দেশে আলু উৎপাদনের অন্যতম শীর্ষ জেলা বগুড়া। গত ফেব্রুয়ারিতে এ জেলার বিভিন্ন হিমাগারের ফটকে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছিল ৩০-৩৫ টাকায়। আর গত রোববার হিমাগার ফটকে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৬০-৬৫ টাকায়। এক হাত বদলের পর খুচরা পর্যায়ে সেই দাম উঠেছে ৭০ টাকায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও হিমাগারমালিকেরা বলছেন, গত এক মাসে হিমাগার পর্যায়ে আলুর দাম কেজিতে ১৫ থেকে ২০ টাকা বেড়েছে। আর প্রতি বস্তায় (৬০ কেজি) দাম বেড়েছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। হিমাগার পর্যায়েই আট মাসের ব্যবধানে আলুর দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা বাজারে। শুধু বগুড়া নয়, দেশে আলু উৎপাদনে শীর্ষ অন্য তিন জেলা রংপুর, দিনাজপুর ও মুন্সিগঞ্জের হিমাগার পর্যায়েও আলুর দাম বেড়েছে।
এদিকে বাজারে আলুর দাম বাড়তে থাকায় গত ৫ সেপ্টেম্বর জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) আলুর আমদানি শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫ শতাংশ করে। পাশাপাশি ৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কও তুলে নিয়েছে। শুল্ক কমালেও খুব বেশি আলু আমদানি হয়নি। এ কারণে শুল্ক কমানোর প্রভাব বাজারে তেমন পড়েনি, উল্টো দাম বেড়েছে।
এ অবস্থায় আজ বুধবার থেকে সরকারি প্রতিষ্ঠান টিসিবির ট্রাকে ৪০ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে আজ থেকে এই আলু বিক্রি করবে। টিসিবির ট্রাক থেকে একজন গ্রাহক সর্বোচ্চ তিন কেজি আলু কিনতে পারবেন। আগে থেকে টিসিবির ট্রাকে সাশ্রয়ী দামে সয়াবিন তেল, মসুর ডাল ও চাল বিক্রি করছে সরকার। তার সঙ্গে নতুন পণ্য হিসেবে যুক্ত হচ্ছে আলু।
বাজারে তেলের দাম যাতে না বাড়ে সে জন্য নতুন করে ভোজ্যতেলের আমদানি পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করা হয়েছে। গতকাল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বা এনবিআর এ সংক্রান্ত আদেশ জারি করেছে।
আর ডিমের দাম সহনীয় রাখতে নতুন করে আরও ১৮ কোটি ৮০ লাখ ডিম আমদানির অনুমতি দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মোট ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এই ডিম আমদানির ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আমদানি ও রপ্তানি প্রধান নিয়ন্ত্রকের দপ্তরকে চিঠি দিয়েছে। আগামী বছরের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত এ অনুমতি কার্যকর থাকবে।
আলুর দাম কেন বেশি
হিমাগারমালিক ও খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, হিমাগারে মজুত করা আলু এখন শেষ পর্যায়ে। তবে এখনো যে পরিমাণ আলু হিমাগারে রয়েছে, তাতে সরবরাহে ঘাটতি হওয়ার কথা নয়। হিমাগারে মজুত আলুর জোগান শেষের আগেই বাজারে নতুন আলু আসার কথা। এ ছাড়া কিছু আলু আমদানিও হচ্ছে। তা সত্ত্বেও বাজারে দাম বাড়ছে মূলত তদারকির অভাবে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, চলতি বছর অতিবৃষ্টি ও বন্যায় অনেক সবজিপণ্যের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এতে আলুর ওপর বাড়তি চাপ পড়েছে। আবার বন্যার কারণে নতুন আলু বাজারে আসতে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। সেই সুযোগে হিমাগারে রাখা আলুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিসেম্বরের মধ্যে বাজারে পুরোদমে নতুন আলু চলে আসার কথা। সাধারণত প্রতিবছরই নতুন মৌসুম শুরুর আগে এ সময়ে বাজারে আলুর দাম কিছুটা বাড়তি থাকে।
হিমাগার এলাকার জেলা প্রশাসন বলছে, মজুতদারেরা বেশি লাভের আশায় হিমাগার ফটকেই আলুর দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। বগুড়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মেজবাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, বেশি লাভের আশায় হিমাগার থেকে ধীরগতিতে আলু বিক্রি করছেন মজুতদারেরা। এতে বাজারে আলুর চাহিদার সঙ্গে দামও বেড়েছে।
আলুচাষি, হিমাগারমালিক ও কৃষি কর্মকর্তারা জানান, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চে হিমাগারে গত মৌসুমের আলু সংরক্ষণ শেষ হয়। ওই সময় চাষিদের কাছ থেকে ১৮ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে একশ্রেণির ব্যবসায়ী আলু কিনে তা হিমাগারে মজুত করেন। হিমাগারের ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচসহ প্রতি কেজি আলু সংরক্ষণে এককালীন সাত থেকে আট টাকা খরচ হয়। সেই হিসাবে ১ কেজি আলু হিমাগার থেকে বের হওয়া (পাইকারি বিক্রি) পর্যন্ত সর্বোচ্চ খরচ হয় ২৬ থেকে ৩৩ টাকা। গত মাসের শুরুতে বিভিন্ন জেলায় হিমাগার ফটকে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হয়েছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। এরপর হঠাৎ করে দাম বেড়ে এক মাসের ব্যবধানে তা ৬০-৬৫ টাকায় উঠে যায়। তাতে কয়েক হাত ঘুরে হিমাগার থেকে খুচরা বাজারে এসে প্রতি কেজি আলু ৭০-৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার আলু ব্যবসায়ী ইসরাফিল হোসেন বলেন, ‘আলুত যখন লস হইছেলো তখন কান্দিয়া বেড়াছি। সরকার সহযোগিতা করে নাই। এবার দাম বাড়িয়া লাভ হওচে (হয়েছে)।’ একই জেলার গঙ্গাচড়া উপজেলার আলু ব্যবসায়ী আক্তারুল ইসলাম বলেন, ‘আলু কিনে হিমাগারে রেখেছি। দাম বাড়ার পর এখন বিক্রি করছি। এখানে সিন্ডিকেট করার কিংবা অপরাধের কিছু নেই।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে আলুর চাহিদা ৯০ লাখ টন। গত মৌসুমে সারা দেশে আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় এক কোটি তিন লাখ টন। তবে হিমাগারমালিকেরা বলছেন, সর্বশেষ মৌসুমে আলু উৎপাদন হয়েছে ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টন। সে হিসাবে বাজারে চাহিদার তুলনায় প্রায় ১০-১৫ লাখ টন আলুর ঘাটতি থাকার কথা।
হিমাগারমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুসারে, গত মৌসুমে দেশের প্রায় ৩৬০টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করা হয়েছিল। এর মধ্যে বেশির ভাগ হিমাগারে থাকা আলু বিক্রি শেষ হয়েছে। রোববার পর্যন্ত ১২২টি হিমাগারে আনুমানিক ৩ লাখ টন আলু মজুত রয়েছে। এর মধ্যে খাবার আলু দেড় লাখ টন; বাকিটা বীজ আলু।
গত বছরও আলুর দাম বেড়ে ৮০ টাকায় উঠেছিল। তবে সেটা ডিসেম্বরের শেষ দিকে। আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে তখন হিমাগার পর্যায়ে নিয়মিত অভিযান চালিয়েছিল ভোক্তা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন। তবে এ বছর তদারকি দুর্বল থাকায় মজুতদারেরা দাম বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছেন বলে জানান হিমাগারমালিক ও পাইকারি ব্যবসায়ীরা।
রোববার বগুড়ার বাজারে আলু কিনতে আসেন স্থানীয় ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান। তিনি বলেন, হিমাগারের ভাড়া বাড়েনি; বিদ্যুৎ বিল বা অন্য খরচও বাড়েনি। অথচ হিমাগারে আলুর দাম খেয়ালখুশিমতো বেড়েছে। প্রশাসনের তদারকি না থাকায় এভাবে দাম বেড়েছে।
আলুর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা শুরু হলে স্বল্প পরিসরে অভিযান শুরু করেছে ভোক্তা অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন। গত এক সপ্তাহে রংপুরে ভোক্তা অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের বিশেষ টাস্কফোর্স কমিটি আলুর বাজার ও হিমাগারে ৯টি অভিযান পরিচালনা করে ১০ প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ২ লাখ টাকা জরিমানা করেছেন। অন্যান্য জেলায়ও এমন অভিযান শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে আলুর দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমরা উদ্যোগ নিতে দেরি করিনি। হিমাগারসংশ্লিষ্ট জেলার প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। তবে তাদের কাছ থেকে যথাসময়ে আশানুরূপ সহযোগিতা পাওয়া যায়নি।’
বাংলাদেশ কোল্ডস্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী প্রথম আলোকে জানান, গত জুন মাসে হিমাগার থেকে পাইকারিতে প্রতি কেজি আলু ৪২ থেকে ৪৫ টাকায় বিক্রি হয়েছিল। সেই দাম এখন বেড়ে ৬২ টাকা হয়েছে। হিমাগার পর্যায়ে এমন দাম আগে কখনো দেখা যায়নি। চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ঘাটতি থাকায় মজুতদারেরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন