার মোশাররফ হোসেন। ছবি: সংগৃহীত
সম্প্রতি আফসানা মঞ্জিলের পেছনের অংশে বাউন্ডারি তুলে জমি ঘেরাওয়ের কাজ শুরু হলে স্থানীয়দের সঙ্গে বিরোধ বাধে। সেখানে লাইট হাইজ এজি চার্চ নামের একটি প্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য বাড়ির মালিকদের যাতায়াতের রাস্তা আটকে দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে খন্দকার মোশাররফের বিরুদ্ধে।
বদরপুরের বাসিন্দা স্যামুয়েল বাড়ৈ নামের একজন ভুক্তভোগী জানান, জমি দখলের জন্য একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন তিনি। এরা অতিশয় নিরীহ প্রতিবেশীদের ওপর নির্মম নির্যাতনের পর জোর করে জায়গাজমি লিখে নিত। জমির মালিকদের বাড়ি ছেড়ে দিতে দিনরাত হুমকি দিত। কখনো হামলা চালিয়ে বাড়িঘর এমনকি মানুষদের কুপিয়ে যেত। যারা লিখে দিতে চাইত না, তাদেরটা জোর করেই লিখে নিতেন তিনি। আবার না লিখে দিলে জোর করেই জমি অবৈধভাবে দখল করতেন।
জেলা খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক উজ্জ্বল ঘোষ বলেন, ‘বাড়ির পুকুরের ঘাটলায় ডেকে নিয়ে জমি লিখে দিতে হতো মোশাররফকে। আমাদের একটি চার্চের জমিও তিনি লিখে নিতে অনেক চাপ দিয়েছিলেন। কিন্তু ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ রাখায় জমিটি রক্ষা করতে পেরেছি। অনেকে তা পারেননি। রুস্তম শেখ নামের এক ব্যক্তির প্রায় দেড় একর জমি লিখে নেওয়ার পর সেই শোকে লোকটি একপর্যায়ে মারা যান।’
বদরপুরের জেমস বৈদ্য নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, তাঁদের ৪২টি পরিবারের দেড় একর জমি লিখে নিতে রামদা নিয়ে হামলা করে মোশাররফের সন্ত্রাসী বাহিনী। তিনি ও তাঁর স্ত্রী এ ঘটনার পর স্ট্রোকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।
প্রশান্ত কুমার রায় নামের এক ব্যক্তি বলেন, তাঁর ৩ শতাংশ জমি জোর করে দখলের পর গরুর খামার বানিয়ে রেখেছেন সাবেক এই মন্ত্রী। আরেকজনের ৫ শতাংশ জমিও জোর করে দখল করে রেখেছেন। এখনো তাঁর লোকজন ওই সব জমির প্রকৃত মালিকদের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে।
আছে রংমহল ও অন্যান্য
সদর উপজেলার ডিক্রিরচরে নামে-বেনামে কয়েক শ বিঘা জমির ওপর রয়েছে মোশাররফের আরেকটি বাংলো বাড়ি। যেটি স্থানীয়দের কাছে ‘রংমহল’ হিসেবে পরিচিত। দেশ-বিদেশ থেকে শিল্পী এনে বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো সেখানে। বাড়িটিতে যাওয়ার জন্য চরের বুকে সরকারি টাকায় করা হয়েছে রাস্তা।
এদিকে ফরিদপুর শহরের দক্ষিণ কালীবাড়িতে রাজেন্দ্র কলেজসংলগ্ন পৈতৃক বাড়ির পাশেও জায়গা দখল করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তিনি অরুণ কুমার গুহ নামের এক হিন্দু ব্যক্তির দ্বিতল ভবনসহ তিন একর জমি দখল করেন। ‘দয়াময় ভবন’ নামের বাড়িটি নতুন করে সংস্কারের পর নাম রাখা হয়েছে তাঁর বাবা খন্দকার নুরুল হোসেন নুরু মিয়ার নামে ‘নুরুল ভিলা’। উল্লেখ্য, এই নুরু মিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। তাই রাজাকার বলে ডাকা হয় তাঁকে। এই বাংলোবাড়ির বর্তমান মূল্য ৮০ কোটি টাকার বেশি বলে জানা গেছে।
এসব ব্যাপারে খন্দকার মোশাররফ হোসেন বা তাঁর পরিবারের বক্তব্য জানতে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁরা কেউ দেশে না থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি। পরে খন্দকার মোশাররফ হোসেনের আস্থাভাজন একজন নারী প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হলে তিনি তাঁর মোবাইল থেকে কথা বলিয়ে দেন খন্দকার মোশাররফের জামাতা সাবেক সংসদ সদস্য কায়েদ-ই-মিল্লাতের সঙ্গে। তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন, ফরিদপুরে তাঁর শ্বশুর খন্দকার মোশাররফ হোসেনের এসব সম্পত্তির সব বৈধ কাগজপত্র রয়েছে। কারও জায়গাজমি দখল করে নেননি তাঁরা। আর যে রাস্তা দেয়াল তুলে আটকে দেওয়া হয়েছে, সেটিও তাঁর শ্বশুরের মালিকানাধীন।
কায়েদ-ই-মিল্লাত আক্ষেপ করে বলেন, ‘এখন আমাদের ক্ষমতা নেই, তাই ওরা ক্ষমতা দেখাচ্ছে। যদি কোনো দিন সময় আসে, আমরাও জবাব দিব।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন