বিভিন্ন বিষয়ে পরিসংখ্যান ও উপাত্ত সংগ্রহ করা স্ট্যাটিস্টার এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভারতে বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশ থেকে বেশি অপতথ্য উৎপাদিত হয়। এইসব অপতথ্য, অন্য কথায় ফেক নিউজ বা ভুয়া সংবাদ মূলত অনলাইনের মাধ্যমে ছড়িয়ে ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানো হয়।
আধুনিক দুনিয়ায় সব দেশেই অপতথ্যের সমস্যা আছে। অনলাইনের যুগে অপতথ্য সংক্রামক ব্যাধির মতো ছড়িয়েছে। এখন সত্য মিথ্যা যাচাই করা কঠিন। তবে আল-জাজিরার সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা গেছে যে, ভারতে এর মাত্রা অবিশ্বাস্যই শুধু না, রীতিমতো পরিকল্পিত একটি শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছে। গত ১৫ বছর ধরে বিতর্কিত শ্রীবাস্তব গ্রুপ শয়ে শয়ে ভুয়া মিডিয়া আউটলেট এবং ভুয়া বিশেষজ্ঞ বানিয়ে অপতথ্য ছড়িয়েছে। খরচ করেছে কোটি কোটি রুপি। এসবের মাধ্যমে তারা পাকিস্তানকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ভয়ংকর রূপে দেখাতে চেয়েছে। অপতথ্য দিয়ে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিরূপ মনোভাব তৈরি করতে চেয়েছে।
ইইউ ডিসইনফোল্যাব বলছে, এই নেটওয়ার্কটি এ যাবৎকাল পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় মিসইনফরমেশন নেটওয়ার্ক।
ভারতের অপতথ্যের রাজনীতির নতুন শিকার বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য স্বৈরাচার হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া, হাসিনার আমলে এদেশকে করদরাজ্য ভাবা ভারত, হাসিনার পতনের পর থেকে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগেছে। প্রতিদিন সে দেশের মিডিয়া শয়ে শয়ে অপতথ্য ছড়াচ্ছে যেখানে বাংলাদেশের হিন্দুদের নির্যাতনের অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশকে ইসলামী জঙ্গিবাদের দেশ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।
বাংলাদেশের এক হিন্দু নেতার গ্রেপ্তারের পর কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূতভাবে তা নিয়ে ভারত সরকার মন্তব্য করেছে। সেই নেতার অনুসারীরা একজন মুসলিম আইনজীবীকে পিটিয়ে হত্যা করেছে। অথচ, বাংলাদেশের মানুষ, বিশেষত মুসলিমরা দারুণ ধৈর্য দেখিয়ে এই ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গড়াতে দেয়নি।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে নিষ্পেষণ করা ভারতের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এদেশের মানুষ বীতশ্রদ্ধ। খুনি হাসিনার পতনের পর তা না কমে আরো বেড়েছে। তথাপি, বাংলাদেশের সরকার বা জনগণ শিষ্টাচারের সীমা ছাড়ায়নি। দেশের কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভারতীয় পতাকার আদলে আঁকা প্রতিচ্ছবিকে পদদলিত করায় বহু বাংলাদেশি প্রতিবাদও করেছে।
অথচ, ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা করেছে যা স্পষ্টত আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের উপর আঘাত। সে দেশের রাজনৈতিক নেতারা বাংলাদেশ নিয়ে ঘৃনাবাদী মন্তব্য করছে। এর সঙ্গে কতিপয় ছাত্রের শিষ্টাচার লঙ্ঘনের কোনো তুলনাই চলে না। অপতথ্যর চ্যাম্পিয়ন ভারত অবশ্য সমস্ত রকম ভব্যতার ঊর্ধ্বে চলে গেছে।
কিন্তু, এর বিপরীতে বাংলাদেশের এই নোংরা কাঁদায় নামার সুযোগ নেই। বরং এতোদিন পর্যন্ত উসকানিকে মেজাজ না হারানো বাংলাদেশের সামনে সুযোগ এসেছে অপতথ্যের বিরুদ্ধে সত্যের পক্ষে ঐতিহাসিক লড়াই করার। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও মানুষকে এখন অপতথ্যের বিরুদ্ধে সত্য নিয়ে দাঁড়াতে হবে। এই দাঁড়ানো মাঝে মাঝে কষ্টকর এবং কখনো কখনো প্রচণ্ড কঠিন। কিন্তু, এখনো পর্যন্ত বাংলাদেশ সেই পরীক্ষায় দারুণ করছে।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, মনে রাখতে হবে যে বাংলাদেশের মানুষের শত্রু ভারতের শাসক গোষ্ঠী, সে দেশের জনগণ নয়। বরং অপতথ্যর এই রাজনীতির শিকার সে দেশের জনগণ, যাদের জীবনযাত্রার মান এখনো মর্মান্তিক। বলাই বাহুল্য, তাদের অভাব-অনটন আর অধিকারের রাজনীতি থেকে ভুলিয়ে রাখতেই অপতথ্য দিয়ে ঘৃণা ছড়ানো হয়। কখনো পাকিস্তান, কখনো বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে আধাপেটা, অধিকারবিহীন মানুষকে বুঁদ রাখা হয়। যেই মিডিয়া বাংলাদেশ নিয়ে অবিশ্রান্তভাবে অপতথ্য ছড়াচ্ছে, তারা ঋণের দায়ে আত্মহত্যা করা কৃষক, লংমার্চ করে নিজের অধিকার বুঝে নেওয়া কৃষক, বঞ্চিত শ্রমিক, জাতপাত আর জাতি ঘৃণায় প্রান্তিক হয়ে থাকা মানুষদের নিয়ে হোলদোল দেখায় না।
ফলে, অপতথ্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই কেবল বাংলাদেশকে নয়, এই উপমহাদেশের আপামর মেহনতি মানুষের জন্য একটা আলোর দিশা, অপরাজনীতির নেশা কাটানোর জ্বলজ্বলে প্রদীপ হয়ে থাকবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন