মাদকবিরোধী অভিযান চললেও থামছে না মাদক পাচার। আন্তর্জাতিক মাদক মাফিয়াদের চোখ এখনো বাংলাদেশের দিকে। বিদেশ থেকে নিষিদ্ধ মাদক হেরোইন ও কোকেন এনে অভ্যন্তরীণ বাজার তৈরি করছেন তারা। এ চক্রের শতাধিক শীর্ষ কারবারি এখনো অধরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ৫ আগষ্টের পর দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশিবিদেশি চক্র। অতীতের চেয়েও করিডর হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহারের দিকে বেশি নজর তাদের। জানা গেছে, সর্বশেষ ৩ নভেম্বর সীমান্তবর্তী বেনাপোলে ট্রেনে তল্লাশি চালিয়ে একটি ব্যাগ থেকে ২ দশমিক ৭৬০ কেজি কোকেন ও ১ কেজি ৬৯২ গ্রাম হেরোইন জব্দ করে বিজিবি। এ ছাড়া সম্প্রতি আরও কয়েকটি মাদকের চালান আটকের ঘটনা ঘটেছে। এর বেশির ভাগই এসেছে অভিনব কৌশলে। ট্রেনের পাশাপাশি অ্যাম্বুলেন্স, প্রাইভেট কার, পণ্যের ভিতর এমনকি পেটের ভিতরে করেও ইয়াবা পাচারের ঝুঁকি নিচ্ছেন কারবারিরা। অল্প বিনিয়োগে বিপুল আর্থিক লাভের আশায় জীবন বাজি রেখে এ ধরনের কাজ করছেন তারা। ইয়াবার পাশাপাশি ক্রিস্টাল মেথ, আইস, হেরোইন ও কোকেনের মতো ভয়ংকর মাদকও নিয়মিত আসছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশকে ব্যবহার করে তা চলে যাচ্ছে পাশের একটি দেশে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)-এর পরিচালক (অপারেশনস অ্যান্ড গোয়েন্দা) তানভীর মমতাজ বলেন, ‘মাদক নিয়ন্ত্রণে ডিএনসির প্রতিটি সদস্য তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করছেন। চলতি বছরের শুরুতে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কোকেনের চালান ধরা হয়েছে। সম্প্রতি আকাশপথে আসা ইয়াবার চালানও দেশবাসী দেখেছে।’ সর্বশেষ কোকেনের চালান উদ্ধারের বিষয়ে জানতে চাইলে যশোর-৪৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন, ‘গোয়েন্দা তথ্যে বেনাপোল রেলস্টেশনে খুলনা-মোংলা-বেনাপোল রুটে চলাচলকারী বেতনা এক্সপ্রেস ট্রেন থেকে এ মাদকের চালান জব্দ করা হয়। তবে টের পেয়ে ব্যাগটি ফেলে মাদক পাচারকারীরা পালিয়ে যান।’ বিজিবিসূত্র জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে এ কোকেন জব্দ করা হলেও কাউকে গ্রেপ্তার করা যায়নি। এ কোকেন দেশের ভিতরেই বেচাকেনার জন্য সরবরাহ হচ্ছিল বলে ধারণা বিজিবির। পুলিশ ও র্যাবের কাছে তথ্য রয়েছে বেনাপোলের পোর্টখালী, শিকারপুর, রঘুনাথপুর, অভ্রভুলাট ও দৌলতপুর সীমান্ত দিয়ে নিয়মিত মাদক ঢুকছে দেছে। আন্তর্জাতিক মাদক কারবারি চক্রের অর্ধশতাধিক সদস্য এতে জড়িত রয়েছেন।
রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার : মাদক নিয়ে কাজ করেন এমন একাধিক ব্যক্তি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেছেন, বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মাদক চোরাচালানের ঝুঁকি আগে থেকেই রয়েছে। কারণ পৃথিবীর দুটি প্রধান মাদক উৎপাদন ও চোরাচালানের কেন্দ্র গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল ও গোল্ডেন ক্রিসেন্টের ঠিক মাঝখানে বাংলাদেশের অবস্থান। গত ২৫ জানুয়ারি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আফ্রিকার দেশ মালাউয়ির এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করে ৮ কেজি ৩০০ গ্রাম কোকেন উদ্ধার করা হয়। ওই বিদেশির তথ্যের ভিত্তিতে আরও তিন বিদেশি নাগরিকসহ চক্রের পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে সে সময় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী বলেছিলেন, বাংলাদেশে এটাই এখন পর্যন্ত কোকেনের সবচেয়ে বড় চালান; যা মালাউয়ি থেকে ইথিওপিয়া ও দোহা হয়ে ভারতে পাচারের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে আসে। এ চালান পার করতে বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এ চালানের আর্থিক মূল্য ১০০ কোটির বেশি। গোয়েন্দারা বলছেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে যত চালান ধরা পড়েছে তার বেশির ভাগই এসেছে দক্ষিণ আমেরিকা থেকে।
২০১৫ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে সূর্যমুখী তেলের ঘোষণা দিয়ে আমদানি করা একটি ড্রামে কোকেনের চালান পাওয়া যায়। বলিভিয়া থেকে আনা একটি কনটেইনারে ১০৭টি ড্রামের মধ্যে একটি ড্রামে তরল অবস্থায় কোকেনের অস্তিত্ব পাওয়া যাওয়ার কথা জানিয়েছিলেন শুল্ক বিভাগের গোয়েন্দারা। সে সময় গোয়েন্দারা জানিয়েছিলেন, ড্রামটিতে ১৮৫ কেজি তরল ছিল এবং তাতে এর এক-তৃতীয়াংশ অর্থাৎ প্রায় ৬০ কেজি কোকেন ছিল। এর আগে ২০১৩ সালে ৩ কেজি কঠিন কোকেনসহ পেরুর এক নাগরিককে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছরও ৫ কেজি ২০০ গ্রামের একটি চালান ধরা পড়ে বাংলাদেশে। ২০১৫ সালে বিমানবন্দরে আবারও ২ কেজি ৩০০ গ্রামের একটি চালান ধরা পড়ে। ওই মামলায় ঢাকার বিচারিক আদালত পেরুর এক নাগরিককে যাবজ্জীবন কারাদ দেন। ২০২৩ সালের জুনেও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক নারীকে পৌনে ২ কেজি কোকেনসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ইউএনওডিসির গ্লোবাল কোকেন রিপোর্ট অনুযায়ী, বৈশ্বিকভাবে নাইজেরিয়ার কয়েকটি চক্র এ ধরনের মাদক পাচারের বিস্তার ঘটিয়েছে।
গত এক বছরে যা উদ্ধার : আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসূত্র বলছেন, দেশে গত এক বছরে চোরাপথে আসা ৭০০ কেজি ৯২৮ গ্রাম হেরোইন জব্দ করা হয়। একই সময়ে কোকেন জব্দ করা হয় ১৩ কেজির বেশি। আবার গত ১৫ বছরের মধ্যে ২০২৩ সালে সবচেয়ে বেশি হেরোইন জব্দ করা হয়েছে। ডিএনসির অতিরিক্ত পরিচালক (ঢাকা বিভাগ) মুজিবুর রহমান পাটোয়ারি বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে কোকেনের ১০টি চালান ধরা পড়েছে। প্রতিটিতেই বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২০ জনকে এসব মামলায় আসামি করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
মামলা : ডিএনসির সমন্বিত তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে ৯৭ হাজার ২৪১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেপ্তার আসামি ১২ লাখ ২৮৭ জন। সে তুলনায় গত তিন মাসে মাদক কারবারি গ্রেপ্তার হয়েছে কম। মাদক উদ্ধারও কম হয়েছে। ডিএনসিসূত্র জানান, কোকেন কেনাবেচা স্থানীয় মুদ্রায় হলেও তা ট্রান্সফার হতো ক্রিপ্টোকারেন্সিতে। বাংলাদেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত নাইজেরিয়ান ছাত্র ইজাহা ইমানুয়েল ওরফে চিদারা তার বাইন্যান্স ওয়ালেটের মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে এ কাজটি করে আসছিলেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন