রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উদ্বেগজনক অবস্থার মধ্যেও কিছু অপরাধ কমেছে। এর মধ্যে রয়েছে ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও চুরির মতো অপরাধ। তবে চলতি বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে খুন বেড়েছে উদ্বেগজনক হারে।
খুন, ডাকাতি ও অপহরণ বেড়েছে, কমেছে চুরি, ধর্ষণ, নারী নির্যাতনএই সময়ে সারা দেশে ৫২২টি খুনের মামলা করা হয়েছে, যা ২০২৩ সালের দুই মাসের তুলনায় ৩৪টি বেশি।
পুলিশের তথ্য বলছে, খুন ছাড়াও ছিনতাই, ডাকাতি, দস্যুতা, শিশু নির্যাতন, অপহরণ, সিঁধেল চুরির ঘটনা গতবারের তুলনায় এবার বেড়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পেশাগত অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যাওয়া এবং ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর কারণেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে পুলিশের কাজের গতিহীনতা।
পুলিশ অবশ্য বলছে ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ায় কেউ কেউ সুযোগ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটায়।
আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করেছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। গত অক্টোবর মাসে ঢাকার মোহাম্মদপুর যেন সন্ত্রাসের রাজ্যে পরিণত হয়। প্রকাশ্য দিবালোকে দোকানে ঢুকে ডাকাতির তথ্য পাওয়া যায়।
এক তরুণীকে চাপাতি হাতে দৌড়ানোর ভিডিও চিত্রও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। মিনি সুপারশপে চাপাতি হাতে কয়েকজন ঢুকে সবাইকে বেরিয়ে যেতে বলছে—এমন দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে মানুষ। কয়েক দিনের মধ্যে অন্তত ১২ জন খুনের শিকার হন মোহাম্মদপুরে। এলাকাবাসী অপরাধ দমন করতে থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ করে। এরপর যৌথ বাহিনীর অভিযানে ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছিল।
মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এলাকায় খুনখারাবি, ডাকাতির মতো ঘটনা কমলেও এখনো দলবদ্ধ হয়ে কিশোর তরুণরা ঘোরাঘুরি করছে। মাঝেমধ্যেই হামলার ঘটনা ঘটছে। ভয়ে তাদের কেউ কিছু বলতে পারছে না।
গত ১৬ নভেম্বর পশ্চিম ধানমণ্ডি এলাকায় বাসায় ঢুকে যুক্তরাজ্যপ্রবাসী এক চিকিৎসককে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিন আজিমপুর এলাকার এক বাসা থেকে টাকা, স্বর্ণালংকার লুটের পাশাপাশি গৃহকর্ত্রীর ছোট্ট শিশুকেও তুলে নিয়ে যায় ডাকাতরা। বিষয়টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর দেশে ব্যাপক ভীতি ছড়ায়। পরে অবশ্য শিশুটিকে উদ্ধার এবং অপহরণকারী নারীকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
পুলিশের পরিসংখ্যান যা বলছে :
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সারা দেশে মামলা করা হয়েছে ২৫ হাজার ৪৫৬টি। এর মধ্যে খুনের মামলা করা হয়েছিল ৪৮৮টি। চলতি বছর ওই দুই মাসে খুনের মামলা করা হয়েছে ৫২২টি, যা আগের বছরে তুলনায় ৩৪টি বেশি।
গত বছর উল্লিখিত দুই মাসে ডাকাতির মামলা করা হয়েছিল ৪৩টি। এ বছর দুই মাসে ডাকাতির মামলা করা হয়েছে ১১১টি, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৮টি বেশি। গত বছর এই সময়ে দস্যুতার মামলা করা হয়েছিল ২১২টি, চলতি বছর করা হয়েছে ২৩১টি। শিশু নির্যাতনের ক্ষেত্রে গত বছর দুই মাসে ৪৭৩টি মামলা করা হয়েছিল, এ বছরে করা হয়েছে ৫২৯টি। গত বছর দুই মাসে অপহরণের ঘটনা ছিল ৯৮টি, যা এ বছর এসে দাঁড়িয়েছে ১৬১টিতে। এটা গত বছরের তুলনায় ৬৩টি বেশি।
অন্যদিকে গত বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে ধর্ষণের মামলা করা হয়েছিল ৮৮৪টি, যা এই বছর কমে দাঁড়িয়েছে ৭৭৪টিতে। গত বছর নারী নির্যাতনের মামলা করা হয়েছিল এক হাজার ৯৬২টি, এ বছরে করা হয়েছে এক হাজার ৮৩৩টি। গত বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে পুলিশ আক্রান্তের ঘটনা ছিল ১২৫টি। এ বছর সেটি কমে ৫৮টি হয়েছে।
গত বছর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে সারা দেশে এক হাজার ৬৯৮টি চুরির মামলা করা হয়েছিল। এ বছর দুই মাসে মামলা করা হয়েছে এক হাজার ৩২৭টি, যা গত বছরের তুলনায় ৩৭১টি কম। গত বছর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুই মাসে মামলা করা হয় ১২ হাজার ৬০০টি। এ বছর তা কমে পাঁচ হাজার ৯৯টিতে নেমেছে, যা গত বছরের তুলনায় সাত হাজার ৫০১টি কম।
সীমান্তে চোরাচালানও কমেছে। গত বছর দুই মাসে ৫৩১টি চোরাচালানের মামলা করা হয়, এ বছর হয়েছে ৩৮৮টি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পুলিশ এখনো অপরাধ দমনে পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি। এখনো পুলিশ ট্রমার মধ্যেই আছে। স্বাভাবিক হতে না পারায় অপরাধ কন্ট্রোল করা কঠিন হচ্ছে। আগের মতো স্বাভাবিক হতে আরো কিছুটা সময় লাগবে। আমি মনে করি, ধীরে ধীরে বর্তমান অবস্থা কেটে যাবে। নতুন আইজিপি ও ডিএমপি কমিশনার অত্যন্ত দক্ষ। তারা ভালো করবে বলে আমার বিশ্বাস।’
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) ইনামুল হক সাগর কালের কণ্ঠকে বলেন, অপরাধ কখনো বাড়ে, আবার কখনো কমে। এটি একটি স্বাভাবিক প্রবণতা। অপরাধের মাত্রা কমিয়ে আনতে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন