দেশের বাজারগুলোতে কয়েক বছর ধরে লাগামহীনভাবে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এক বছরের ব্যবধানে মোটা চাল, সয়াবিন তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু—এই পাঁচ পণ্যের দাম সর্বোচ্চ ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে খুচরা পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে। এ সময়ে নতুন করে ব্যয় বাড়লেও সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি। এতে নিত্যপণ্যের চড়া দামে চিড়েচ্যাপটা হওয়ার জোগাড় ভোক্তার।
দেশের বাজারে পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য সরকার পেঁয়াজ, আলু, ভোজ্য তেল, চিনি, চালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্ক-কর ছাড় দিয়েছে। এর পরও আমদানি বাড়েনি। বরং বাজারে বোতলজাত তেল, পেঁয়াজ, আলুসহ বিভিন্ন পণ্যের সংকট তৈরি হয়েছে। শুল্ক-কর কমানোয় সাধারণ মানুষ আশা করেছিল, বাজারে দাম অনেকটাই কমে আসবে।
বাস্তবে তা হয়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১৩.৮০ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে খাদ্যপণ্যের উৎপাদন ব্যয় ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি। মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধিতে এই দুটি বড় ভূমিকা রেখেছে বলেও তারা জানান।
সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) গতকাল বৃহস্পতিবার ও গত বছরের ৫ ডিসেম্বরের বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চালের বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদাসম্পন্ন মোটা চাল ব্রি-২৮ বা পাইজাম এক বছরের ব্যবধানে ৭ থেকে ৯ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে ৫৯ থেকে ৬৩ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
কম্পানিগুলো সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় এক মাস ধরে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট চলছে। এতে ভোক্তারা খোলা সয়াবিন তেলের ব্যবহার বাড়িয়েছে। খোলা সয়াবিন তেল কেজিতে ৮ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে লিটার ১৬৫ থেকে ১৬৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দেশি পেঁয়াজের দাম এক বছরে কেজিতে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বেড়ে মানভেদে ১১৫ থেকে ১৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
দেশি রসুন ১৫ থেকে ১৭ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে ২৩০ থেকে ২৮০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি দাম বেড়েছে আলুর। নিত্যপণ্যটির দাম কেজিতে এক বছরে ৪৫ থেকে ৬৭ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায় খুচরায় বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার মহাখালী কাঁচাবাজার, জোয়ারসাহারা, রামপুরা, বাড্ডাসহ বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, টিসিবির বাজারদরের সঙ্গে বাস্তবে পণ্যের দরের কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। একমাত্র আলু ছাড়া এই পাঁচটি পণ্যের চারটিই টিসিবির প্রকাশিত দরের চেয়ে কিছুটা বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা গেছে।
অর্থনীতিবিদ ও বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপে দরিদ্র ও স্বল্প আয়ের মানুষের বাজারে কেনাকাটা করা খুব কঠিন হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতি এক ধরনের কর, ধনী-গরিব-নির্বিশেষে সবার ওপর যা চাপ সৃষ্টি করে। কয়েক অর্থবছর ধরে চলা এই উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে।
রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সানোয়ার হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছি। ৯ বছরে আমার মাত্র চার হাজার ৮০০ টাকা বেতন বেড়েছে। ৯ বছর আগে অবিবাহিত ছিলাম, এখন দুই বাচ্চাসহ আমরা চারজন। সেই হিসাবে খরচ আগের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। বাসাভাড়া ও নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এখন পরিবার নিয়ে চলতে খুবই কষ্ট হয়। ব্যয় কাটছাঁট, এমনকি ধার করেও সামলাতে পারছি না।’
ভোক্তা স্বার্থ সংরক্ষণে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ভলান্টারি কনজিউমারস ট্রেনিং অ্যান্ড অ্যাওয়ারনেস সোসাইটির (ভোক্তা) নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘খাদ্যপণ্যের দাম গত কয়েক বছরে অস্বাভাবিক বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য নিম্নবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষ খুব কষ্টে আছে। অন্তর্বর্তী সরকার ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে বিভিন্ন নিত্যপণ্য আমদানিতে শুল্ক কমিয়েছে। কিন্তু এর প্রভাব বাজারগুলোতে দেখতে পাচ্ছি না। এতে শুল্কের সুবিধা ভোগ করছেন শুধু ব্যবসায়ীরা।’
বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেল নেই
বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সংকট বেড়েছে। ভোজ্য তেল সরবরাহকারী কম্পানিগুলো বাজারে বোতলজাত তেলের সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ ক্রেতারা। তারা বোতালজাত তেল না পেয়ে বাড়তি দরে খোলা সয়াবিন কিনে নিচ্ছে। অন্যদিকে বাজারে নতুন আলু ও পেঁয়াজ চলে আসার পরও চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে দেশি ও আমদানি করা পেঁয়াজ।
খুচরা বিক্রেতারা জানান, প্রায় এক মাস ধরে কম্পানিগুলো বাজারে ঠিকমতো তেল দিচ্ছে না। এখন হাতে গোনা দু-তিনটি কম্পানি ছাড়া অন্য কোনো ব্র্যান্ডের বোতলজাত সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না। যেসব ব্র্যান্ডের তেল পাওয়া যাচ্ছে, তা-ও চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত নয়। বিশেষ করে এক ও দুই লিটারের বোতলের সরবরাহ একেবারেই কম। বাজারে খোলা সয়াবিন ও পাম তেলের সরবরাহ ঠিক আছে। তবে খোলা সয়াবিন তেল আগের চেয়ে বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন খুচরা বাজার ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বিক্রেতাদের অভিযোগ, এখন দু-একটি কম্পানি সয়াবিন তেলের বোতল দোকানগুলোতে দিলেও তারা তেলের সঙ্গে বিভিন্ন পণ্য ধরিয়ে দিচ্ছে। অন্যান্য পণ্য না নিলে সয়াবিন তেলের বোতল দেওয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন খুচরা বিক্রেতারা।
রাজধানীর বাড্ডার মুদি দোকানদার আব্দুল গণি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই সপ্তাহ ধরে বেশির ভাগ কম্পানি তেল সরবরাহ সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছে। এই সুযোগে দু-একটি কম্পানি স্বল্প পরিমাণে বোতালজাত তেল দিলেও তার সঙ্গে আটা, লবণ, চিনিসহ বেশ কিছু পণ্য নেওয়ার শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। এসব কারণে বাজারের সব বিক্রেতাই কম্পানিগুলোর প্রতি বিরক্ত হয়ে আছে।’
ভোজ্য তেলের সংকটের বিষয়ে ভোক্তার নির্বাহী পরিচালক মো. খলিলুর রহমান সজল বলেন, ‘মূল্য সংযোজন কর কমানোসহ নানা সুবিধা দেওয়ার পরও ভোজ্য তেল সরবরাহকারী কম্পানিগুলো তেলের দাম না কমিয়ে উল্টো সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। এখনই যদি বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তাহলে এবারের রমজানে পরিস্থিতি আরো অস্বস্তিকর হতে পারে।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন