ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মেয়াদ ১০০ দিন অতিবাহিত হয়েছে। এ সময়েও নির্বাচনি রোডম্যাপের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সুস্পষ্ট বার্তা পায়নি রাজনৈতিক দলগুলো। দিন যত যাচ্ছে, ততই জোরালো হচ্ছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যু। সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। দলগুলোর প্রত্যাশা-স্বল্পসময়েই নির্বাচনি রূপরেখা দেবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একই সঙ্গে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন সংস্কারের পাশাপাশি ‘যৌক্তিক’ সময়ে নির্বাচনও চান নেতারা। চলতি মাসেই নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পরপরই দ্রুত নির্বাচনি রূপরেখা প্রকাশের দাবি জানান তারা। এদিকে সংস্কার ইস্যুতে দলগুলোর মধ্যে মতানৈক্য দেখা দিয়েছে। তবে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলই প্রয়োজনীয় সংস্কারের পক্ষে। কয়েকটি দল আবার সময় দিতে চাইছে। বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অন্তত ১৩ জন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
এদিকে মঙ্গলবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘নির্বাচনের রোডম্যাপ দ্রুত ঘোষণা করা হলে অনেক বিতর্কের অবসান হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, আর বিলম্ব না করে যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। দেশের স্থিতিশীলতার স্বার্থেই সেটি খুব জরুরি এ মুহূর্তে। নির্বাচন দ্রুত না হলে সমস্যাগুলো বাড়বে। এখন যারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে চায়, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতা ধ্বংস করতে চায়, তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে।’
নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার করে দ্রুত নির্বাচনের দিকে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেছেন, ‘সংস্কার তো অবশ্যই করতে হবে, সংস্কার করার জন্য সরকার অনেক কমিশনও গঠন করেছে। তাদের ওপর জনগণের আস্থা আছে, আমাদেরও আছে। কিন্তু আমাদের যেটা প্রত্যাশা, স্বল্পসময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করে, বিশেষ করে নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার করে সেই নতুন আলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া।’
রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, গণতন্ত্র উত্তরণের টানা ১৫ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন তাদের নেতাকর্মীরা। চলতি বছরের জুলাই-আগস্টে গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নেয় অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। গণ-অভ্যুত্থানের ঠিক তিনদিনের মাথায় সাধারণ মানুষের সমর্থন নিয়ে সরকার যাত্রা শুরু করে। এরই মধ্যে ১০০ দিন পেরিয়ে গেলেও জনগণের প্রত্যাশার তেমন একটা অগ্রগতি হয়নি। এমনকি গণতন্ত্রের সংকট থেকে উত্তরণে যে নির্বাচন দরকার, এর রোডম্যাপ কিংবা রূপরেখা প্রকাশ করেনি সরকার। এতে রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্রমেই ‘ক্ষোভ’ সৃষ্টি হচ্ছে। নির্বাচনি রূপরেখা প্রকাশ করে সংস্কার কার্যক্রম এগিয়ে নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান নেতারা।
মঙ্গলবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও নির্বাচনি রোডম্যাপসহ নানা বিষয় আলোচনায় এসেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ১০০ দিন পূর্তিতে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য না আসায় সন্তুষ্ট হতে পারেনি দলটি। প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের অন্য উপদেষ্টাদের বক্তব্যে দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, নির্বাচন প্রলম্বিত করার সন্দেহ আরও তীব্র হচ্ছে। সরকারের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নানাভাবে বিশ্লেষণ করছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করছেন, নির্বাচন প্রলম্বিত হলে রাজনৈতিক সংকট বাড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের দূরত্ব তৈরি হতে পারে এবং সেটি কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে, সেটি এখনই বলা যাবে না। এমনটা হলে পতিত সরকারের লোকেরা দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়া হবে। তবে সরকারের নেওয়া সংস্কার কার্যক্রম শেষ করতে কতদিন লাগবে, তাও স্পষ্ট নয়। এদিকে গত অক্টোবরে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনে সার্চ কমিটিও গঠন করা হয়েছে, যার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকার নির্বাচনমুখী যাত্রা শুরু করেছে বলেও কেউ কেউ মনে করে। নেতারা এও মনে করেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনি রূপরেখা প্রকাশ পেলে চলমান যে ‘সংকট ও অস্থিরতা’ রয়েছে, তা কেটে যাবে। রাষ্ট্রকাঠামোর সংস্কার ও নির্বাচনি প্রস্তুতি একসঙ্গে চলতে পারে। বিএনপির সঙ্গে সমমনা অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও সরকারের কাছে সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনি রূপরেখার স্পষ্ট ঘোষণা চায়।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা সরকারকে আহ্বান করেছি-একটা সময় উল্লেখ করে তারা যেন রোডম্যাপ দেয়, যাতে জনগণ আশ্বস্ত হয় যে তারা (সরকার) গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরে যাচ্ছে। তাতে সরবরাহ পরিস্থিতি, বাজার পরিস্থিতি, বিনিয়োগ পরিস্থিতি-সবই গতি পাবে। অনেক সমস্যারও সমাধান হবে। কারণ, অনিশ্চিত পরিবেশের মধ্যে বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সরবরাহ পরিস্থিতি সঠিক হয় না। এজন্য আমরা আহ্বান করেছিলাম যাতে নির্বাচনমুখী সংস্কারগুলো চালু থাকুক, পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং একটা সম্ভাব্য রোডম্যাপ ঘোষণা দিক। আশা করছি, সরকার শিগ্গিরই বিষয়টি আমলে নেবে এবং একটা রোডম্যাপ ঘোষণা করবে।’
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি এএইচএম হামিদুর রহমান আজাদ যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য একটা ‘যৌক্তিক’ সময় সরকারকে দিতে হবে। সেটা দীর্ঘও নয়, আবার তাড়াহুড়োও নয়। তারপরও আমরা সরকারকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছি, আপনারা সংস্কারটা যথাসময়ে শেষ করেন। কতদিনের মধ্যে সংস্কার করবেন, সেই রোডম্যাপ দিন। সংস্কার একটা চলমান প্রক্রিয়া, অনেকগুলো হবে। কিন্তু নির্বাচনসংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রের কাঠামো প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছে, এগুলোর জন্য যে সংস্কার কমিটি হয়েছে, প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো শেষ করে নির্বাচনের দিকে যথাসম্ভব চলে যাওয়া উচিত। এটাই আমরা মনে করি। জনগণও অপেক্ষা করছে। বেশি দীর্ঘায়িত হলে, সরকারের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হলে, এটা দেশের সামগ্রিকভাবে ভালো হবে না। আশা করি, সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।’
এদিকে সংস্কার দ্রুত শেষ করে নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণা করে অনিশ্চয়তা দূর করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ও চরমোনাই পির সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করিম। তিনি বলেন, অনিশ্চয়তা ও শূন্যতা নানা ধরনের জটিলতা এবং অপলাপের জন্ম দেয়। তা রোধ করার জন্য নির্বাচনের সুষ্ঠু ও অবাধ পরিস্থিতি তৈরিতে করণীয় নির্ধারণ, তার জন্য সময়সীমা ঠিক করে একটি সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন ঘোষণা করা হলে সবার জন্য কাজ করা সহজ হবে। ১০০ দিন অতিবাহিত করলেও রাষ্ট্রের ওপর অন্তর্বর্তী সরকারের নিয়ন্ত্রণ স্পষ্ট নয়, বরং দুর্বলতা স্পষ্ট বলে মনে করেন চরমোনাই পির।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনের মাথায় তাদের উচিত হবে নির্বাচন ও পরবর্তী গণতন্ত্র উত্তরণে সামগ্রিক একটা পথরেখা ঘোষণা করা। ইতোমধ্যে সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আবার একধরনের দূরত্বের জায়গাটি দেখা যাচ্ছে। এ সরকারের এক নম্বর কাজ হবে একটা অবাধ, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়ে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা।
তিনি বলেন, এ মাসের মধ্যে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। এরপর তারা দ্রুত ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার উদ্যোগ নেবেন। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচনি ট্রেন বাস্তাবে চালু হবে। কিন্তু সরকারকে নির্দিষ্ট করতে হবে তারা আগামী বছর কবে, কখন এবং কীভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করবে। ২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর সম্ভব। এখন এটা নির্দিষ্ট সময়সূচি নির্ভর করবে তাদের কাজের ওপর।
আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সদস্য সচিব মজিবুর রহমান মঞ্জু যুগান্তরকে বলেন, ‘রূপরেখা এখনই দেওয়া দরকার। এটা তো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিশ্রুতি ছিল। আশা করি, যতদ্রুত সম্ভব তিনি একটা রূপরেখা দেবেন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বলে আসছি, একটা রূপরেখা দেওয়া সম্ভব। যে কোনো একটা নির্বাচন সম্পন্ন করতে তিন মাস সময় লাগে। এটা তিন মাসে সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো এভাবেই করেছে। এখন যে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি ও সংস্কারের বিষয়গুলো বলা হচ্ছে, এগুলোর জন্য এক থেকে দেড় বছরে সংস্কার করে নির্বাচন করা সম্ভব।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, সরকার একটা রূপরেখা দিতে পারে, এটা সব মানুষেরই চাওয়া। সরকার কতদিনে কী করতে চায়, এর একটা রূপরেখা দেশি-বিদেশি সবাই প্রত্যাশা করে। আমার মনে হয়, এটা সরকারের জন্য ভালো পদক্ষেপ হবে, তারা এক বছর থাকুক কিংবা দুই বছর থাকতে চায়। এর মধ্যে সংস্কার ও প্রক্রিয়ায় কাজ করার জন্য একটা রোডম্যাপ দরকার, এটা নিয়ে সবাই কথা বলছে। আমি মনে করি, সরকার দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মধ্যেই নির্বাচনি রূপরেখা দিতে পারত। এখন তো ১০০ দিন অতিবাহিত হয়েছে, সাধারণত নতুন সরকার দায়িত্ব নিলে তারা অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কিছু কাজ করে। যেমন প্রথম ৬০ দিনে কিংবা প্রথম ৩ মাসে কী কী কাজ করবে। সেক্ষেত্রে এতদিনেও তারা রূপরেখা দিতে পারত। এটা সরকারের জন্য চাপ কিংবা আহামরি কোনো বিষয় না। সরকার চাইলে মাসখানেকের মধ্যেই একটা রূপরেখা দিতে পারে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন