ঠিক যেন নিজেকে ফিরে পাওয়া, নিজের স্মৃতি আর জীবনের একটি বড় অংশ যেখানে কাটিয়েছিলেন, এক যুগ পর সেই স্মৃতিবিজড়িত প্রিয় প্রাঙ্গণে গেলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে সেনাকুঞ্জে যান সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। সঙ্গে ছিলেন নিজের ছোট পুত্রবধূ শর্মিলা রহমান।
বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে গুলশানের বাসা ফিরোজা থেকে রওনা করে সেনাকুঞ্জে পৌঁছান ৪টার দিকে। বের হন সন্ধ্যা ৬টার দিকে। বেগম জিয়ার সঙ্গে দিবসে আমন্ত্রিত নেতারা বাংলা ট্রিবিউনকে জানিয়েছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বশীলরা সম্মান প্রদর্শন করেন। প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরাসরি অনুষ্ঠানে এসে বেগম জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন।
বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপির নেতারা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন। বহু বছর পর সশস্ত্র বাহিনীর দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পেরে তারাও আনন্দিত। পুরো অনুষ্ঠানজুড়েই ‘অনানুষ্ঠানিক প্রধান কেন্দ্রবিন্দু’ ছিলেন বেগম জিয়া। ড. ইউনূস খুব সম্মান দেখিয়েছেন।
তিনি বক্তব্যে উল্লেখ করেছেন, ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া এখানে এসেছেন। একযুগ তিনি আসার সুযোগ পাননি। আমরা গর্বিত এই সুযোগ দিতে পেরে।’
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ম্যাডামের সঙ্গে ড. ইউনূস আন্তরিকভাবে কথা বলেছেন। দুই জনের মধ্যে রাজনৈতিক আলাপ হয়নি। ড. ইউনূসও করেননি, বেগম জিয়াও করেননি। ম্যাডাম আজ ডিফরেন্ট মুডে ছিলেন, উনি নিজে সেনা কর্মকর্তার স্ত্রী।’
উচ্চ পর্যায়ের একজন দায়িত্বশীল বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার একটা কথা আমার স্মরণে আছে, বেগম জিয়াকে তিনি বললেন-আপনার উপস্থিতিটা খুবই ভালো লাগছে।’
আরেক সদস্য বলেন, ‘তিনি যেন জীবনের অধিকাংশ সময়ের স্মৃতিবিজড়িত এলাকায় গেছেন। উনাকে অনেকদিন পর এরকম দেখলাম। হাসছেন, কথা বলছেন।’
আদালতের রায়ে ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টের মঈনুল হোসেন রোডের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল বেগম জিয়াকে। সেই প্লটে ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। সর্বশেষ খালেদা জিয়া ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে গিয়েছিলেন।
জানতে চাইলে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এটাতে প্রমাণ করে দেশটা যে স্বৈরাচার, ফ্যাসিস্ট রেজিমে ছিল, তারা ছাড়া আর কেউ থাকতে পারবে না, তাদের পতনের পর এবার গর্বিত সেনাবাহিনীর অনুষ্ঠানে আমরা যেতে পেরেছি। বিশেষ করে এই দিবসটি মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ দিন এবং আমরা যারা মুক্তিযোদ্ধা, তাদের জন্য বড় পাওয়াও।’
সেনাকুঞ্জে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। (ছবি শায়রুল কবির খানের সৌজন্যে)
সেনাকুঞ্জে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। (ছবি শায়রুল কবির খানের সৌজন্যে)
এই অনুষ্ঠানে কিছু দল যেতে পারেনি, এ প্রসঙ্গে ইকবাল হাসান বলেন, ‘এবার যত রাজনৈতিক দলের নেতাদের উপস্থিতি দেখা গেছে, অতীতে দেখা যায়নি।’
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, অনুষ্ঠানে জাতীয় পার্টি, সিপিবিসহ কয়েকটি দলের নেতাদের দেখা যায়নি।
বেগম জিয়ার সঙ্গে সেনাকুঞ্জে আমন্ত্রিত ছিলেন বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান। পুরোটা সময় খালেদা জিয়ার কাছাকাছি ছিলেন তিনি। কেমন ছিলেন বিএনপিপ্রধান, এমন প্রশ্নে শায়রুল কবির খান জানান, বেগম জিয়া যেখানে আসন গ্রহণ করেন, তার আশেপাশে যারা ছিলেন বিশিষ্টজনেরা, তারা তার কাছে এসে কুশল বিনিময় করেন।
শায়রুল কবির খান বলেন, ‘পুরোটা সময় ম্যাডাম অত্যন্ত প্রাণবন্ত ছিলেন। বিশিষ্টজনেরা সালাম বিনিময় করেছেন। রাজনৈতিক মধ্যমণি ছিলেন বেগম জিয়া। এরপর এক পর্যায়ে হুইল চেয়ারে বসে জনসমাগমে উপস্থিত হয়েও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন বিএনপির চেয়ারপারসন।’
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া একাধিক বিএনপিনেতা জানান, খালেদা জিয়া সেনাকুঞ্জে পৌঁছানোর পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর তাকে রিসিভ করেন। এ সময় মির্জা ফখরুল কেঁদে ফেলেন।
বেগম জিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল মোহাম্মদ নাজমুল হাসান ও বিমানবাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন স্বাগত জানান। গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেনও খালেদা জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়াসহ আরও অনেকে।
অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন ববি হাজ্জাজ। বৃহস্পতিবার রাত সোয়া আটটার দিকে এনডিএম চেয়ারম্যান এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘বেগম জিয়ার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেছি। উনি জানতে চেয়েছেন ‘কেমন আছো।’ উনি খুব অল্প-অল্প করে কথা বলছিলেন, কুশল বিনিময় করছিলেন। সুন্দর করে হাসছিলেন।
বরাবরের মতো উদযাপিত হয়েছে সশস্ত্র বাহিনী দিবস। অনুষ্ঠানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্বশীলরা অংশগ্রহণ করেন। তরুণ অফিসাররা রাজনৈতিক তরুণ নেতাদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন, কেউ-কেউ ছবি তোলেন।
এ প্রসঙ্গে আজ মধ্যরাতে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবসে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। সেখানে রাজনীতিক, বুদ্ধিজীবী, কূটনৈতিক, সিনিয়র অফিসার্স, অবসরপ্রাপ্ত জজ, সেনা কর্মকর্তাসহ নানা পর্যায়ের বিশিষ্টজনদের সঙ্গে মতবিনিময় হয়েছে। বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গেও কথা হয়েছে।’
হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলছেন মামুনুল হক
হাসনাত আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলছেন মামুনুল হক
কপালের দাগ দিয়ে মামুনুল হকের সঙ্গে হাসনাত আবদুল্লাহর কথোপকথন
সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত আয়োজনে রাজনৈতিক দলের নেতারাও পরস্পরে আলাপ-আলোচনা খোশগল্পে মেতেছেন। বিকালে অনুষ্ঠানের এক পর্যায়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ ও খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে খোশগল্প হয়।
এ সময় জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান, সারজিস আলম, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান ছিলেন।
খোশগল্পে হাসনাতের কপালে থাকা দাগের প্রসঙ্গও উঠে আসে। অনুষ্ঠানের পর এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ করলে মাওলানা মামুনুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘হাসনাত আবদুল্লাহ একটি ঘটনা বলছিলেন। একজন ছাত্র বা কেউ তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিয়েছে। লোকটি হাসনাতকে বলছিল, ‘আপনার বাবা তো অনেক বছর ধরে আমাদের এলাকায় ওয়াজ মাহফিলে যেতে পারেন না।’
‘হাসনাত আবদুল্লাহ অবাক হয়ে গেলেন, ‘আরে আমার বাবা তো ওয়াজ করেন না, ধর্মীয় কোনও ব্যক্তি না’। তখন ওই ব্যক্তি বললো, ‘আপনি মামুনুল হক সাহেবের ছেলে না?’’ শুনে হাসনাত বললো, ‘না আমি উনার ছেলে হতে যাবো কেন।’
মামুনুল হক এ প্রসঙ্গে যোগ করেন, ‘হাসনাত বলেছেন, অনেকেই ধারণা করেন, আমাদের মধ্যে কোনও আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে।’
‘ও তখন বলছিল কারণ হলো, এই যে আমার কপালে একটা দাগ আছে। ওর কপালেও এরকম দাগ আছে। ওই দাগ দেখিয়ে হাসনাত বললো, আমি প্রতিউত্তরে বললাম, ‘রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও আত্মার আত্মীয়তা তো আছেই।’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে ‘হালকা মতবিনিময় করেন’ মামুনুল হক।
অনুষ্ঠানে এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকসহ আরও অনেকে অংশগ্রহণ করেন।
প্রসঙ্গত, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুদকের একটি মামলার রায়ে কারাগারে যাওয়ার পর বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) প্রথম প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানে এলেন। এর আগে ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনীর দিবসে অংশহগ্রহণ করেন। সেই অনুষ্ঠানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থাকলেও তাদের দুই জনের মধ্যে কোনও আলাপ হয়নি।
খালেদা জিয়ার উপস্থিতি নিয়ে তার দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অভিযোগ করেন, ১২ বছর পরিকল্পিতভাবে তাকে দেশের সবচেয়ে দেশপ্রেমিক বাহিনী সেনাবাহিনী থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন