কৃষকদের ফসল উৎপাদনে উৎসাহ দিতে স্বল্প সুদ ও সহজ শর্তে ঋণ দিচ্ছে সরকার। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্মকর্তাকে খুশি করতে না পারলে মেলে না এই ঋণ। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়। কৃষকদের এই ঋণ পেতে ৬.৮২ শতাংশ ঘুষ দিতে হয়েছে, যার পরিমাণ দুই হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা।
কৃষিঋণ পেতে ২৫০০ কোটি ঘুষ
কৃষিঋণের নামে নেওয়া এসব টাকা পুরোপুরি কৃষি খাতে ব্যবহার না করারও অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে উঠে এসেছে কৃষিঋণ পেতে কৃষকদের দুর্ভোগ এবং ব্যাংক কর্মকর্তাদের দুর্নীতির চিত্র। এক সমীক্ষায় উঠে এসেছে ঘুষ লেনদেনেরও চিত্র।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়।
এই ঋণ পেতে কৃষকদের ৬.৮২ শতাংশ পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়েছে। সে অনুযায়ী বছরে প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকা ব্যাংক কর্মকর্তাদের ঘুষ হিসেবে দিতে হয়েছে। তবে প্রতিবেদনে এটাও বলা হয়েছে, কৃষিঋণের মাত্র ৫৪ শতাংশ প্রকৃতপক্ষে কৃষিতে ব্যবহার করা হয়।
এ বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যদি কৃষিঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে, তাহলে সেটা খুব ঘৃণ্য বিষয়।
যারা গরিব কৃষকদের চাপে ফেলে এমন ঘুষ নেয়, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে বিষয়গুলো আমাদের পর্যায় পর্যন্ত আসে না।’
ফসল উৎপাদনে কৃষকদের উৎসাহ দিতে প্রতিবছর কৃষিঋণের পরিমাণ বাড়াচ্ছে সরকার। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়। এ জন্য ৬.৮২ শতাংশ অর্থাৎ দুই হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে কৃষকদের।
আগের বছর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩২ হাজার ৮২৯ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৮ হাজার কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার ১৩ শতাংশ বেশি কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়েছিল।
হাসিনা সরকারের পতনের পর গত ২৯ আগস্ট নীতিমালা অনুযায়ী চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্য ঠিক করা হয় ৩৮ হাজার কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ৯ শতাংশ বেশি। চাহিদা বিবেচনায় চলতি অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ১২ হাজার ৬১৫ কোটি টাকা এবং বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো ২৪ হাজার ১২১ কোটি টাকা এবং বিদেশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এক হাজার ২৬৪ কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। মোট ঋণের অর্ধেক বা ৫০ শতাংশ দেবে ব্যাংক নিজেই। বাকি অর্ধেক দেওয়া হবে এনজিওর মাধ্যমে।
দেশের সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, কৃষি পেশায় যুক্ত কর্মী তিন কোটি ১৭ লাখ ৮০ হাজার। দেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১২ শতাংশ। মোট রপ্তানিতে কৃষিজাত পণ্যের শরিকানা প্রায় ৩ শতাংশ। এর সঙ্গে হিমায়িত মৎস্য ও পাটজাত দ্রব্য যোগ করা হলে মোট রপ্তানিতে কৃষির হিস্যা প্রায় ৭ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে জানানো হয়, দেশে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে জিডিপির প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ঋণপ্রবাহের জরুরি বিবেচনায় নিয়ে ব্যাংকগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৩৮ হাজার কোটি টাকা কৃষি ও পল্লী ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।
স্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার ন্যূনতম ৫০ শতাংশ কৃষি ও পল্লী ঋণ নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এবং আবশ্যিকভাবে ওই লক্ষ্যমাত্রার ৬০ শতাংশ শস্য ও ফসল খাতে, ১৩ শতাংশ মৎস্য খাতে এবং ১৫ শতাংশ প্রাণিসম্পদ খাতে বিতরণ করতে হবে।
শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে সরকার কৃষিঋণের সুদের হারের সীমা ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮ শতাংশ করার জন্য একটি মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন করেছে, ফসল এবং ফসলের ক্ষেত্রের জন্য ৪ শতাংশ কম সুদের হারে ঋণ প্রদান করে। ২০২৪ সালের মধ্যে কুটির, মাইক্রো ও ছোট উদ্যোগগুলোতে ৫০ শতাংশ এসএমই ঋণ বরাদ্দ করার লক্ষ্যও রয়েছে ব্যাংকগুলোর জন্য, যার উদ্দেশ্য কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং গ্রামীণ আয় বাড়ানো। দুর্ভাগ্যবশত এটা লক্ষ করা গেছে যে রাজনৈতিক নেতারা এবং দুর্নীতিবাজ আমলারা তাদের অবৈধ সম্পদকে বৈধ করার উপায় হিসেবে কৃষিকে শোষণ করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষি খাতে সরকার সবচেয়ে কম বরাদ্দ দিলেও এই খাত ১৭ কোটি মানুষের খাদ্যের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খাতটি সবচেয়ে দরিদ্র ও স্বল্প শিক্ষিত ব্যক্তিদের জীবিকা নির্বাহের জন্য অত্যাবশ্যক। কিন্তু এই খাত ব্যাপক ঘুষ ও চাঁদাবাজি দ্বারা জর্জরিত। এতে কৃষির সম্ভাবনা কমছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, সরকারি ডিলারদের সার বিতরণে দুর্নীতি আমন মৌসুমে সারের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা ৫৯ শতাংশ হ্রাস করে। এতে প্রান্তিক কৃষকদের বৃহৎ কৃষকদের তুলনায় সার সম্পর্কিত দুর্নীতির কারণে ব্যাপক ক্ষতি হয়।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন