দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন নিয়ে এখন দ্বিধাবিভক্ত চরমে। একদিকে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, পর্যটন খাত তাদের আয়ের প্রধান উৎস। অপরদিকে পরিবেশবিদরা সতর্ক করছেন, দ্বীপটির প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার সম্ভাব্য বিপর্যয়ের বিষয়ে। সরকারের পক্ষ থেকেও এসেছে পরিবেশ রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপের ইঙ্গিত। পর্যটন খাতে স্থানীয়দের জীবিকা এবং পরিবেশ রক্ষার বাস্তবতা—এই দুইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে সেন্টমার্টিন যেন এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে।
সম্প্রতি সেন্টমার্টিনে পর্যটকের সংখ্যা সীমিত এবং দ্বীপে রাত্রিযাপন নিষিদ্ধসহ বেশ কিছু পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বলেছেন, ‘‘দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ রক্ষায় পর্যটনে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে সরকার। সেন্টমার্টিনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গড়ে ওঠা হোটেল-মোটেলের কারণে প্রবাল ধ্বংসের পথে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২০৪৫ সালের মধ্যে সব প্রবাল ক্ষয় হয়ে সেন্টমার্টিন ডুবে যাবে।’’
তিনি জানান, সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বছরের তিন মাস (নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারি) পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে যেতে পারবেন। এর মধ্যে, নভেম্বরে দিনে গিয়ে দিনে চলে আসতে হবে; দ্বীপে রাত কাটানো যাবে না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে প্রতিদিন ২ হাজার পর্যটক যেতে পারবেন, রাতেও থাকতে পারবেন। তবে, ফেব্রুয়ারি থেকে সেন্টমার্টিন যেতে পারবেন না কোনো পর্যটক।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ
সরকারের এমন সিদ্ধান্তের পর থেকে সেন্টমার্টিন পর্যটক ভ্রমণে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার ও রাত্রিযাপন অনুমতির দাবিতে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ ও আন্দোলন করছেন স্থানীয়রা।
তাদের দাবি, পরিবেশের দোহাই দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীকে ভাতে মারার ফন্দি আঁটা হচ্ছে। বছরে চার মাস আবহাওয়া শান্ত থাকে, এই সময়েই পর্যটকরা দ্বীপে যান। বাকি আট মাস পরিবেশ উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। কিন্তু সেটা না করে, দ্বীপের ১৫ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা স্থবির করতে একপেশে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বীপে পর্যটক যাওয়া সীমিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
গতকাল মঙ্গলবার (১৯ নভেম্বর) বেলা ১২টার দিকে কক্সবাজারের ব্যস্ততম ডলফিন মোড়ে সেন্টমার্টিন ভ্রমণে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের দাবিতে সেখানকার বাসিন্দারা কাফনের কাপড় গায়ে জড়িয়ে রাস্তায় নামেন। এ সময় হাজারো মানুষ নানা স্লোগান দিয়ে সড়ক অবরোধ করেন। তাদের সঙ্গে সেন্টমার্টিনের বিভিন্ন সংগঠনসহ পর্যটন সংশ্লিষ্ট ১২টি সংগঠন অংশ নেয়।
সেন্টমার্টিনের ইউপি সদস্য খোরশেদ আলম বলেন, ‘‘সেন্টমার্টিন নিয়ে যে সিদ্ধান্ত পরিবেশ মন্ত্রণালয় নিয়েছে, তা মেনে নেওয়ার মতো নয়। এ সিদ্ধান্ত বাতিল করে আগের মতো পর্যটক যাতায়াতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক।’’
টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘পর্যটক যেতে না পারলে সেন্টমার্টিনের মানুষ না খেয়ে মরবে।’’
সেন্টমার্টিন ভ্রমণে বিধি-নিষেধ প্রত্যাহারের দাবিতে বিক্ষোভ। মঙ্গলবার বেলা ১২টার দিকে।
আন্দোলনের সমন্বয়ক দ্বীপের বাসিন্দা আব্দুল মালেক বলেন, ‘‘পরিবেশের দোহাই দিয়ে সেন্টমার্টিন দ্বীপবাসীকে ভাতে মারার ফন্দি আঁটা হচ্ছে। বছরে চার মাস আবহাওয়া শান্ত থাকে আর এই সময় পর্যটকরা দ্বীপে যায়। বাকি আট মাস পরিবেশ উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া যায়। কিন্তু সেটা না করে, দ্বীপের ১৫ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা স্থবির করতে একপেশে সিদ্ধান্ত নিয়ে দ্বীপে পর্যটক যাওয়া সীমিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আমরা আগের মতো পর্যটক যাতায়াত স্বাভাবিক হওয়া কামনা করছি। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের দাবি মেনে নেবে না, ততক্ষণ কক্সবাজার ছাড়ব না।’’
দ্বীপের বাসিন্দা তৈয়ব উল্লাহ বলেন, ‘‘দ্বীপের মানুষ চার মাস পর্যটক সেবা দিয়ে আয় করে বাকি আট মাস চলে। অথচ সীমিত পর্যটক যাতায়াত ও অবস্থানের সিদ্ধান্তে হুমকির মুখে পড়েছে দ্বীপটির ১৫ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন পর্যটন ব্যবসায়ীরা।’’
সেন্টমার্টিন দ্বীপ পরিবেশ ও পর্যটন রক্ষা-উন্নয়ন জোটের চেয়ারম্যান শিবলু আজম কোরেশি বলেন, ‘‘সেন্টমার্টিন ভ্রমণে বিধি-নিষেধের ফলে দ্বীপের হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে হুমকির মুখে পড়েছে, স্থানীয় বাসিন্দাদের জীবন-জীবিকা। ধস নেমেছে পর্যটনের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতির।’’
তবে, এই আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘‘অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের কারণে সেন্টমার্টিনের পরিবেশ-প্রতিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া, টেকনাফ-সেন্টমার্টিন নৌরুট মিয়ানমারে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে জাহাজ চলাচলে ঝুঁকি রয়েছে।’’
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. ইয়ামিন হোসেন বলেন, ‘‘আন্দোলনকারীদের সঙ্গে কথা হয়েছে। তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি সরকারকে জানানো হবে। আশা করি, দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সমাধান হবে।’’
এর আগে, ২০২২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেন্টমার্টিনকে বাঁচাতে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সে সময় সেন্টমার্টিনের পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সুরক্ষা ও ইকোট্যুরিজম উন্নয়নে কর্মপরিকল্পনাসহ ১৩টি সুপারিশ বাস্তবায়নে নির্দেশ দেয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়।
সুপারিশের মধ্যে ছিল—সেন্টমার্টিনে সব ধরনের অবকাঠামো ও সম্প্রসারণ বন্ধ থাকবে, তবে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি ব্যতীত (স্থানীয়দের ইকোলজিক্যালি বসতবাড়ি ও হাসপাতাল ছাড়া) কোনো অবকাঠামো করা যাবে না। দ্বীপের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, স্যুয়ারেজ ব্যবস্থাপনা, শব্দ ও বায়ু দূষণ রোধে কাজ হবে। এছাড়া, জোনিং ও সংরক্ষিত এলাকা নির্মাণ, হোটেল-মোটেল ও রেস্ট হাউস নির্মাণ, যানচলাচল ব্যবস্থাপনা, ১০ হাজার ম্যানগ্রোভ ও কেয়ারি বেষ্টনী বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, জমি ব্যবহার নীতিমালা, জেটি ব্যবস্থাপনা, পর্যটক জাহাজ পরিবহন, দ্বীপের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সুপারিশগুলো নিয়ে কাজ করা হবে।
তথন থেকে সেন্টমার্টিনের পরিবেশগত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হলে সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার সম্ভাব্য বিপর্যয়ের বিষয়ে আরও কঠোর হন।
বছরে চার মাস আবহাওয়া অনুকূল থাকায় ওই সময়ে পর্যটকের বিচরণ ঘটে সেন্টমার্টিনে। দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে এই নিয়ম। কিন্তু, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাতের কারণে টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে আবহাওয়ার প্রতিকূলতা ও নানা সংকটে সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাওয়া স্থবিরতা নেমে আসে।
নারিকেল জিঞ্জিরা খ্যাত সেন্টমার্টিন দ্বীপের বাসিন্দারা পর্যটক ভ্রমণে জীবিকার সুযোগ হিসেবে দেখলেও পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করছেন, এর বিরূপ প্রভাব নিয়ে। এই দ্বন্দ্বে সেন্টমার্টিনের ভবিষ্যৎ কোন পথে এগোবে, সেটি এখন জনমনে প্রশ্ন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন