কোভিড মহামারী-উত্তর বিশ্ববাণিজ্যে সাপ্লাই চেনে টান এবং এর পরপরই ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে বৈশ্বিক সংকটের প্রভাব পড়ে দেশের অর্থনীতিতে। রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে আসা, রপ্তানি আয়ে ভাটা, ডলারের সংকট ও মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশের বাজারে জ¦ালানি তেলের দাম বাড়ানোর কারণে অতি মূল্যস্ফীতিতে অর্থনীতিতে রীতিমতো দুর্যোগ নেমে আসে। এই পরিস্থিতি কাটিয়ে না উঠতেই গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র আন্দোলন ঘিরে অবরোধ এবং সরকারের টানা সাধারণ ছুটি ঘোষণা ও ইন্টারনেট ব্ল্যাক আউটে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে মারাত্মক ক্ষত তৈরি হয়। এরপর থেকে শিল্পাঞ্চলে টানা অস্থিরতার মধ্যেই সাম্প্রতিকালে নানা দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে আন্দোলন ও সহিংসতা চলছে। রাজপথের এই নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি অর্থনীতিতে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে ব্যবসায়ীদের অস্বস্তি, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। পালিয়ে বেড়াচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী। ব্যবসা-বিনিয়োগে ধসে মন্দার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
Pause
Mute
Remaining Time -10:09
Close PlayerUnibots.com
অন্যদিকে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সহিংসতা ও অস্থিরতায় শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয় না হলে সময়ের সঙ্গে দিন দিন সমস্যা আরও প্রকট হতে পারে বলে শঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন গতকাল আমাদের সময়কে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আস্থা ও বিশ্বাসে বড় ধরনের আঘাত করে। আমরা তো বায়ারদের মাধ্যমে ওয়ালমার্ট ও জারাসহ বড় প্রতিষ্ঠানের কাছে পণ্য বিক্রি করি। তারা ভাবেন, যেখানে মানুষ চলাচল করতে পারছে না, সেখানে মালামাল সময় মতো ডেলিভারি দিতে পারবে না। তারা যেহেতু মৌসুমি পণ্য কেনে, তাই মৌসুম মিস করলে সেটা বিক্রি হবে না। এ জন্য তারা পণ্য পাওয়ার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি নিশ্চয়তা চায়।
বিনিয়োগের ব্যাপারে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বিনিয়োগকারী সুসময়ের অপেক্ষায় থাকে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে তারা নতুন কোনো বিনিয়োগ, কারখানা কিংবা প্রোডাক্ট লাইন খোলার ভরসা পান না। এখন ব্যবসায়ীরা ভাবছেন, আকাশ এত বেশি মেঘাচ্ছন্ন, পাল উড়াবেন কীভাবে। ফলে তারা নোঙর ফেলে বসে থাকছেন। উত্তরণের উপায় হিসেবে তিনি বলেন, দিন শেষে সব দায় সরকারের ওপরই আসে। তাই ভালো
পরিকল্পনা নিতে হবে। হঠকারী সিদ্ধান্ত নিয়ে অবস্থা উত্তপ্ত করা যাবে না। এখন প্রধান কাজ হবে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর শ্রমিক আন্দোলনে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পণ্য তৈরি করে ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে হিমশিম খেতে হয়। এরপর চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধি, চাকরি স্থায়ীকরণ ও আনসার সদস্যদের আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিক্ষোভে রাজপথ উত্তপ্ত হয়েছে। শ্রমিক, শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশাজীবীদের নিয়মিত আন্দোলন বিক্ষোভে ঢাকা উত্তাল। গত সোম ও মঙ্গলবার কয়েকটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতার ঘটনা ঘটে। গতকাল বহিষ্কৃৃত ইসকন নেতাকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় বিক্ষোভ-সহিংসতার ঢেউ লাগে বন্দরনগরী চট্টগ্রামেও। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনও স্বাভাবিক হয়নি। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটেনি। এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসা ও বিনিয়োগে স্থবিরতা তৈরি হয়েছে।
রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশের ব্যবসা-বিনিয়োগের স্থবিরতা তৈরির শঙ্কা করেছেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক অস্থিরতায় দেশে বিনিয়োগে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে দুর্নীতি করে অনেকে এখন পলাতক। দেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। একদিকে বেসরকারি খাতেও নতুন বিনিয়োগ হচ্ছে না, অন্যদিকে সরকারের উন্নয়ন ব্যয়ও যদি না বাড়ে; তা হলে তো একটা অর্থনৈতিক মন্দা অবস্থা তৈরি হবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ায় ব্যবসায়ীদের মধ্যে অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। আগামীকাল কিংবা আগামী সপ্তাহে কী হবে সেটা আমরা বুঝতে পারছি না। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সামনে নিয়ে বিনিয়োগে কোনো ব্যবসায়ী আগ্রহ দেখাচ্ছে না।
বিডার তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৮৬টি দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিনিয়োগ প্রস্তাব পাওয়া গেছে। টাকার অঙ্কে যা ১৯ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। আর গত এপ্রিল-জুনে ২৫৪টি প্রতিষ্ঠান ৭৭ হাজার ৩৬৪ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছিল। অর্থাৎ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক কমে গেছে।
ব্যবসায়ী ও বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতার পটপরিবর্তনে অনেক ব্যবসায়ী আত্মগোপনে চলে গেছেন। কিছু ব্যবসায়ী কারাগারে। গায়েবি মামলা দিয়ে কিছু ব্যবসায়ীকে তাদের প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। ফলে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চাপে বাড়ছে। শ্রমিকদের বেতন পরিশোধ নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত অনিশ্চয়তার ক্ষেত্রগুলো দূর করে ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলেও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে কারখানাগুলোতে বিক্ষোভ আর ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সেই সঙ্গে পুলিশি তৎপরতা না থাকায় নিরাপত্তা সংকটে অনেক কারখানাই বেশকিছু দিন বন্ধ ছিল। এসব কারণে আমদানি-রপ্তানি ও বিনিয়োগে প্রভাব পড়েছে। এ ছাড়া বেশ আগ থেকেই ডলার সংকট ও দাম বৃদ্ধি, সুদের হার বৃদ্ধি, গ্যাস ও বিদ্যুতের সমস্যাসহ অনুকূল পরিবেশের অভাবে বিনিয়োগে আগ্রহ কম দেখিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) মূলধনী যন্ত্রপাতির এলসি খোলা হয়েছে মাত্র ২৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের। এই অঙ্ক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৩ দশমিক ৭১ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে এই পণ্যটির এলসি খোলার পরিমাণ ছিল ৫০ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। এ সময়ে শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের এলসি খোলা হয়েছে ৭৩ কোটি ৫৬ লাখ ডলারের, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ কম। একই সময়ে এই পণ্যটির এলসি নিষ্পত্তি কমেছে ২১ দশমিক ৮৩ শতাংশ।
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিক্ষোভ-সহিংসতায় যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের অবস্থাও খারাপ হয়ে যায়। যে এলাকায় সহিংসতা হচ্ছে, সেই এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুরোপুরি বিক্রি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আবার এই অবস্থার কারণে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি শুরু হয়।
বর্তমান পরিস্থিতির বিষয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও রাষ্ট্রচিন্তক অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক আমাদের সময়কে বলেন, আওয়ামী লীগের শাসনামলে সমাজের স্তরে স্তরে নানা বেআইনি কাজ চলছিল। ব্যাংকগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। সারাদেশে মানুষের মধ্যে একটা বিরোধ সৃষ্টি হচ্ছে। সরকার খুব ধীরগতিতে এগোচ্ছে। ড. ইউনূসের নেতৃত্ব যে উপদেষ্টা সরকার গঠিত হয়েছে, তাদের এই সমস্যাগুলো সিরিয়াসলি দেখা দরকার।
আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, মার্কিন প্রশাসন সাজেসশন দিয়েছে, এটা অনেকটা ঘাড়ের ওপর চাপ দেওয়ার মতো। ভারত নানা কথা বলছে। সব মিলিয়ে জাতীয় জীবনে ঘোর দুর্যোগ ঘনিয়ে আসছে। এই দুর্যোগ অতিক্রম করার জন্য সরকারকে কঠোর হতে হবে। জনসাধারণকে জাগতে হবে। ন্যায়সঙ্গত কথা বলতে হবে। দেশব্যাপী অনেক ভাঙচুর হলো। সেই ধারাবাহিকতায় এখনও গণ্ডগোল চলছে। সরকারের উচিত অভিভাবক, শিক্ষকদের সঙ্গে বসে সমাধান করা। গোয়েন্দা সংস্থাকেও কাজ করতে হবে। সরকারের সব পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কাজ করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসা-বিনিয়োগের সঙ্গে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ-ভাঙচুরে অংশ নিচ্ছে। এর কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হচ্ছে। শিক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তার পাশাপাশি রাস্তায় বেরুতেও মানুষ ভয় পাচ্ছে।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী আব্দুল্লাহ মামুন বলেন, প্রতিদিনই রাজপথে সংঘর্ষ-সহিংসতা হচ্ছে। ফলে নিজের পরিবারে সদস্যদের বাসার বাইরে পাঠাতে ভয় তৈরি হচ্ছে। তার ছেলে আগে বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে গেলেও বর্তমানে তিনিই স্কুলে দিয়ে আসেন এবং স্কুল ছুটির পর ছেলের মা নিয়ে আসেন। তিনি বলেন, এখন পুলিশ সক্রিয় হয়ে যত দ্রুত আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারবে, তত দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসবে। মানুষের মধ্য থেকে ভয় কাটবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন