বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে কেউ কেউ বর্তমান সময়টাকে ‘ক্রান্তিকাল’ বলে অভিহিত করছেন। কথাটিকে আমার কাছে তাৎপর্যপূর্ণ মনে হচ্ছে। প্রগতিশীল রাজনীতির জন্য সময়ের প্রকৃতিকে বোঝা একান্ত দরকার। ক্রান্তিকাল কথাটি আমি প্রথম শুনেছিলাম রাজনীতিক ও সাংবাদিক আনোয়ার জাহিদ এবং পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের এককালীন সাধারণ সম্পাদক কাজী জাফর আহমদের বক্তৃতায়।
সেটি ১৯৬২ সালের শেষ দিকের কথা। তারা দুজনই তখন পরিচিত ছিলেন ‘বামপন্থী’ বলে। জাহিদ ভাইয়ের ছিল অত্যন্ত সুন্দর চেহারা, বিলাসিতাহীন সুন্দর পোশাক-আশাক, সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর, বাংলা ও ইংরেজি—দুই ভাষায়ই পাণ্ডিত্যপূর্ণ ও আবেদনশীল বক্তব্য দেওয়ার সামর্থ্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের অপকর্মের নানা দৃষ্টান্ত তিনি পর্যাপ্ত তথ্য দিয়ে বলতেন।
যুদ্ধমুক্ত পৃথিবী গড়ে তোলার কথা বলতেন। বক্তব্যে তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ও সুকান্তের কবিতা, শেকসপিয়ারের কোনো কোনো নাটকের পাত্র-পাত্রীদের সংলাপ উল্লেখ করে বক্তব্য স্পষ্টতর ও আকর্ষণীয় করে তুলতেন। আমরা অনেকে মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনতাম। জাফর ভাইও খুব সুন্দর বক্তব্য দিতেন।
তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ পাস করেছিলেন। তার বক্তব্যে কোনো কোনো জাতির আধুনিক ইতিহাসের নানা কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের অন্তর্গত পূর্ব বাংলার প্রধান সমস্যাগুলো সমাধানের উপায় নির্দেশের চেষ্টা করতেন। তারা দুজনই সাম্রাজ্যবাদী ও ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে স্পষ্ট কথা বলতেন। জাফর ভাই মুসোলিনি, হিটলার, সালাজার, ফ্রাংকোর জননন্দিত নেতা থেকে জনধিকৃত নেতায় পরিণত হওয়ার কথা সংক্ষেপে বলতেন। পাকিস্তানের অন্তর্গত পূর্ব বাংলার ভবিষ্যতের কথা বলতেন।
তারা দুজনই বলতেন বর্তমান আমাদের খারাপ, তবে উজ্জ্বল উদ্ধারের সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনাকে বাস্তবায়িত করে আমরা এক সমৃদ্ধ, সুন্দর নতুন জনজীবন ও নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলব। বিভিন্ন সভায় আরো অনেক কথা দুজনই বলতেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের ধারায় চলতে পারেননি। এ জন্য রাজনীতিতে তারা সুবিধাবাদী বলে সমালোচিত হয়েছেন। যাক এসব কথা। ক্রান্তিকালের কথায় আসি।
বাংলাদেশে এখন কি ক্রান্তিকাল চলছেকিছুদিন ধরে দেখছি বাংলাদেশে আমাদের বর্তমান সময়কে কেউ কেউ ক্রান্তিকাল বলে অভিহিত করছেন এবং কথাটি প্রচার লাভ করছে। কথাটির মর্মার্থ গভীরভাবে বোঝা দরকার। আনোয়ার জাহিদ ও কাজী জাফর আহমদ যেভাবে কথাটি ব্যাখ্যা করতেন, তাতে তারা বলতেন প্রতিটি জাতির ইতিহাসেই যুগ-যুগান্তর আছে। প্রতিটি জাতির বিকাশধারায় দেখা যায়, নতুন যুগ সৃষ্টি হওয়ার সময়ে চলমান যুগ ও নতুন যুগের মধ্যবর্তী বেশ কিছুটা সময়ে পুরনো যুগের অনুসারীদের সঙ্গে সম্ভাব্য নতুন যুগের অভিলাষীদের মধ্যে বিরোধ চলে এবং নতুন যুগ সৃষ্টির অভিলাষীরা জয়ী হয় এবং নতুন যুগ গড়ে উঠতে বিকশিত হতে থাকে। তারা বলতেন, দুই যুগের মধ্যবর্তী এই সময়টাই হলো ক্রান্তিকাল। ব্রিটিশ শাসকদের ক্ষমতা হস্তান্তরের মধ্য দিয়ে যেভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাতে পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্যায়ে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে ক্রান্তিকালের মধ্যে ছিল তার অবসান ঘটেনি। নতুন যুগ সৃষ্টির লক্ষ্যে যে প্রচেষ্টা চালানো দরকার ছিল, তা চালানো হয়নি। বাংলা ভাগ, পাঞ্জাব ভাগ ও ভারত ভাগ যেভাবে করা হয়েছে, তাতে আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যাবলির সমাধান করা হয়নি। পূর্ব বাংলায় যে আর্থ-সামাজিক ও সংস্কৃতিক অবস্থা বিরাজিত, তা ব্রিটিশ আমলে সৃষ্ট। নতুন বাস্তবতায় সব কিছুকেই বদলাতে হবে এবং দেশ-কাল অনুযায়ী নতুনভাবে উন্নতিশীল করে গড়ে তুলতে হবে। পূর্ব বাংলায় সৃষ্টি করতে হবে এক সমৃদ্ধিমান সম্প্রীতিময় নতুন সমাজব্যবস্থা। অভীষ্ট নতুন যুগের অবস্থা বর্তমানে চলমান অবস্থা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হবে। ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে আমাদের সৃষ্টি করতে হবে এক নতুন বাস্তবতা। মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি বলার অবস্থা তখন দেখা দেয়নি। ওই দুজনের কথার সূত্র ধরে অনেকেই পূর্ব বাংলার তৎকালীন অবস্থাকে ক্রান্তিকাল বলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। জাতীয়তাবাদী বক্তব্য বামপন্থীদের থেকে অল্পই প্রচারিত হয়েছে। তখনকার বামপন্থীদের এটিও একটি মূল ত্রুটি।
বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক, আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থাকে যারা ক্রান্তিকাল বলে অভিহিত করছেন, তাদের থেকে যদি এ বিষয়ে আমাদের হাজার বছরের ইতিহাসের ধারায় বর্তমান ক্রান্তিকাল সম্পর্কে ব্যাপক ও গভীর বক্তব্য পাওয়া যেত এবং দেশের রাজনীতিবিদদের দৃষ্টি এই বিষয়টির প্রতি আকৃষ্ট হতো, তাহলে সেটি দেশবাসী সবার জন্য বিশেষভাবে কল্যাণকর হতো।
‘যুগসংক্রান্তি ও নীতিজিজ্ঞাসা’ আমার একটি বই আছে। ওই বইয়ে ক্রান্তিকালকে বলা হয়েছে এখন দুনিয়া বদলে গেছে। এ কারণে আরো অগ্রসর নতুন চিন্তা দরকার। পুরনো বিষয়াদির পটভূমিতেই নতুন উদ্ভাবন দরকার। অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে সম্পর্কহীন ভাবা যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতি তো এখন রাজনীতিকদের আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। পশ্চিমা বৃহৎ শক্তিবর্গের এবং বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতেরও ভূমিকা আছে। এর মধ্যে আমাদের রাজনীতির পুনরুত্থান স্বল্প সময়ে সহজে সম্ভব হবে না। দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারাদি যেভাবে চলছে, তাতে জনজীবনে দুর্দশা অবর্ণনীয় রূপ নিয়ে চলছে। রাষ্ট্রের ভেতরকার অর্থনৈতিক অবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি, আইনকানুন ও বিচারব্যবস্থা, প্রশাসনব্যবস্থা, কৃষিনীতি ও শিল্পনীতি, সরকারের আয়-ব্যয়—সব কিছুরই আমূল পরিবর্তন দরকার। প্রতিদিনই দুর্গতির নানা সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে। হত্যা ও আত্মহত্যা, ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন, শিশু হত্যা, দলাদলি ও সংঘাত-সংঘর্ষ বাড়ছে। মানুষ নিরাপত্তার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজে অগ্রসর হতে সাহস করছে না। রাষ্ট্র, জাতি ও জনজীবন বিপন্ন। তরুণ-তরুণীরা ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার নানা রাষ্ট্রে গিয়ে নাগরিকত্ব নিচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি ছাত্র-তরুণদের এবং বয়স্ক লোকদেরও অনেকের আছে নিদারুণ দুরবস্থা। এই সব কিছু ধরে যদি আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছি যে স্বাধীন বাংলাদেশে চলছে এক অন্ধকার যুগ এবং এই যুগের অবসান ঘটিয়ে আমরা এক নতুন যুগ সৃষ্টি করব এবং অভীষ্ট সেই নতুন যুগের অভিপ্রেত রূপ-স্বরূপকে সুন্দর করে ভাষা দিয়ে পুস্তিকা আকারে জনগণের মধ্যে প্রচার করলে এবং সুষ্ঠু রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এর বাস্তবায়নের জন্য গণ-আন্দোলন চালালে সুফল হবে।
ক্রান্তিকাল সম্পর্কে বাংলাদেশের বাস্তবতায় পরিচ্ছন্ন ধারণা অর্জন করতে হবে। বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস জানতে হবে। তারপর বর্তমান কালের ক্রান্তিকালের সূচনা, বিকাশ ও সম্ভাব্য পরিণতি সম্পর্কে বক্তব্য প্রস্তুত করে তা নিয়ে জনগণের মধ্যে যেতে হবে। রাজনৈতিক দল লাগবে। আমি আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি ও বামপন্থী দলগুলোর মতো দল গঠনের কথা বলছি না। উন্নত চরিত্রের রাজনৈতিক দলের কথা বলছি। রাজনৈতিক দল সম্পর্কেও ভাবতে হবে। অন্তত কিছু রাষ্ট্রের রাজনৈতিক দলের অবস্থা দেখতে হবে। কোনোটির অনুকরণ নয়, বাইরের অভিজ্ঞতা দেখে নিজেদের লক্ষ্য স্থির করতে হবে এবং তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমানে নেতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জাতীয় জীবনের, জনজীবনের বড় বড় সমস্যা নিয়ে কেবল প্রচার চালানো হয় এবং সরকার উত্খাত করে ক্ষমতা দখলের ও ক্ষমতাসীন হয়ে অর্থবিত্ত অর্জনে ও বিদেশে অর্থপাচার এবং সম্পত্তি অর্জনের চেষ্টা করা হয়। এই রকম রাজনীতি নিয়ে কল্যাণকর কিছু হবে না। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে যেসব কথা প্রচার করে এবং প্রকাশ্যে ও গোপনে যেসব কাজ করে, তা বাংলাদেশের সুস্থ রাজনীতি ও স্বনির্ভরতার পরিপন্থী।
যারা বাংলাদেশে সুস্থ রাজনীতি, স্বাধীন রাষ্ট্র ও জাতি গঠন এবং পর্যায়ক্রমে জনজীবনের সমস্যাবলির সমাধান চান, তাদের নতুন বিবেচনা দ্বারা পরিকল্পনা ও কর্মসূচি অবলম্বন করে কাজ করতে হবে। স্থূল চিন্তা ও সহজ চেষ্টায় কিছু হবে না। গত ৫৩ বছরে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ অল্পই গড়ে উঠেছে। যেটুকু গড়ে উঠেছে, তা-ও রক্ষা করা হচ্ছে না।
ব্যাবহারিক রাজনীতির জন্য ক্রান্তিকাল ব্যাপারটিকে গভীরভাবে বুঝে নতুন যুগ প্রতিষ্ঠার কিংবা যুগান্তরের লক্ষ্যে রাজনীতি করতে হবে। দেশে কায়েমি স্বার্থবাদী এবং বিদেশের দালালরা (যদি থেকে থাকে) এই ধারার প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবে। সব প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করে লক্ষ্য অর্জনে সফল হতে হবে।
লক্ষণীয় যে স্বাধীন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী বলে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী এখন দুর্লভ। এসব বুঝতে হলে অনেক জটিল সমস্যার রহস্য উদঘাটন করতে হবে। আহমদ ছফা ১৯৭২ সালে লিখেছিলেন, ‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বুদ্ধিজীবীরা এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তন হবে না।’ সেই কথার প্রাসঙ্গিকতা মনে হয় আজও আছে। বুদ্ধিজীবীরা এখন বিশিষ্ট নাগরিক বলে অভিহিত হচ্ছেন। এই বিশিষ্ট নাগরিকদের বেশির ভাগই বর্তমান ক্রান্তিকালকে অব্যাহত রাখার জন্য কাজ করছে।
ক্রান্তিকাল বৈশ্বিক পরিমণ্ডলেও চলছে। বরিশালের কবি জীবনানন্দ দাশ আজ থেকে ৮০ বছর আগে লিখেছিলেন,
‘অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই—প্রীতি নেই
—করুণার আলোড়ন নেই,
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনও যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।’
পৃথিবীর আজকের অবস্থাটা কী রকম? কিভাবে উন্নতি করা যাবে?
লেখক : সৃষ্টিশীল চিন্তাবিদ
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন