‘নর্থবেঙ্গল জুট মিলস (প্রা.) লি.-এর নামে ঋণ নিয়ে বিদেশ পালিয়েছেন মিলটির চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। ব্যাংকের টাকা শোধ না করায় রুগ্ণ ও খেলাপিতে নাম ওঠে প্রতিষ্ঠানটির। এরপর কৌশলে মিলটি দুদফা বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন তিনি। প্রথম ক্রেতা তরুণ প্রবাসী মাহবুবুর রহমান মালিকানা ও শেয়ার নেওয়ার পরও মিলটি চালু করে টিকতে পারেননি। অবৈধভাবে মিলটি দখলে নেন বিক্রেতা আবুল কাশেম। কারণ আবুল কাশেম আওয়ামী লীগের রংপুর মহানগরের যুগ্ম আহ্বায়ক। রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে দ্বিতীয় আরেকজনকে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময় দখল দিয়েছেন। তবে জুলাইয়ে ঘটনার পর তিনি আত্মগোপনে চলে যান। যদিও মিলটি দ্বিতীয় মালিক নুরুল ইসলাম ডাবলু চালু করলেও প্রথম ক্রেতা এখন রাস্তায় ঘুরছেন।
মিলের চাকা নতুন করে ঘুরলেও খেলাপি ঋণের বড় অংশই এখন অনাদায়ী। এ বিষয়ে প্রথম ক্রেতা অভিযোগ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টার কাছে।
মিলটি ঘিরে স্থায়ী ও অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞাসহ এ পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে। একটির তদন্ত করছে পুলিশ ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (পিবিআই)।
জানতে চাইলে পিবিআই রংপুর পুলিশ সুপার এবিএম জাকির হোসেন যুগান্তরকে জানান, একটি মামলা তদন্ত চলছে। আমার দেখা মতে, এই রুগ্ণ শিল্প চালু করতে প্রথম ক্রেতা পক্ষ ও অর্থায়নকারী জনতা ব্যাংক এবং মালিক পক্ষ একমত হয়েছিলেন। কিন্তু ব্যাংকের নির্ধারিত সময়ে টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। ফলে মালিক আবুল কাশেম প্রথম ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেন। যদিও ক্রেতা মাহবুব হোসেন বন্ধ মিলটি চালু করেছিলেন। পরে দ্বিতীয় একটি পক্ষের কাছে বিক্রি করে দেন। এখন তদন্ত শেষে বলা যাবে এখানে কী ঘটছে।
সূত্র মতে, অর্থ উপদেষ্টার কাছে দেওয়া চিঠিতে প্রথম ক্রেতা মাহবুব হোসেন বলেছেন, ২০২২ সালে পহেলা আগস্ট নর্থ বেঙ্গল জুট মিলের সাবেক সব পরিচালক মো. ওয়াহেদ শাহ চৌধুরী, চেয়ারম্যান আবুল কাশেম, ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলরাম শাহর উপস্থিতিতে বোর্ড সভায় মিলটি বিক্রির চুক্তি কার্যবিধি পাশ করা হয়। এরপর ২৫ আগস্ট আমার প্রতিষ্ঠান ওয়েফেয়ার বাংলাদেশ লিমিটেডের সঙ্গে নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে বিক্রয় চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এই চুক্তির আওতায় মিলের জমি মডগেজ ৩৬০ শতাংশসহ ৩৯৪ শতাংশ জমি, মেশিনারিজ ছিল। পরবর্তীতে নন জুডিশিয়াল স্টাম্পে এফিডেফিট করে নোটারি পাবলিকের মাধ্যমে ১১৭ নম্বর ফর্মে মিলের পরিচালক আবুল কাশেমের ৪৯৫০০টি শেয়ার, বলরাম শাহার ৪৯৫০০টি শেয়ার ক্রেতা মাহবুবুর রহমানের নিকট হস্তান্তর করা হয়। বাকি ওয়াহেদ শাহা চৌধুরীর ৫১ হাজার শেয়ারের মধ্যে ৩৬ হাজার শেয়ার মাহবুবুর রহমান, ৭৫০০ শেয়ার খালেদা পারভিন ও ৭৫০০ শেয়ার মাহফিজার রহমানের নিকট হস্তান্তর সম্পন্ন হয়।
জানতে চাইলে প্রথম ক্রেতা মাহবুবুর রহমান যুগান্তরকে জানান, শেয়ার হস্তান্তরের পর ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২৯ কোটি টাকা থেকে সুদ মওকুফ করে ৯ কোটি টাকা এককালীন পরিশোধের শর্তে ২ শতাংশ ডাউন পেমেন্ট ২০ লাখ ৫৪ হাজার ৫০০ টাকা জনতা ব্যাংকের শাখায় পরিশোধ করে মিলটি চালু করি।
যদিও ২০১২ সাল থেকে মিলটি বন্ধ ছিল। খেলাপি ঋণের নামে ব্যাংক থেকে ২১ কোটি টাকা নিয়েছে। খেলাপি ঋণের জন্য ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট শাখার ব্যর্থতা রয়েছে। সর্বশেষ খেলাপি ঋণের টাকা পুরোপুরি আদায় না হলেও মিলটি চলছে। অভিযোগ রয়েছে ব্যাংকের লাভের চেয়ে ব্যক্তি লাভের মনোবাসে আজ ব্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
জানা গেছে, তিন মাস বন্ধ মিলটি সংস্কার করে প্রায় ৩০ জন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে মেশিনারিজ ঠিক করে ১৬৫ জন শ্রমিক নিয়োগ দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেন মাহবুবুর রহমান। এতে সেখানে প্রায় পৌনে চার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে উৎপাদন শুরু করে পণ্য রপ্তানিও করেছেন। এরপর ১.৬২ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি আদেশ পেয়ে কাজ শুরু করেন। ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঋণ পরিশোধের সময়ের মধ্যে এ কার্যক্রম শুরু হলে লোভনীয় চোখ পড়ে বিক্রেতা আবুল কাশেমের। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মিলটি আরও বেশি মূল্যে বিক্রির জন্য নতুন একজন ক্রেতা ঠিক করেন চেয়ারম্যান আবুল কাশেম। সব নিয়ম ভেঙে দ্বিতীয় ক্রেতা নুরুল ইসলাম ডাবলুর কাছে মিলটি বিক্রি করেন।
প্রথম ক্রেতা মাহবুবুর রহমান বলেন, যখন বুঝতে পারছি রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মিলটি দ্বিতীয় স্থানে বিক্রির পাঁয়তারা করছে আবুল কাশেম তা ঠেকাতে রংপুর মিঠাপুকুর সিনিয়র সহকারী জজ আদালাতে মামলা করি। কিন্তু ওই সময় স্থানীয় এমপি জাকির হোসেন ও নাছিমা জামান ববি, সাবেক স্পিকার শিরীন শারমীন চৌধুরী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজা বকুল মিয়ার নাম ব্যবহার করে আবুল কাশেম আমার সব উদ্যোগ নষ্ট করে দেয়। এরপর আমাকে মিলটি তাদের কাছে ফেরত দেওয়ার প্রস্তাব পাঠালেও আমি নাকোজ করে দেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ব্যাংকসহ বিভিন্ন জায়গায় প্রভাব খাটিয়ে মিলটি দখল করে নেয়। বর্তমান দ্বিতীয় ক্রেতা নুরুল ইসলাম ডাবলু মিলটি পরিচালনা করছে।
যোগাযোগ করা হলে নুরুল ইসলাম ডাবুল যুগান্তরকে জানান, সব নিয়ম মেনে আমি মিলটি ক্রয় করেছি। ব্যাংকের ঋণ হিসাবে আমি নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করছি। কত টাকা ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে সেটি জানতে চাইলে তিনি তা জানাতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু একটি মিল ক্রেতা বিক্রেতার মধ্যে আদালতে মামলা থাকা সত্ত্বেও কিভাবে ব্যাংক তৃতীয়পক্ষের সঙ্গে চুক্তি করে সেটিও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
জানতে চাইলে অর্থায়নকারী জনতা ব্যাংকের রংপুর ভেতপট্টির করপোরেট শাখার এজিএম মো. শামীম আহমেদ যুগান্তরকে জানান, প্রথম পক্ষ ঋণ রিশিডিউল করেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তা পরিশোধ করতে পারেনি। ফলে মিলের প্রকৃত মালিক প্রথমপক্ষের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করেছেন। দ্বিতীয়পক্ষের সঙ্গে চুক্তির পর ব্যাংকের ঋণ দ্বিতীয় পক্ষ নিয়মিত পরিশোধ করে যাচ্ছেন। তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ে কর্মকর্তাদের অবহিত করেই কাজটি করা হয়েছে।
অবশ্য অর্থ উপদেষ্টার কাছে লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, ঋণ পরিশোধ মেয়াদ বাড়ানোর জন্য জনতা ব্যাংকের সাবেক এমডির কাছে জানানো হলে তিনি ছয় মাস সময় বাড়িয়ে তা বাস্তবায়নের জন্য রংপুর করপোরেট শাখার এজিএম শামীম আহমেদের সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এরপর শামীম আহমেদের সঙ্গে দেখা করলে সময় বৃদ্ধির আবেদনটি নিতে অস্বীকার করেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন