দেশের ১৪তম প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সচিব এএমএম নাসির উদ্দীন। একই সঙ্গে আরও চার কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগামীকাল রবিবার দুপুরে শপথবাক্য পাঠের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তারা দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের দায়িত্ব এ কমিশনের। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে পরিকল্পনা এবং সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে পথচলাসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে দৈনিক আমাদের সময়ের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। গতকাল শুক্রবার তার বাসায় সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন আমাদের সময়ের সিনিয়র রিপোর্টার আসাদুর রহমান
পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আপনার ভাবনা ও প্রত্যাশা কী? এমন প্রশ্নে এএমএম নাসির উদ্দীন বলেন, দেশ আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে। এখন আমার দেওয়ার পালা। এই ক্রান্তিলগ্নে মানুষের প্রত্যাশা- সুন্দর নির্বাচন। সেই প্রত্যাশা পূরণের একটা সুযোগ পেয়েছি। এ সুযোগ অর্জনে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত রাখব। এটা আমার কমিটমেন্ট।
সার্বিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে কোনো রকম চাপ অনুভব করছেন কী? জবাবে সিইসি বলেন, চাপ অনুভব করছি, তা নয়। আবার করছি না, তাও নয়। কাজের চাপের কথা বললে এসব মোকাবিলায় আমি অভ্যস্ত। আমি ওভাবেই প্রশিক্ষিত। সরকারি চাকরিতে চাপ মোকাবিলার জন্য সবসময়ই প্রস্তুত থাকতে হয়েছে। এখানেও অনেক ধরনের চাপ থাকবে। সবাইকে নিয়ে সেসব মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাব এবং ফলপ্রসূ হবো ইনশাআল্লাহ।
আগের সিইসি-ইসি নিয়ে সবসময়ই বিতর্ক ছিল, তারা সমালোচনা এড়াতে পারেননি। উপরন্তু ছিল রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে নানাবিধ চাপ। এ বিষয়ে সাবেক এই আমলা বলেন, বিতর্ক এড়াতে আমার একটা অ্যাডভানটেজ আছে। যারা বিতর্ক করবেন (রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ), তারা সবাই কিন্তু গত ১৫-১৬ বছর ধরে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য যুদ্ধ করেছেন। ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনেকে নিহত, আহত, গুম হয়েছেন। তারা তো ভালো নির্বাচন চান, আমি এটাকে ফ্যাসিলেটেড করব। তাদেরও আমি সঙ্গে পাব। যেটা আগে পাওয়া যায়নি। আগে সব দলকে পাওয়া যায়নি। যিনি ক্ষমতায় ছিলেন, তিনি অন্যদের একত্রিত করতে চাননি। কিন্তু আমাদের তো এখন সেই সমস্যা নেই। আমাদের তো সরকারের পক্ষ থেকে কোনো ধরনের চাপ নেই। আমরা নিরপেক্ষ, একদম রেফারির ভূমিকায়। অন্তর্বর্তী সরকারও রেফারির ভূমিকায় কাজ করছে। তাই রাজনৈতিক
সব দল ও প্রার্থী নির্বাচনী মাঠে সুষ্ঠুভাবে খেলার সুযোগ পাবে। আমরা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেব, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করে দেব। তারা খেলবেন। তারা যে ফেয়ারলি খেলতে চান, এই কথাটি তারাও বারবার বলে আসছেন। কাজেই আমরা তাদেরও সঙ্গে পাব।
আগের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ায় অংশগ্রহণমূল নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন ছিল। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ না নিলে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে তোলা প্রশ্নে সিইসি বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আরও কয়েকটি দল আছে, জোট আছে। তাদের রাজনীতি করা-না করা নিয়ে এক ধরনের বিতর্ক চলছে। এ নিয়ে আমি এখনই কোনো মন্তব্য করতে চাই না। নির্বাচনের আগেই এসবের ফয়সালা হয়ে যাবে মনে হচ্ছে। এটা এখনো ম্যাচিউরড পর্যায়ে আসেনি। সুতরাং এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে আপনি আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে চাইবেন কি না? এ প্রশ্নে সিইসি বলেন, এখনো দায়িত্ব নিইনি। আগে দায়িত্বটা নিই। মাঠে যে বিতর্ক চলছে, চলুক। ফয়সালাটা কোথায় গিয়ে হয়, দেখি। নির্বাচন আসতে আসতে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। তখন সেভাবেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সব দলের অংশগ্রহণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে কী পদক্ষেপ নেবেন? জবাবে এএমএম নাসির উদ্দীন বলেন, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যারা আছেন, যেসব অংশীজন আছেন; সবার সহযোগিতা চাইব, গণমাধ্যমের সহযোগিতাও চাইব। তরুণ প্রজন্ম, যারা এতদিন ভোট দিতে পারেনি, তাদের সহযোগিতা চাইব, সরকারের সহযোগিতা চাইব। আমি নিশ্চিত, সবার সহযোগিতা পাব। আমাদের সেই অভিজ্ঞতাও আছে। আমাদের যা চাওয়া, সেই চাওয়ার বিষয়ে যখন আমরা শক্ত থাকব, তখন দেখবেন সব লাইনে চলে আসবে। যদি নিয়তে গর-বর থাকে, তখন কেউ ডানে যায়, কেউ বাঁয়ে যায়। আমাদের নিয়তের মধ্যে কোনো খাদ নেই। আমরা যে লক্ষ্য নিয়ে দায়িত্ব নেব, সেই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হবো না।
নির্বাচন ব্যবস্থা, কমিশনের সংস্কার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নতুন সিইসি বলেন, অবশ্যই সংস্কার বিষয়ে নজর দেব। ড. বদিউল আলম মজুমদারের নেতৃত্বে একটি কমিশন হয়েছে। ওনারা সবকিছু রেডি করে রাখবেন, স্টাডি করে রাখছেন। সেখান থেকে বাছাই করে আমাদের কাছে, সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য মনে হলে; সব কিছু মিলিয়ে সেটা করা হবে। এই কাজগুলো তো আমাদের করতে হতো, ওনারা সেটা করে দিচ্ছেন।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের প্রত্যাশা প্রসঙ্গে সিইসি বলেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য গত ১৫-১৬ বছরে অনেক লোক প্রাণ দিয়েছেন। সম্প্রতি জুলাই আন্দোলনে দেড় হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। ২৫ থেকে ২৬ হাজার লোক পঙ্গু, আহত হয়েছেন। ১৩০টি শিশু মারা গেছে। এই যে এত এত মানুষ শহীদ হলো। তাদের মূল দাবির মধ্যে একটি হলো- ভোটের অধিকার। যদি আমরা ফেল করি অথবা গাফিলতি করি তাহলে এটা তো শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। এটা আমরা কোনো মতেই হতে দেব না। ওদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করার কোনো সুযোগ নেই। এটা আমাদের মাথায় ও বুকের মধ্যে থাকবে যে, ভোটের জন্য এত লোক প্রাণ দিয়েছে, ভোটের অধিকার আদায়ের জন্য। সেটা মনে রেখে আমরা কাজ করব।
সম্প্রতি স্থানীয় সরকার নির্বাচন, সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ না থাকায় ভোটার উপস্থিতি অনেক জায়গায় কম দেখা গেছে, সামনে সব দল অংশ না নিলে ভোটারদের কীভাবে কেন্দ্রে আনবেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এ বিষয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা থাকবে। গণমাধ্যম যখন দেখবে যে, আমরা সঠিক বলছি এবং সঠিক কাজটা করছি, তখন গণমাধ্যমই দেশবাসীকে এই বার্তা দিয়ে দেবে যে, আমরা তাদের মঙ্গলে কাজ করছি। আপনাদের (গণমাধ্যম) সহযোগিতা আমাদের কাম্য। এ ছাড়া আমাদের তরুণ প্রজন্ম যে বিশাল পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, তাদেরও তো ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপার আছে। আমরা সেই তারুণ্যকেও কাজে লাগাব। তরুণ প্রজন্ম নিজেরাই যুক্ত হয়ে যাবে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায়।
কমিশনে তার চার সহকর্মী প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নতুন সিইসি বলেন, ওনাদের সঙ্গে সেই অর্থে পরিচয় নেই। একজনের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। যতটুকু জেনেছি, তারা সবাই খুবই ভালো। অভিজ্ঞও বটে। আশা করি টিমের সবাই মিলে ফলপ্রসূ ও অর্থবহ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সফল হবো ইনশাল্লাহ।
সাক্ষাৎকারের জন্য আমাদের সময়কে ধন্যবাদ জানিয়ে শুভকামনা করেন এএমএম নাসির উদ্দীন। আমাদের সময়ের পক্ষ থেকে তাকেও ধন্যবাদ, মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন