কমিউনিটি পুলিশিংয়ের মাধ্যমে প্রতিটি থানা এলাকায় জনসাধারণের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন ও অংশীদারত্বের ভিত্তিতে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে আসছে পুলিশ বাহিনী। এটি মূলত একটি গণমুখী, প্রতিরোধমূলক ও সমস্যা সমাধানে ‘পুলিশিং’ ব্যবস্থা হওয়ার কথা ছিল। তবে গত সরকারের আমলে এই ‘কমিউনিটি পুলিশিং’ নানা কারণে বিতর্কের জন্ম দেয়। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে কমিউনিটি পুলিশিংকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রত্যেক থানাকে নিজ নিজ এলাকায় কমিউনিটি পুলিশিংয়ের নাম পাল্টে ‘সিটিজেন ফোরাম’ নামে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ সূত্র বলছে, জনসচেতনতা বাড়াতে ও অপরাধ কমাতে এই ‘সিটিজেন ফোরাম’ পুলিশ ও এলাকাবাসীর মাঝে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করবে।
পুলিশ বাহিনীর সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সর্বস্তরের মানুষ পুলিশের কাজে সহযোগিতা, অপরাধবিরোধী সচেতনতা তৈরি, বাল্যবিবাহ রোধ, ইভটিজিং প্রতিরোধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, মাদকের কুফল, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধসহ সামাজিক মূল্যবোধ বাড়াতে কাজ করে থাকে। এছাড়া কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমের মাধ্যমে পুলিশ-জনগণের সম্পর্ক স্থাপন করে জনগণের আস্থা, অংশগ্রহণ, সহযোগিতা ও অংশীদারত্ব বাড়ানোর লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
মূলত ২০১৩ সালে পুলিশ সদর দফতরের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) অপারেশনের অধীনে স্বল্প পরিসরে শুরু করেছিল কমিউনিটি পুলিশিং। ২০১৪ সালে একজন সহকারী মহাপরিদর্শকের (এআইজি) তত্ত্বাবধানে পাবলিক সেফটি অ্যান্ড প্রিভেনশন (পিএস অ্যান্ড সিপি) শাখার কার্যক্রম শুরু হয়। এরপর কমিউনিটি পুলিশিংকে ‘বিট পুলিশিং’ নাম দেওয়া হয়েছিল।
পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, কমিউনিটি পুলিশিং গঠনের উদ্দেশ্য ছিল জনসাধারণের সঙ্গে পুলিশের সম্পর্ক স্থাপন এবং সমাজের অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা। অথচ বিগত সরকারের আমলে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কমিটিতে বেশিরভাগ সদস্য ছিলেন আওয়ামী লীগের লোক। ফলে বিগত সময়ে বিরোধী দল দমন ছাড়া এ কমিটি আর কোনও ভূমিকা রাখেনি। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর কমিউনিটি পুলিশিংয়ের সব কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে। ৫ আগস্টের পর পুলিশ সদর দফতর থেকে কমিউনিটি পুলিশিংয়ের বদলে নতুন করে প্রতিটি থানায় নাগরিক কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘জাতীয় নাগরিক কমিটি’ নামে আত্মপ্রকাশ করায় থানাভিত্তিক ‘নাগরিক কমিটি’র বদলে ‘সিটিজেন ফোরাম’ নামে কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
থানা পুলিশের সূত্র বলছে, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের কাজের সঙ্গে সমাজের স্বচ্ছ ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও বিগত সরকারের আমলে অপরাধীরা সেসব কমিটির সদস্য ছিল। তাই বর্তমানে সতর্কতার সঙ্গে যাচাই-বাছাই করে স্বচ্ছ এবং ক্লিন ইমেজের লোকদের নিয়ে কমিটি করা হচ্ছে। সেখানে প্রতিটি থানা ও ওয়ার্ডের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মসজিদ ও মাদ্রাসার ইমাম, এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, স্থানীয় ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং আইনজীবীদের নিয়ে এই সিটিজেন ফোরাম গঠন করা হচ্ছে।
জানা যায়, সরকার পরিবর্তনের কারণে এ বছর (২০২৪) ‘কমিউনিটি পুলিশিং ডে’ পালিত হয়নি। সর্বশেষ ২০২৩ সালে ঢাকাসহ সারা দেশে ৪৯ হাজার ৫২৯টি কমিউনিটি পুলিশিং কমিটিতে ৮ লাখ ৯৪ হাজার ২০৬ জন সদস্য ছিল। এবার নতুন করে সিটিজেন ফোরাম নামে কমিটি গোছাতে কাজ করছে পুলিশ।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কয়েকটি থানার ঘুরে জানা যায়, রাজধানীর বেশিরভাগ থানায় সিটিজেন ফোরামের কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরইমধ্যে কোনও কোনও থানা ফোরামের সভাও করেছে। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার সিটিজেন ফোরামের সদস্য সংখ্যা ৩০ জন। এই কমিটিতে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, মসজিদের ইমাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে যুক্ত করা হয়েছে।
এ বিষয়ে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) গাজী শামীমুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সিটিজেন ফোরামের মাধ্যমে থানা এলাকার নাগরিকদের সঙ্গে পুলিশের সুসম্পর্ক স্থাপন করা হচ্ছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কমিটির সদস্যদের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং সচেতনমূলক কার্যক্রম শুরু হচ্ছে।’
রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থানা এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসিসিসি) ৫৫, ৫৬ ও ৫৭ নম্বর ওয়ার্ড অবস্থিত। এ থানায় চারটি সিটিজেন ফোরাম গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রতিটি ওয়ার্ডে ১২ সদস্যের ওয়ার্ড কমিটি এবং ৩২ সদস্য নিয়ে ফোরামের থানা কমিটি করা হয়েছে। কমিটির কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে কামরাঙ্গীরচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. আমিরুল ইসলাম বলেন, ‘থানা এলাকা বড় হওয়ায় চারটি ওয়ার্ড কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন স্যারদের নিয়ে কমিটির তিনটি বড় সভা হয়েছে। ছোট ছোট প্রায় ১০টি সভা করা হয়েছে। এসব সভার মাধ্যমে থানা এলাকার মানুষের সমস্যা সমাধানে সহায়তা এবং তাদের মাধ্যমে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।’
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিকালে তেজগাঁও থানা এলাকার নাগরিকদের সঙ্গে পুলিশের মতবিনিময় সভা করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)
সিটিজেন ফোরামের বিষয়ে ডিএমপি’র যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশের সঙ্গে জনসাধারণের সম্পর্ক স্থাপন এবং অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছিল। তবে সরকার পরিবর্তনের কারণে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের কিছুটা দূরত্ব তৈরি হওয়ায় কমিউনিটি পুলিশিংকে ‘সিটিজেন ফোরাম’ নাম দেওয়া হয়েছে। আগের তুলনায় কিছুটা পরিবর্তন এবং নতুনত্ব থাকছে সিটিজেন ফোরামে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সিটিজেন ফোরামে যুক্ত করা হচ্ছে। এছাড়া কমিটির কার্যক্রম তদারকি করতে থাকছে আলাদা কমিটি, যাতে কমিটির কোনও সদস্য অপরাধে সম্পৃক্ত হতে না পারেন। পাশাপাশি তাদের মাধ্যমেও থানা-পুলিশের কার্যক্রম তদারকি করা হবে।’
জানতে চাইলে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স) ইনামুল হক সাগর বলেন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং অপরাধ দমনে পুলিশ এবং জনগণের পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। সে লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ে ‘সিটিজেন ফোরাম’ গঠনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
সিটিজেন ফোরামের গুরুত্ব
অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের গুরুত্ব রয়েছে। স্থান ও অঞ্চল ভেদে অপরাধের ধরনেও ভিন্নতা রয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশ সদস্য কম থাকায় অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন। ফলে সিটিজেন ফোরামের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও অপরাধীদের শনাক্ত করা সহজ হয়ে থাকে। এ ব্যাপারে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সরকার পতনের পর ঢাকাসহ দেশের প্রতিটি জেলার পুলিশে রদবদল হয়েছে। ফলে এখনও অনেক পুলিশ সদস্যের এলাকা ও অপরাধীদের সম্পর্কে তথ্য জানার ঘাটতি রয়েছে। এ অবস্থায় সিটিজেন ফোরামের মাধ্যমে পুলিশের কার্যক্রম সহজ হবে।’
সিটিজেন ফোরাম কতটা কার্যকর
পুলিশ সূত্র জানায়, সাধারণত আইনি সহায়তার প্রয়োজন ছাড়া সাধারণ মানুষের থানার আসার প্রয়োজন হয় না। আর আইনি সহায়তার জন্য পুলিশের কাছে আসে ৫-১০ শতাংশ মানুষ। বাকি ৯০-৯৫ শতাংশ মানুষ পুলিশের সংস্পর্শে আসেন না। ফলে কমিউনিটি বা বিট পুলিশিং কার্যক্রম চালুর আগে পুলিশ বা থানায় যেতে সাধারণ মানুষের মধ্যে অস্বস্তিবোধ ছিল। পুলিশের সংস্পর্শে না থাকায় পুলিশের কর্মপরিধি এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন না তারা। সিটিজেন ফোরামের মাধ্যমে পুলিশের সঙ্গে সাধারণ মানুষের মাঝে সেতুবন্ধন গড়ে উঠছে। ফলে যেকোনও দরকারে সাধারণ মানুষ পুলিশের পাশে থেকে তাদের কাজকে সহজ করতে পারছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন