বুক ভরা সাহস নিয়ে স্বপ্ন দেখতেন বৈষম্যহীন দেশ গড়ার। সেই সুযোগও পেয়ে গিয়েছিলেন। যার অংশ হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। ১৭ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরের আন্দোলনে মাথায় ভয়ংকরভাবে আহত হন। এরপর থেকেই নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র তথা আইসিইউ-তে। এটা রিকশাচালক ও বর্তমানে বাকহীন মাহবুব আলমের গল্প; যার নামের আগে ‘হতভাগা’ মাহবুব বললেও ভুল হয়তো ভুল হবে না।
সাড়ে ৩ লাখ টাকা শোধ হবে কীভাবে? বসতভিটা বিক্রি করায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে কোথায় যাবেন পরিবার নিয়ে? তিন সন্তান ও স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে কে? আর কখনো কি সুস্থ জীবনের স্বাদ নিতে পারবেন নিম্ন আয়ের এই পরিবারের অভিভাবক মাহবুব আলম? এত সব প্রশ্নের উত্তরে কিছুই জানাতে পারেননি সাথী বেগম।
বুধবার (৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে দেখা হয় মাহবুবের সঙ্গে। প্রশ্ন করলে অপার দৃষ্টিতে শুধু তাকিয়ে থাকেন; হাত-পা ছুঁড়েন কিছুক্ষণ পর। পাশেই বসা ছিলেন স্ত্রী সাথী বেগম; যিনি অনেকটা বিদ্রুপ করেই বললেন, ‘সাড়ে চার মাসেও তার স্বামীর আন্দোলন যেন শেষ হয়নি। বেডে বসে বসে এখনও আন্দোলন করছেন।’ তবে খানিক পরেই সযত্নে প্রাণের স্বামীর পরনের কাপড় ঠিক করে দিচ্ছিলেন। তৃষ্ণা পেয়েছে বুঝতে পেরে পাইপের সাহায্যে একটু একটু করে খাইয়ে দিচ্ছিলেন পানি।
সাথী জানান, ১৭ জুলাই আহত হওয়ার পর চিকিৎসার জন্য মাহবুব আলমকে প্রথমে মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখানে ৮ দিন এবং পরে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আরও ১ মাস ৩ চিকিৎসা নেন। এই সময়ে মাহবুবের জন্য পরিবারের খরচ হয় সাড়ে ৬ লাখ টাকা। চিকিৎসার খরচ যোগাতে গ্রামের বাড়ি ভোলায় বসত ভিটা বিক্রি করে ৩ লাখ টাকা এবং আরও সাড়ে ৩ লাখ টাকা ধার করে আনেন মাহবুব আলমের স্ত্রী।
‘ডাক্তাররা বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন। হাসপাতাল থেকে ডাক্তার জানিয়েছেন, এই হাসপাতালে তার (মাহবুব আলমের) আর কোনো চিকিৎসা হবে না। কিন্তু আমি কোথায় যাব বলেন? কার কাছে যাব? এতগুলো টাকার দেনা শোধ করবে কে? চিকিৎসার জন্য বসতবাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছি। গিয়ে থাকব কোথায়?— সাথী বেগম, আহত রিকশাচালক মাহবুব আলমের স্ত্রী
বর্তমানে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি মাহবুব; যার পরিবারে রয়েছেন দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তান। এরমধ্যে ছোট ছেলের বয়স মাত্র ১ বছর ৯ মাস। দুই কন্যা সন্তান হিফজ পড়ছেন মাদ্রাসায়। বয়স ৮ ও ৫ বছর। কিন্তু আহত হওয়ার সাড়ে চার মাস পার হলেও চিকিৎসাধীন মাহবুব আলমের সুস্থতা নিয়ে ডাক্তাররা নিশ্চিত নন। দেশের বাইরে নিয়ে গেলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কতটুকু সে বিষয়েও জানা নেই কারও। তাই বিদেশে যাওয়ার বিষয়টিও অনিশ্চিত দরিদ্র এই রিকশা চালকের। স্ত্রী সাথী বলেন, ‘ডাক্তার জানিয়েছেন, বাকি জীবন এভাবেই কাটাতে হবে। কিন্তু আমি চাই তার চিকিৎসা চলুক।’
যদিও ধার করা সাড়ে ৩ লাখ টাকা শোধ হবে কীভাবে? বসতভিটা বিক্রি করায় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলে কোথায় যাবেন পরিবার নিয়ে? তিন সন্তান ও স্ত্রীর ভরণপোষণের দায়িত্ব নেবে কে? আর কখনো কি সুস্থ জীবনের স্বাদ নিতে পারবেন নিম্ন আয়ের এই পরিবারের অভিভাবক মাহবুব আলম? এত সব প্রশ্নের উত্তরে কিছুই জানাতে পারেননি সাথী বেগম। জানান, এই সব বলে কি লাভ? প্রশ্নগুলো এখন অবান্তর তার কাছে। গত সাড়ে চার মাসে কোনো কথা বলতে পারেননি মাহবুব আলম। স্বামীর মুখের উচ্চারিত একটি শব্দই যেন তার মনের শান্তির খোরাক।
মাহবুব আলম সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ভর্তি হন গত ১৫ সেপ্টেম্বর। সেদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলমের সাথে দেখা হলে তিনি ৫০ হাজার টাকা অনুদান জোগাড় করে দেন। এর বাইরে আর কোনো সহযোগিতা পাননি দরিদ্র এই রিকশা চালকের পরিবার।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিবেদক মাহবুব আলমের সাথে কথা বলতে চাইলে শুধু অপলক তাকিয়ে থাকতে দেখেন এই আন্দোলনকারীকে। শ্বাসক্রিয়া নিশ্চিতের জন্য ডাক্তার গলার নীচ দিয়ে একটা পাইপ বসিয়ে দিয়েছেন। এভাবেই বেঁচে আছেন তিনি। স্ত্রী সাথী বেগম জানান, ‘ডাক্তাররা বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন। হাসপাতাল থেকে ডাক্তার জানিয়েছেন, এই হাসপাতালে তার (মাহবুব আলমের) আর কোনো চিকিৎসা হবে না। কিন্তু আমি কোথায় যাব বলেন? কার কাছে যাব? এতগুলো টাকার দেনা শোধ করবে কে? চিকিৎসার জন্য বসতবাড়িটাও বিক্রি করে দিয়েছি। গিয়ে থাকব কোথায়?’
সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) ট্রমা সেন্টার এন্ড বার্ন ইউনিটের ১ নং ওয়ার্ডের ডিউটিরত ডাক্তারদের সাথে কথা বললে তারা জানান, ‘মাহবুব আলমের বিষয়ে ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নেবেন। তার চিকিৎসা কতটুকু সম্পন্ন হবে কিংবা আদৌ তিনি সুস্থ জীবনে ফিরবেন কিনা এ বিষয়গুলো এখনো নিশ্চিত নয়।’
বর্তমানে পরিবারের ভরণপোষণ কীভাবে চলে জানতে চাইলে সাথী বেগম বলেন, ‘আমার বাবা চায়ের দোকানে কাজ করে সংসার চালান। তিনি কিছু কিছু সহযোগিতা করেন। এর বাইরে আমার ভাইয়েরাও রিকশা চালান। তারাও কিছু সহযোগিতা করেন। কিন্তু এভাবে কতদিন?’
দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে একাধিকবার কথা বলতে চাইলেও মাহবুব আলম কোনো সাড়া দেননি। তিনি প্রতিবেদকের দিকে অপলক চেয়ে ছিলেন। সাথী বেগমের একটাই প্রত্যাশা, ‘আমার স্বামীর জন্য সবাই একটু দোয়া করবেন। যেকোনো মূল্যে তার সুস্থতা ফিরে আসুক সেটাই প্রত্যাশা।’
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন