মাদক বাণিজ্যে কোটিপতি আর সেবনে সংসারছাড়া
ধামরাইয়ে যুগান্তর প্রতিনিধির বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা
ঢাকার সাভারের বেদেপল্লির ৯ সাপুড়ে। পাঁচ বছর আগেও একদিন সাপের খেলা না দেখালে তাদের পরিবারের সদস্যদের অনাহারে-অর্ধাহারে থাকতে হতো। সেই সাপুড়েদের প্রত্যেকেই এখন কয়েক কোটি টাকার মালিক। আলাদীনের চেরাগের মতো তাদের হাতে রয়েছে ‘মাদকের চেরাগ’। মাদক বিক্রি করেই অল্প সময়ে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। সাভার, ধামরাই ও সিলেটে মূল্যবান জমি, একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট ও গোডাউন রয়েছে তাদের। যুগান্তরের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব তথ্য।
স্থানীয়রা জানান, বেদেপল্লির রুস্তম, আরিফ, ফরিদা, রাশেদ, শাকিল, বুলবুল, সেলিম, লস্কর ও আফছারের সংসার চলত সাপের খেলা দেখিয়ে। প্রতিদিন সকালে সাপের বাক্স নিয়ে বের হতেন। দিনশেষে যা জুটত তা দিয়ে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতেন। কিন্তু হঠাৎ কয়েক বছরের ব্যবধানে তারা প্রত্যেকেই অঢেল সম্পদের মালিক বনে যান। অথচ তাদের দৃশ্যমান কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য নেই। মাদক বিক্রি করেই তারা এত সম্পদ গড়েছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জনপ্রতিনিধি যুগান্তরকে বলেন, পরিবারের দুঃখ দূর করতে তারা মাদক বিক্রির পথ বেছে নেয়। প্রথমে অল্প মাদক নিয়ে কারবার শুরু করে। ব্যবসা ব্যাপক লাভজনক হওয়ায় তারা আস্তে আস্তে ব্যবসায় পরিসর বাড়াতে থাকে। একপর্যায়ে তারা অন্য বেদেদের নিয়ে দলবেঁধে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে ইয়াবা, গাঁজা, হেরোইন, কোকেন, ক্রিস্টাল মেথ ও আইস নামের ভয়ংকর মাদক এনে বেদেপল্লিতে পাইকারি দরে বিক্রি শুরু করে। যার ফলে তারা অল্প সময়ে কোটি টাকা আয় করে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রুস্তম মিয়া সাভারের বেদেপল্লির মৃত মকবুল মিয়ার ছেলে। মাদকের কারবার করে তিনি কয়েক বছরে সাড়ে ৮ কোটি টাকার সম্পদ ক্রয় করেছেন। সাভার পৌর এলাকার অমরপুর মৌজায় ২২৮, ২২৯ ও ২৩০নং দাগে ৩০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। সেখানে ৩৫টি কক্ষ নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন, যার আনুমানিক মূল্য ২ কোটি ৬০ লাখ টাকা। একই মৌজায় ১৮ শতাংশ জমি ক্রয় করে মার্কেট নির্মাণ করেছেন। মার্কেটে অন্তত ৮ থেকে ১০টি দোকান রয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য পৌনে ২ কোটি টাকা। এছাড়া অমরপুর মৌজায় আর এস ৪৫.৪৬ ও ৫৯ দাগে ২৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেন। যার মূল্য প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। সিন্দুরিয়া মৌজায় আর এস ৫৩১ নং দাগে ৩২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন, যার মূল্য প্রায় কোটি টাকা। ধামরাই বড়কুশিয়ারা মৌজায় কাজিয়ার কুন্ডু মহল্লায় আরএস ৮২৩ ও ৮২৮ নং দাগে ৬০ শতাংশ জমি ক্রয় করে। যার মূল্য ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বেদেপল্লির ফৈজুদ্দিনের মেয়ে ফরিদা। তিনি ক্রয় করেছেন প্রায় সোয়া ১০ কোটি টাকার সম্পদ। কাঞ্চনপুর মৌজায় আয়াত আলি মিস্ত্রির বাড়ির পাশে আর এস ৫.৬ ও ৭ নং দাগে জমি ক্রয় করেন ৮০ শতাংশ, যার মূল্য প্রায় ৬ কোটি টাকা। কাঞ্চনপুর ও খঞ্জনকাঠি মৌজায় আর এস ১৫ ও ১৬ নং দাগে ১৪ শতাংশ জমি ক্রয় করেন, যার মূল্য ১ কোটি ৪০ লাখ টাকা। বক্তারপুর কোটবাড়ি মৌজায় এমারত সাহেবের বাড়ির পাশে ২৬ শতাংশ জমি কিনে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন তিনি। ওই বাড়ির আনুমানিক মূল্য ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাড্ডা মহল্লার সলেমানের ছেলে আফছার সাভার ও ধামরাইয়ে বিপুল পরিমাণ সম্পদ ক্রয় করেছেন। যার আনুমানিক মূল্য ৯ কোটি টাকা। তিনি আরাপাড়া মৌজায় ১০ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করেন একটি বাড়ি। যার মূল্য ৩ কোটি ২০ লাখ টাকা। বক্তারপুর মৌজায় ১৬ শতাংশ জমির ওপর একটি বাড়ি নির্মাণ করেন, যার মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। কাঞ্চনপুর মৌজায় লস্কর মাতব্বরের বাড়ির পাশে ৩০ শতাংশ জমি ক্রয় করে ২৪টি রুমের একটি কলোনি নির্মাণ করেন, যার মূল্য ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা। এছাড়াও ধামরাই উপজেলার বড় কুশিয়ারা মৌজায় ৩ স্থানে কৃষিজমি ক্রয় করেন ২৮০ শতাংশ। যার মূল্য কোটি টাকার ওপরে। বেদেপল্লির আরিফ ১৪ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। সাভার নামা বাজারে ৪টি দোকান রয়েছে তার, যার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। বক্তারপুর মৌজা, নামা বাজার বাঁশপট্টির অপরদিকে ১৪ শতাংশ জমি ক্রয় করে ২টি গোডাউন নির্মাণ করেন, যার আনুমানিক মূল্য ৪ কোটি ২০ লাখ টাকা। খঞ্জনকাঠি মৌজায় মজিবর মার্কেটের সামনে ৩৬ শতাংশ জমি ক্রয় করে একটি মার্কেট নির্মাণ করেন। এর আনুমানিক বাজার মূল্য ৩ কোটি টাকা। কাঞ্চনপুর মৌজা, বেদেপল্লি এলাকায় আয়াত আলি মিস্ত্রিবাড়ির পাশে ১৮ শতাংশ জমি কিনে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন, যার মূল্য প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এছাড়া ধামরাই চৌটাইল মৌজায় আর এস ৩৫৭ ও ৩৫৮ নং দাগে ৪৫ শতাংশ জমি ক্রয় করেন, যার মূল্য প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টাকা।
অমরপুর এলাকার টান্নু মিয়ার ছেলে বুলবুল বেদেপল্লিতে বসবাস করলেও তার স্থায়ী ঠিকানা সিলেটের ছাতকে। বুলবুল মাদক বিক্রি করে সাভারে সাড়ে ৮ কোটি টাকার সম্পদ ক্রয় করেছেন। এছাড়া সিলেটের ছাতক এলাকায় চারটি স্থানে ১ একর ৫০ শতাংশ জমি ক্রয় করে ৫টি বাড়ি নির্মাণ করেছেন। অমরপুর মৌজায় বেদেপল্লিতে ৮ শতাংশ জমির ওপর গড়ে তুলেছেন ৪ তলার বিলাসবহুল বাড়ি। বাড়ির নাম আয়শা ভিলা। যার মূল্য প্রায় ৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা। একই মৌজায় আর এস ২১১ নং দাগে ৫ শতাংশ জমির ওপর নির্মাণ করেছেন আরও একটি বাড়ি, যার মূল্য প্রায় ৭০ লাখ টাকা। একই মৌজায় আর এস ৭৮ ও ৭৯ নং দাগে আশু মোল্লার বাড়ির পাশে ক্রয় করেছেন ১৮ শতাশ জমি, যার মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। সিন্দুরিয়া মৌজায় আর এস ৩১২ নং দাগে জমি ক্রয় করেন ৮ শতাংশ, যার মূল্য অর্ধকোটি টাকা। কাঞ্চনপুর মৌজায় আর এস ৯৮ এবং ১১৬নং দাগে ক্রয় করেছেন ২৪ শতাংশ, যার মূল্য ২ কোটি ২০ লাখ টাকা।
অমরপুর এলাকার রহিমের ছেলে রাশেদ মাত্র তিন থেকে চার বছরে ক্রয় করেছেন সাড়ে ৪ কোটি টাকার সম্পদ। তিনি অমরপুর মৌজায় আতাউর মেম্বারের বাড়ির পাশে আর এস ৩২৭ নং দাগে ৬ শতাংশ জমির ওপর দোতলা বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন, যার মূল্য প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। একই মৌজায় ঘোরাদিয়া ব্রিজের পাশে আর এস ২৩৩নং দাগে ৫ শতাংশ জমি ক্রয় করে, যার মূল্য প্রায় ৬০ লাখ টাকা। বক্তারপুর ও খঞ্জনকাঠি মৌজায় বক্তারপুর কবরস্থানের পাশে সম্প্রতি ২২ শতাংশ জমি ক্রয় করেন, যার মূল্য প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। কাঞ্চনপুর মৌজায় আরএস ১৯৪ নং দাগে ৬ শতাংশ জমি ক্রয় করেন রাশেদ, যার মূল্য ৫৪ লাখ টাকা।
পোড়াবাড়ি এলাকার নজরুল ইসলামের ছেলে শাকিল মিয়া। তিনি প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার সম্পদের মলিক। খঞ্জনকাঠি মৌজায় আর এস ৯০ নং দাগে ১৪ শতাংশ জমি কিনেছেন, যার মূল্য ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। অমরপুর মৌজায় আর এস ১৬ নং দাগে মল্লিকেরটেক ব্রিজের পাশে ৩৬ শতাংশ জমি ক্রয় করেন, যার মূল্য ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। বাড্ডা উচ্চ বিদ্যালয়ের পেছনে আক্তারের বাড়ির পাশে ১০ শতাংশ জমি ওপর বাড়ি নির্মাণ করে ভাড়ায় দিয়েছেন, যার মূল্য ১ কোটি ২০ লাখ টাকা।
কাঞ্চনপুর এলাকার ফজলু মিয়ার ছেলে সেলিম মিয়া। তিনি ইয়াবা ও গাঁজা ডিলার। কাঞ্চনপুর মৌজায় আর এস ৯৮. ১৮৬. ১৯৭ ও ১২২ নং দাগে ৪টি স্থানে তার ৩০ শতাংশ জমি রয়েছে। সেখানে ৪টি বাড়ি নির্মাণ করেছেন তিনি, যার মূল্য ২ কোটি ২০ লাখ টাকা।
একই এলাকার মৃত শাজিদ আলির ছেলে বরজু মিয়া ও তার ভাই লস্কর মাতব্বর মাদক ব্যবসা করে কাঞ্চনপুর মৌজায় আরএস ৯৮. ১২৩. ১২৪. ১৭৭ ও ১৭৮নং দাগে ১১টি স্থানে ১২২ শতাংশ জমি কিনেছেন। এসব জায়গায় তারা ১৬টি বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাদকের ডিলার লস্কর মাতব্বর, শাকিল ও বুলবুল একই রকম তথ্য দিয়ে যুগান্তরকে বলেন, আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সাপের খেলা দেখিয়ে জীবনযাপন করি। আমাদের বিরুদ্ধে যে মাদক কারবারের অভিযোগ এসেছে তা আদৌ সত্য নয়। তবে বেদে সম্প্রদায়ের কিছু লোক মাদক ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, এসব সম্পদ আমাদের নয়, এগুলো পরিবারের সদস্যের নামে রয়েছে। এদিকে লস্কর মাতব্বর, শাকিল ও বুলবুলের সঙ্গে কথা বলার খবর পেয়ে অভিযুক্ত অন্যরা তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে তাদের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
জানতে চাইলে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহম্মদ মুঈদ যুগান্তরকে বলেন, কিছুদিন আগেও আমরা বেদে সম্প্রদায়ের কয়েকজন লোককে মাদকসহ গ্রেফতার করেছি। সাভারের বেদেপল্লি মাদকমুক্ত করতে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন