আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন খাতের মতো স্বাস্থ্য খাতেও হয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। কেনাকাটা প্রক্রিয়ায় হয়েছে লুটপাট। এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে স্বাস্থ্যসেবায় ভোগান্তি ও চিকিৎসা ব্যয় বেড়ে যাওয়ার তথ্য উঠে এসেছে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতিবিষয়ক শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে। সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে হস্তান্তর করা হয় এ প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে কোনো মান নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। বিশেষ করে বেসরকারি হাসপাতালের লাইসেন্স প্রদান, বাতিল ও মান পর্যবেক্ষণের ক্ষেত্রে নেই কার্যকর ব্যবস্থা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে শুধু সুশাসনের অভাবই নয়, রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতি ও জবাবদিহির অভাব। এতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে দায়মুক্তির সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। কভিডের সময় এর সুস্পষ্ট প্রমাণ মিলেছে। হাসপাতালগুলোতে অত্যাবশ্যকীয় স্বাস্থ্যসেবা সামগ্রীর সরবরাহে সব সময়ই ঘাটতি থাকছে। কখনো কখনো এই নিয়মিত ঘাটতি দুর্নীতির দিকে নিয়ে যায়। টিআইবির গবেষণায় এর প্রতিফলন ঘটেছে। প্রকিউরমেন্ট সিস্টেমে বড় আকারের আর্থিক অপব্যবহার ও অদক্ষতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এমনকি হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ স্বাস্থ্য খাতে সীমাহীন দুর্নীতি নিয়ে তাদের পর্যবেক্ষণ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
শ্বেতপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, বিভিন্ন হাসপাতালের কাজে আউটসোর্সিং কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিষেবাগুলোর চুক্তিতে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ আছে। আউটসোর্সিং কর্মীদের পরিষেবাগুলো জনস্বাস্থ্য পরিষেবা সংস্থাগুলোর কাছে অসন্তোষজনক। এ ছাড়া সরকারি হাসপাতালে মানসম্পন্ন ডায়াগনস্টিক যন্ত্র থাকলেও সেগুলো পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য জনবল প্রায়ই থাকে না। ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার খরচ বেশির ভাগই অনিয়ন্ত্রিত। শ্বেতপত্রে বলা হয়, বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো রোগীদের পরীক্ষার ক্ষেত্রে কমিশন লিখে দেয়। স্বাস্থ্য পরিষেবা খাতে একটি সাধারণ অভ্যাস রয়েছে যে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো মেডিকেল প্রতিনিধিদের মাধ্যমে চিকিৎসকদের সঙ্গে একটি ভালো সম্পর্ক বজায় রাখে। যাতে তাদের ওষুধগুলো বাণিজ্যিক নামে (জেনেরিক নামে নয়) লেখা হয়। ফলে ব্যক্তির মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৭৬ দশমিক ৮৭ শতাংশ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে যায়। স্বাস্থ্য খাতে কৌশলগতভাবে পরিকল্পিত রোডম্যাপ না থাকায় বেসরকারি খাত একচেটিয়া মুনাফা করছে। ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলো কোনো গুণমান পরীক্ষা ছাড়াই শহরগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে এবং তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। এমনকি বাজারে ওষুধের মান ও দাম নিয়ে দেখা দিচ্ছে উদ্বেগ। শ্বেতপত্রে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যেসব পরিবার চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে স্বাস্থ্যসেবা নিতে গেছে, তাদের মধ্যে ৪৮ দশমিক ৭ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। গ্রামীণ এলাকায় এই হার ছিল ৪৫ শতাংশ এবং শহরাঞ্চলে ৫১ শতাংশ। সেবাগ্রহীতা পরিবারের মধ্যে প্রায় ৬ দশমিক ২ শতাংশকে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সময় ঘুষ দিতে হয়েছে, যার গড় পরিমাণ ছিল ৬৮০ টাকা। ওই গবেষণা অনুযায়ী সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ৩২ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করেছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে। তবে দুর্নীতির হার জেলা সদর/সাধারণ হাসপাতালে সর্বোচ্চ ছিল (৫২ দশমিক ৪ শতাংশ)। ঘুষের সর্বোচ্চ ঘটনা ছিল মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ১২ শতাংশ।
জরিপ অনুসারে, ঘুষের গড় পরিমাণ তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে কম জেলা সদর/সাধারণ হাসপাতালে ৭০৪ টাকা এবং কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোতে ১৭ টাকা করে ছিল। গবেষণা উদ্ধৃতি দিয়ে শ্বেতপত্রে আরও উল্লেখ করা হয়, যেসব পরিবার সরকারি স্বাস্থ্য সুবিধা থেকে সেবা পেয়েছে তারা বিভিন্ন সেবা গ্রহণের সময় দুর্নীতির সম্মুখীন হয়েছে। খাদ্য পরিষেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্নীতির হার সবচেয়ে বেশি ছিল (৬৬ দশমিক ৪ শতাংশ)। তারপর ২৭টি ট্রলি/হুইলচেয়ার পরিষেবা (৫৬ দশমিক ৫ শতাংশ), সেলাই, ব্যান্ডেজ এবং ড্রেসিং (৫৫ দশমিক ১ শতাংশ), সার্জিক্যাল অপারেশন পরিষেবা (৪৮ দশমিক ৫ শতাংশ) এবং কভিড টিকা নিবন্ধন বা টিকাকরণ (৪২ দশমিক ৮ শতাংশ। হাসপাতালে ট্রলি/হুইলচেয়ার ব্যবহার করে পরিষেবা গ্রহীতারা সবচেয়ে বেশি (৪৩ দশমিক ৬ শতাংশ) ঘুষ বা অননুমোদিত অর্থ প্রদানের শিকার হয়েছিল। এ ছাড়া সন্তান জন্মদান পরিষেবা এবং সি-সেকশন পরিষেবাগুলোর জন্য প্রতি পরিবারে গড়ে ২ হাজার ২৫৬ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল। শ্বেতপত্রে আরও বলা হয়, সরকারি হাসপাতালের বাজেট বরাদ্দ হয় শয্যা ও কর্মীর সংখ্যার ভিত্তিতে। বরাদ্দের সময় পরিষেবার গুণমান এবং অন্যান্য খরচের কারণগুলো পর্যাপ্তভাবে বিবেচনা করা হয় না, যা স্বাস্থ্যব্যবস্থায় অদক্ষতা এবং বৈষম্যের দিকে নিয়ে যায়। অনেক হাসপাতালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনার জন্য সীমিত অনুমোদন দিলেও বরাদ্দকৃত বাজেটের কার্যকর ব্যয় করা হয় না।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন