পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেছেন, ৫ই আগস্টের পরে অনেক মিথ্যা মামলা হয়েছে। এসব মামলা নিয়ে বাণিজ্য হচ্ছে। তাই মামলায় নাম থাকলেই পাইকারিভাবে গ্রেপ্তার করা যাবে না। গতকাল পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। আইজিপি বলেন, মামলায় নিরীহ মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন, বাণিজ্য হচ্ছে, প্রতারণা হচ্ছে, ৫ই আগস্ট ঘিরে এসব হচ্ছে। পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করা যাবে না। নিরীহ মানুষকে হয়রানি করা পুলিশের কাজ না। যদি মামলার আসামি করা হয় তাকে ধাওয়া করে গ্রেপ্তার করা যাবে না। জনগণের সঙ্গে পুলিশকে বিনয়ী আচরণ করতে হবে। পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হলে জনবান্ধব পুলিশ বাহিনী হয়ে উঠবে বিশ্বাস আমার।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ৫ই আগস্টের পরে কেউ যদি ইচ্ছাকৃত বা উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা মামলা করে থাকেন, জেনেশুনে জীবিত মানুষকে মৃত বলে মিথ্যা মামলা করে থাকেন, জীবিত মানুষকে মৃত বলে চালিয়ে দেন, তাহলে আইন-বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে। ২১১ ধারা অনুযায়ী বিচারের মুখোমুখি হতে হবে সেই বাদীকে। এটাই আমাদের অনুসরণ করা উচিত। আমরা সেটাই চেষ্টা করবো। মামলায় বলা হয়েছে মারা গেছেন। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে মারা যায়নি। এক্ষেত্রে বাদী যদি না জেনে, না বুঝে মামলা করে থাকেন তাহলে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগ আসবে না। সেই মামলায় শুধু ফাইনাল পুলিশ রিপোর্টই হবে। কেউ প্রতারিত হবেন না, যদি মনে করেন নিজের কোনো ইন্ধন বা সংশ্লেষ নেই তাহলে সরাসরি পুলিশের কাছে আসুন। আমরা বিনা যুক্তিতে বা তদন্ত ছাড়া পাইকারি হারে গ্রেপ্তার করবো না। মামলা থাকলেই বা নাম থাকলেই গ্রেপ্তার করতে হবে আইনেও তা নেই। এটা যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে যে, আপনি জড়িত বা অপরাধী। যারা নিরীহ এবং মনে করছেন কোনো ধরনের সংশ্লিষ্টতা নেই হয়রানি করার জন্য মামলায় নাম দেয়া হয়েছে, তারা এগিয়ে আসুন। আমরা আপনাদের বক্তব্য নিয়ে এগিয়ে যাবো। চার্জশিট বা ফাইনাল রিপোর্ট দেবো। সেখানে নিরীহরা বাদ যাবেন।
পুলিশ মহাপরিদর্শক বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদ হওয়া প্রত্যেকের পরিবারের কাছে পুলিশের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করে ক্ষমা চাই। যারা আহত হয়েছেন তাদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করি। এই আন্দোলনের সময় ফ্যাসিবাদী সরকারের স্বার্থরক্ষায় পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা বাড়াবাড়ি ও আইন ভঙ্গ করেছেন। অনেক নিরপরাধ পুলিশ সদস্যও নিহত হয়েছেন। আমি প্রত্যেক শহীদ পরিবারের কাছে আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করি।
পুলিশ সদর দপ্তর তদন্ত করছে, যেসব পুলিশ কর্মকর্তার বিভিন্ন মামলায় ও ঘটনায় জড়িত থাকার বিষয়ে নাম এসেছে তারা কোথায়? তাদের বিষয়ে পদক্ষেপ কী হবে? তাদের দায় আপনারা পেয়েছেন কিনা? জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, গণমাধ্যমে অনেকের নাম পেয়েছি। আমরা নিজেরাও তদন্ত করছি। আমরা তাদের অবস্থান বের করতে পারিনি। এটা চলমান প্রক্রিয়া। কে কোথায় আছেন সেটা স্পষ্ট নয়। দেশের ভেতরে থাকলে আইনের আওতায় আসবে যদি অবস্থান চিহ্নিত করতে পারি। আর যদি বাইরে থাকেন তাহলে বিধিগত প্রক্রিয়া আছে। আমরা প্রযুক্তিগত সক্ষমতা অনুযায়ী চেষ্টা করছি। তাদের দায় এখনো প্রমাণিত হয়নি। সেটা তখনই বলা যাবে যখন মামলার তদন্ত শেষ হবে। তবে তাদের দায় তো ছিলই। তারা কেউই দায় এড়াতে পারবেন না। তারা তো সশরীরে থেকে পুলিশকে কমান্ড করেছেন। আইনি প্রক্রিয়া তো আছে। সব তথ্য প্রমাণ দিয়েই তাদের দায় নিরূপণ করা হবে। এবং আদালত তথ্যপ্রমাণই দেখেন।
আন্দোলনে এতগুলো মানুষ মারা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে কেন এশিয়ার ইতিহাসেও এমন ঘটনা নেই উল্লেখ করে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, এমন একটা ঘটনা ও পরিবর্তনের পর আমাদেরও সক্ষমতায় কিছুটা ব্যতিক্রম ঘটেছে। সব জায়গায় সঠিক লোক দিয়ে আমরা শেষ করতে পারিনি। আমাদের পুনর্গঠনের কাজটা কিন্তু চলমান। বদলি হচ্ছে। তদন্ত করতে পারে সেরকম সক্ষম লোকদের বাছাই করে এই কাজে পুনরায় দায়িত্ব দেয়া, সারা দেশে বিভাগ অনুযায়ী আলাদা মেন্টরিং ও মনিটরিং কমিটি করেছি। ঊর্ধ্বতন এবং অভিজ্ঞ, যারা বিপুল অভিজ্ঞতা নিয়ে অবসরে গেছেন তাদেরকেও আমরা সঙ্গে নিয়ে আটটা জায়গায় আলাদা মনিটরিং টিম করেছি। প্রতি থানায় মামলাগুলোর তদন্তকারী কর্মকর্তাকে গাইড ও মনিটরিং করার কাজ করবেন। যারা তদন্ত করছেন তাদের দক্ষতা আশানুরূপ নয়। আমার বিশ্বাস তদন্তের মানটা বাড়বে। আর যারা পালিয়েছেন তাদের আমরা লোকেট করতে পারবো।
আইজিপি বলেন, এ দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা আমার প্রধান দায়িত্ব। পুলিশের মনোবল ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে কাজ চলছে। জনগণের সঙ্গে বিনয়ী ব্যবহার করতে হবে। সংস্কারের মাধ্যমে পুলিশকে জনবান্ধব করতে হবে। রাজারবাগে যেসব পুলিশ সদস্যরা বিদ্্েরাহ করেছিল গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে তাদের যেমন দাবি, তেমনি আমাদের প্রত্যেকের দাবি, পুলিশকে রাজনীতি থেকে, রাজনৈতিক ব্যবহার থেকে মুক্ত করতে হবে। এটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা, পরামর্শ সুপারিশ গেছে সংস্কার কমিশনের কাছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পুলিশ বাহিনীকে যেন আর ব্যবহার করা না হয়। আর এটা সম্ভব এই সরকারের পক্ষেই।
বর্তমান পুলিশ কর্মকর্তারা কোনো রাজনৈতিক দলের হয়ে ব্যবহৃত হচ্ছে কিনা? সামনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তার নিরাপত্তায় পুলিশ প্রস্তুত কিনা জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, এখন বাহিনীকে সক্রিয় ও সদস্যদের মধ্যে কাজের স্পৃহা তৈরি করা হচ্ছে। সামনের সপ্তাহ থেকে বিভাগে বিভাগে সফর করবো। ফোর্সের সদস্যদের হতাশা, চাওয়া-পাওয়ার কথাগুলো জানতে চাই। কারণ তাদের মধ্যেও অনেক ক্ষোভ আছে।
তিনি বলেন, আমরা নির্বাচনের স্টেপে যেতে পারিনি। আমি এতটুকু ব্লাংক চেক দিতে পারি যে, দেশে নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য পুলিশি সাহায্য করার মতো পূর্ণ ক্ষমতা আমাদের আছে। এর আগে কেয়ারটেকার সরকারের আমলে তিনটা নির্বাচন হয়েছে। সেখানে দেখেছেন আমরা পারি। সেই পুলিশের অনেকে এখনো আছেন, কিছু পরিবর্তন হয়েছে, নতুনরা এসেছে। আমি মনে করি পুলিশ খুব ভালোভাবে সক্ষম। যেসব পুলিশ সদস্য আন্দোলনে মারা গেছেন তাদের পরিবারকে পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হচ্ছে। হত্যার ঘটনায় আইনের আশ্রয় পুলিশ নেবে কিনা, আইনি আশ্রয় না নিলে পুলিশের মনোবলে ঘাটতি তৈরি হতে পারে কিনা- জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, আইন তো সবার জন্যই সমান। হত্যাকাণ্ড বা যেকোনো অপরাধ। আইনের আওতায় আদালতের বিচারের আওতায় আসা উচিত। আমরা সেভাবেই করবো। সেভাবেই হয়ে আসছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত আইজি (প্রশাসন) মো. আলমগীর আলম, অতিরিক্ত আইজি (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. আকরাম হোসেন, অতিরিক্ত আইজি (এইচআর) আবু নাছের মোহাম্মদ খালেদ, ডিআইজি (অপারেশনস) মো. রেজাউল করিম, ডিআইজি (কনফিডেন্সিয়াল) মো. কামরুল আহসান।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন