আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রিসভার এক নম্বর সদস্য ছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। এ কারণে আলাদা গুরুত্বও পেতেন। তবে মন্ত্রিপরিষদের এত বড় একটি সম্মানজনক পদ ধারণ করলেও তার কাজকর্ম ছিল একেবারেই বিপরীতে। তিনি নিজের মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় ব্যবহার করে একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতি করে গেছেন। এমন কি, টাকার বিনিময়ে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ প্রদানের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। স্থানীয়দের অভিযোগ, টাকার জন্য এমন কিছু নেই মোজাম্মেল হক করেননি। ফলে কয়েক মেয়াদে মন্ত্রী ও এমপি থাকাকালে তার সম্পদ ফুলেফেঁপে হয়েছে বহুগুণ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউপি চেয়ারম্যান থেকে পৌরসভার চেয়ারম্যান, এরপর এমপি নির্বাচিত হন আ ক ম মোজাম্মেল হক। ১৯৭৩ সাল থেকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ছিলেন ১৫ বছর। ১৯৮৯ সাল থেকে টানা চারবার পৌরসভার চেয়ারম্যান ও মেয়রের পদে ছিলেন। ২০০৮ সাল থেকে টানা চারবার এমপি হন, কখনও ভোটে, কখনও বিনাভোটে। টানা তিন মেয়াদে পান মন্ত্রিত্ব। গত ৫ আগস্ট ছন্দপতন ঘটেছে। বিভিন্ন থানায় মামলা হওয়ার পর গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি। শেখ হাসিনার কাছের হওয়ায় জেলার সবচেয়ে ক্ষমতাধর ও সুবিধাভোগী ছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল হক। অভিযোগ আছে, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার অভিপ্রায়ে ছাত্র জনতার ওপর হামলার অন্যতম কুশিলব ছিলেন মোজাম্মেল হক।
গাজীপুর মহানগরের বাসিন্দা হলেও মোজাম্মেল হক এমপি নির্বাচিত হয়েছেন কালিয়াকৈর থেকে। ২০১৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় এমপি হওয়ার পর মন্ত্রিসভায় জায়গা করে নেন। এরপর থেকেই দলীয় নেতাকর্মীর কাছে তিনি ভিন্ন এক মোজাম্মেল। ছিলেন গাজীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতিও। কমিটি, পদ ও মনোনয়ন বানিজ্য করে দুই হাতে কামিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা।
২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি হয়ে প্রথমে তার চোখ পড়ে জায়গা-জমির ওপর। তার নেতৃত্বে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় চলে জমি দখলের মহোৎসব। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হওয়ায় বিগত ১৫-১৬ বছর তার নেতৃত্বে গোটা গাজীপুরে চলে ত্রাসের রাজত্ব। অভিযোগ আছে, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী হওয়ায় নানা প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থের অপচয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি করে গেছেন তিনি।
ঘুষ, দুর্নীতি, নিয়োগবাণিজ্য, দখলবাজি করে তিনি শত শত কোটি টাকার মালিক হলেও চলতেন সাদামাটা সততার লেবাসে। আওয়ামী লীগ আমলে দেশে ৫০ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা বানানোর অন্যতম কারিগর ছিলেন তিনি। জেলা ও উপজেলায় বিরোধী নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার মামলা ও নির্যাতন সবই হতো আ ক ম মোজাম্মেলের কথামতো। দীর্ঘসময় পুলিশ সুপার পদে সাবেক ডিবিপ্রধান হারুনুর রশিদকে নিয়ে মানুষের ওপর চালিয়েছেন জুলুম নির্যাতন। পুলিশি সহযোগিতায় জুয়া, হাউজি ও মাদক সিন্ডিকেট থেকে কোটি কোটি টাকার চাঁদার ভাগ নেওয়ার অভিযোগ ছিল তার বিরুদ্ধে।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর একটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড ও ধর্ষণের অভিযোগ রয়েছে মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে। অভিযোগটি হচ্ছে, ১৯৭৪ সালে টঙ্গী এলাকায় এক নবদম্পতিকে বহনকারী একটি ট্যাক্সি থামায় একদল দুর্বৃত্ত। তারা বর ও ট্যাক্সিচালককে হত্যা করে এবং নববিবাহিত তরুণীটিকে তিন দিন আটকে রেখে ধর্ষণের পর হত্যা করে। এই হত্যা ও ধর্ষণের ঘটনায় নেতৃত্বে ছিলেন মোজাম্মেলন হক। এই অভিযোগ উঠে এসেছে লেখক-সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেহাসের আলোচিত ‘বাংলাদেশ : রক্তের ঋণ’ গ্রন্থে।
২০০৮ সালে মোজাম্মেল হক প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন। এরপর থেকে নিজ নির্বাচনী এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ না করে এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নানা প্রকল্প থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ ছাড়া উন্নয়নকাজ থেকে শতকরা ১০ ভাগ কমিশন আদায় করতেন তিনি।
ঝুট ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রক ছিলেন : জোঁকের মতো ঝুট ব্যবসা কামড়ে ধরেছিলেন আ ক ম মোজাম্মেল। কালিয়াকৈর পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক আহ্বায়ক আবদুল ওহাব মিয়া মোজাম্মেলের ঘনিষ্ঠজন। ৫ আগস্টের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ওহাব উড়াল দিয়েছেন কানাডায়। তিনি জানান, মন্ত্রীর নির্দেশে প্রতি মাসে কারখানাগুলো থেকে অর্ধ কোটি টাকা পর্যন্ত উঠত। এই টাকার কিছু অংশ দলের তৃণমূল পর্যায়, অর্থাৎ ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, থানা ও পৌর শাখার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে দেওয়া হতো। এই টাকা ৫ হাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্কের ছিল। টাকার অঙ্ক নির্ধারণ করে দিতেন মন্ত্রী নিজেই।
২০২২ সাল থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রতি মাসে মন্ত্রীর হাতে কখনও ১০ লাখ, কখনও ১৫ লাখ করে টাকা তুলে দিয়েছেন এক ব্যবসায়ী, যিনি এলাকায় ‘ঝুট আলামিন’ নামে পরিচিত। তিনি বলেন, ‘এই টাকা আমি নিজেই মন্ত্রীর কাছে জমা দিতাম। মোজাম্মেল হক নিয়মিত মাসোহারা তুলতেন এমন কারখানার সংখ্যা শুধু কালিয়াকৈরেই শতাধিক।’
স্থানীয় আওয়ামী লীগ সূত্রগুলো জানিয়েছে, মন্ত্রী হয়ে কালিয়াকৈরে এসব কারখানায় ঝুট ব্যবসার পাশাপাশি শ্রুমিকের ওপর সরাসরি প্রভাব বিস্তারকারীর তালিকায় যাদের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেনÑ আওয়ামী লীগের কালিয়াকৈর উপজেলা শাখার সভাপতি মুরাদ কবীর, সহসাধারণ সম্পাদক মো. রফিকুল ইসলাম তুষার, পৌর শাখার সভাপতি সরকার মোশারফ হোসেন জয়, সাধারণ সম্পাদক সিকদার জহিরুল ইসলাম জয়, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিকদার মোশারফ, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আকবর আলী, কালিয়াকৈর উপজেলা শাখার সদস্য মো. ফারুক শিকদার, সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সেলিম আজাদ, মৌচাক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও উপজেলা শাখার সদস্য হাজি লোকমান হোসেন।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী থাকার পরও আ ক ম মোজাম্মেল হক টাকার বিনিময়ে অসংখ্য ব্যক্তিকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সাবেক এই মন্ত্রীর এমন দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এরই মধ্যে মোজাম্মেল হকের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করেছে সংস্থাটি। দুদকের সূত্র মতে, মোজাম্মেল হক ক্ষমতার অপব্যবহার, অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন।
মোজাম্মেলের নামে গাজীপুরের বিভিন্ন মৌজায় প্রায় আট একর (৭৯২.৫৬ শতক) জমির খোঁজ মিলেছে। তার নামে গাজীপুরের জয়দেবপুরে তিনতলা ভবন এবং একই এলাকায় আরেকটি দোতলা ভবন রয়েছে। বিনিয়োগ রয়েছে বিভিন্ন ব্যবসায়। পাশাপাশি টাকা জমা রেখেছেন ব্যাংকে। গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে আ ক ম মোজাম্মেলে নানা ধরনের ব্যবসা।
ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থে আ ক ম মোজাম্মেল হক এসব সম্পদ ও ব্যবসা গড়ে তুলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় এসব অভিযোগের ব্যাপারে তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভভ হয়নি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন