বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর উত্তরায় এক যুবককে হেলমেট পরে শটগান থেকে বেপরোয়াভাবে গুলি ছুড়তে দেখা যায়। পরে জানা যায়, তিনি তুরাগ থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মুরতাফা বিন ওমর ওরফে সাথিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, তাঁর ছোড়া গুলিতেই সবচেয়ে বেশি হতাহতের ঘটনা ঘটে। ৪ আগস্ট ও ১৯ জুলাই তাঁর গুলিতে অন্তত ২০ জন আহত হন। তাদের মধ্যে সাতজন মারা গেছেন।
উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি হাফিজুর রহমান সমকালকে বলেন, আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর সাথিল গুলি চালিয়েছেন– এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে তাঁর গুলিতে কতজন হতাহত হয়েছেন, সে সংখ্যা এখনও নিরূপণ করা যায়নি। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, উত্তরায় আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতাকর্মী মাঠে ছিলেন, তাদের অন্যতম সাথিল। ১৯ জুলাই বিকেল সাড়ে ৩টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আজমপুর থেকে ক্রিসেন্ট হাসপাতাল পর্যন্ত এলাকায় তাঁকে এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে দেখা যায়। সেদিন তাঁর গুলিতে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়। তাদের একজন ২৯ বছর বয়সী গাড়িচালক মো. আসাদুল্লাহ। তিনি তুরাগের বাউনিয়া বেড়িবাঁধ এলাকায় থাকতেন। সেদিন তিনি গলায় গুলিবিদ্ধ হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২২ জুলাই মারা যান। একই দিন জুবায়ের বেপারি (১৯) নামে এক শিক্ষার্থী উত্তরা-৭ নম্বর সেক্টরে বুকে গুলিবিদ্ধ হন। ঘটনাস্থলেই তাঁর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া অজ্ঞাতপরিচয় দু’জনের নিথর দেহ উদ্ধার করে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক তাদের মৃত ঘোষণা করেন।
উত্তরায় আন্দোলনকালে হতাহতদের তথ্য সংগ্রহ, তালিকা তৈরি ও প্রামাণ্যচিত্র তৈরিতে কাজ করছে নবগঠিত সংগঠন ‘জুলাই রেভল্যুশনারি অ্যালায়েন্স’। সংগঠনের আহ্বায়ক সালেহ মাহমুদ রায়হান বলেন, ১০-১৫ জনের একটি দল এই কাজ করছে, যাদের সবাই আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। সহযোদ্ধাদের প্রতি দায় থেকেই আমরা স্বেচ্ছাসেবা হিসেবে তথ্য সংগ্রহ করছি। আমাদের তথ্য অনুসন্ধান, প্রত্যক্ষদর্শী ও আহতদের বর্ণনায় দেখা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ নেতা সাথিলের গুলিতে অন্তত সাতজন মারা গেছেন। তাঁর ব্যবহৃত শটগানটির মালিক সাবেক এমপি হাবীব হাসানের ভাই আলাউদ্দিন আল সোহেল। তিনি নিজেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন– এমন ছবি ও ভিডিও পাওয়া গেছে।
৪ আগস্টের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বস্ত্র প্রকৌশলী তালহা জুবায়ের বলেন, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আজমপুরের আমীর কমপ্লেক্সের সামনে সাবেক সংসদ সদস্য হাবীব হাসানসহ আওয়ামী লীগের ১০-১৫ জন নেতাকর্মী ছিলেন। আমি একা তখন পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলাম। ওই সময় ছাত্ররা বিএনএস সেন্টারের সামনে জড়ো হন। এর পর তারা ধাওয়া দিলে আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায়। তবে এর কিছুক্ষণ পরই সাথিলসহ অস্ত্রধারী একটি দল ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠের দিক থেকে এগিয়ে আসে। আপডেট টাওয়ারের দিক থেকে আসে আরেক দল। দুই দলকেই ধাওয়া দেয় ছাত্ররা। এতে ওরা কিছুটা পিছিয়ে যায়। এর পর সাথিল গুলি ছুড়তে ছুড়তে এগিয়ে আসেন। সামনেই ছিলেন ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কার্গো শাখার বিক্রয় ব্যবস্থাপক মাহমুদুর রহমান খান সোহেল। তাঁকে কাছ থেকে গুলি করেন সাথিল। মাহমুদ ভাই লুটিয়ে পড়েন। এর পর তারা আরও এগিয়ে আসে। রবীন্দ্র সরণিতে কামারপাড়া হাই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মাহিনকে গুলি করলে সেও লুটিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে মাহমুদ ভাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ আগস্ট এবং মাহিন সেদিনই মারা যায়। তখন হেলমেট পরা সাথিলের পরিচয় জানতে পারিনি। পরে খোঁজ নিয়ে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে।
সেদিন আনারুল ইসলাম নামে এক সবজি ব্যবসায়ীও সাথিলের গুলিতে আহত হন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ৬ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থী ফয়সাল মাহমুদ বলেন, ১৯ জুলাই ছিল শুক্রবার। জুমার নামাজের পর উত্তরা-৭ নম্বর সেক্টর মসজিদ থেকে শিক্ষার্থীদের মিছিল বের হয়। পরে বিকেল ৪টার দিকে আজমপুর সড়কে শিক্ষার্থী ও হামলাকারী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মুখোমুখি হয়ে পড়ে। তাদের ১০-১২ জনের হাতে শটগান, কাটা রাইফেলসহ দেশীয় অস্ত্র ছিল। ওইখানে সাথিলসহ অন্যদের গুলিতে দু’জন আহত হন। পরে ৭ নম্বর সেক্টরের ২ নম্বর সড়কে এক জায়গাতেই দু’জন গুলিবিদ্ধ হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর তাদের মৃত্যু হয়।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে হত্যার অভিযোগে সাথিলের বিরুদ্ধে অন্তত ১১টি মামলা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন