দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দুর্নীতি ও অনিয়মের শত শত অভিযোগ জমা পড়লেও তফসিলবহির্ভূত অপরাধের কারণে বেশির ভাগ অভিযোগ আমলে নিতে পারে না সংস্থাটি। আইন অনুযায়ী কেবল সরকার ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংশ্লিষ্ট দুর্নীতির সাত ধরনের অভিযোগ অনুসন্ধান করতে পারে দুদক। এ আইনেরই ফাঁক গলে অনুসন্ধানের জাল থেকে বেরিয়ে গেছেন ৮০ জনের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী।
অনুসন্ধান ও তদন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২২ সালে অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া ৫২ ভাগ অভিযোগই নথিভুক্তি বা পরিসমাপ্তির (অভিযোগ অব্যাহতি) মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়েছে। অর্থাৎ অনুসন্ধান শুরু করেও ৫৮১টি অভিযোগ থেকে সংশ্লিষ্টদের অব্যাহতি বা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ৮৪ জন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন।
জানা যায়, ২০২২ সালে ৯৩টি মামলার আসামিদের এফআরটি (মামলা থেকে অব্যাহতি) দেওয়ার মাধ্যমে দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এই হার ২৮ শতাংশ। দায়মুক্তি পাওয়াদের একটি বড় অংশই সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী। ওই বছর নথিভুক্তি ও এফআরটি মিলিয়ে ১৫০ জনের বেশি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দুর্নীতির দায় থেকে অব্যাহতি বা মুক্তি পেয়েছেন। আবার অনুসন্ধান শুরু করেও ৫৮১টি অভিযোগ থেকে সংশ্লিষ্টদের অব্যাহতি বা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।
দুদকের অনুসন্ধানে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরিসমাপ্তি ও এফআরটি নিয়ে হরহামেশাই নানা বিতর্ক উত্থাপিত হয়। অনেকের ধারণা- আর্থিক লেনদেন কিংবা ক্ষমতা দেখিয়ে অবৈধ উপায়ে দুর্নীতির দায় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। যে কারণে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দুদককে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। মাঝে মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে সংশ্লিষ্ট তদন্ত কর্মকর্তাকে তলব করে ব্যাখ্যা চাওয়ারও নজির রয়েছে।
দুদক থেকে পাওয়া বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০২২ সালে ৪ হাজার ৬৩৩টি অনুসন্ধান চলমান ছিল। এর মধ্যে কমিশনের অনুমতি নিয়ে ১ হাজার ১১৯টি অনুসন্ধান নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ৪০৬টি মামলা হয়েছে। সেখানে ১৭২টি মামলা সম্পদ বিষয়ক। ৫৮১টি অনুসন্ধান পরিসমাপ্তির মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়। বাকি ১৬৩টি অনুসন্ধান বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয়।
দুদক সূত্র জানায়, অভিযোগ থেকে অব্যাহতির ওই তালিকায় সবচেয়ে বেশি নাম ছিল বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের। অবৈধ পাসপোর্ট তৈরিসহ বিভিন্ন অনিয়ম ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের দায় থেকে মুক্তি পেয়েছেন ওই অধিদপ্তরের পরিচালকসহ ১৫ কর্মকর্তা। বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. শিহাব উদ্দিন খান, তার স্ত্রী ও জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতালের ই-পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের (নিটোর) জুনিয়র কনসালটেন্ট শারমিন আরা বেগম, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ডেমোগ্রাফি শাখার উপপরিচালক হালিমা খাতুন সম্পা, উপপরিচালক (প্রশাসন) ইসমাইল হোসেন, উপপরিচালক (সংস্থাপন) তারিক সালমান, সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) আজিজুল ইসলাম, সিস্টেম অ্যানালিস্ট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ভূঞা ও তার স্ত্রী শাফিনাজ আক্তার, মাগুরা জেলা অফিসের সহকারী পরিচালক নাসরিন পারভীন নূপুর, পাসপোর্ট অধিদপ্তরের উপসহকারী পরিচালক (প্রশাসন) সফিকুল ইসলাম, সহকারী মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার কানিজ ফাতেমা চৌধুরী, মাহমুদুল হাসান ও সহকারী হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা মোহাম্মদ মাসুদ রানা। এ ছাড়া পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (সিআরআই) জেবুন্নাহার পারভীন ও ফেনী আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক মোক্তার হোসেনও দায়মুক্তি পেয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, দুদকের অনুসন্ধান ও তদন্ত আইন অনুযায়ী করে থাকে। এর বাইরে দুদকের যাওয়ার সুযোগ নেই।
অব্যাহতি পাওয়া অন্য কর্মকর্তারা হলেন- জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী সাইফুর রহমান, নরসিংদী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী বশির আহম্মেদ, পাবনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান হাবীব, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক প্রশাসনিক কর্মকর্তা হুমায়ুন কবির, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (মেরিন) মো. মহিউদ্দিন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের ওয়্যারহাউস ইন্সপেক্টর মো. নুরুজ্জামান, ঢাকা কাস্টম হাউসের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মাহফুজুর রহমান, চট্টগ্রাম কাস্টম কমিশনার কার্যালয়ের অফিস সহায়ক মো. দিদারুল আলম, কর অঞ্চল-১০ এর উপকমিশনার মো. হুমায়ুন কবির, জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের (ট্রেসার) মো. আবদুল বাতেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের সাবেক সিনিয়র ট্রাফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট মো. মোসলেহ উদ্দিন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ক্যাশিয়ার মো. শাহীনুল আলম, পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শমশের আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর চৌধুরী সারওয়ার জাহান, বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রকল্প পরিচালক ড. তালুকদার নুরুন্নাহার, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক এস এম সামসুল কবীর, ফেনী জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাবেক উচ্চমান সহকারী এ কে এম আবদুল্লাহ ভূঁঞা, বিএসটিআইর সাবেক ফিল্ড অফিসার (সিএম) সাফায়েত হোসেন, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাবেক এডিসি মো. আবু হাসান সিদ্দিক, নোয়াখালীর সাবেক জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. মোতালেব হোসেন, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. ফজলুর রহমান খান (এফ আর খান), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম প্রধান (যুগ্ম সচিব) মো. জালাল আহম্মেদ, কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক মো. আনোয়ার হোসেন, মাগুরা সহকারী উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মো. দারুল আলম, খাগড়াছড়ির পানছড়ির সাবেক ইন্সপেক্টর (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) এ কে এম মঈনুল খাইর, ময়মনসিংহ ত্রিশালের মেয়র এ বি এম আনিছুজ্জামান, ফেনী সোনাগাজীর মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন, সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী বৃক্ষপালনবিদ মো. কামাল উদ্দিন মোল্লা, সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলা সহকারী সেটেলমেন্ট অফিসার কাম বেঞ্চ সহকারী মো. লিয়াকত আলী, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হাসান মোস্তফা চৌধুরী, বেনাপোল পোর্ট থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) অপূর্ব হাসান। তিনি পরবর্তীতে ঢাকার তেজগাঁও এবং পল্লবী থানারও ওসি হন, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এ ছাড়া লক্ষ্মীপুর সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের সাবেক সাবরেজিস্ট্রার অসীম কুমার বণিক, বরিশাল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর সাবেক জেনারেল ম্যানেজার প্রকৌশলী শংকর কুমার কর, ফেনী পৌরসভার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আজিজুল হক, চট্টগ্রাম সিডিএ প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান, ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলা হিসাব রক্ষণ অফিস অডিটর মো. রুহুল আমীন, ময়মনসিংহের ১১ নম্বর ঘাগড়া ইউপি চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান সরকার সাজু, নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (নেসকো) সহকারী হিসাবরক্ষক মো. ফজলুল হক, সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টাওয়ার কন্ট্রোল ও ব্যবস্থাপক মো. হাফিজ আহমেদ, কিশোরগঞ্জ পাকুন্দিয়ার দক্ষিণ মাইজহাটী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. আশরাফুল আলম, পঞ্চগড় এলজিইডির ল্যাব টেকনিশিয়ান সৈয়দ মুুর্তুজা আলী খন্দকার, বাংলাদেশ এক্সপোর্ট জোন অথরিটির (বেপজা) চেয়ারম্যানের পিএস-২ আবদুল্লাহ আল মাহবুব (ডিজিএম), জেলা পরিষদের উচ্চমান সহকারী মো. সফিকুল ইসলাম, চট্টগ্রামের এল এ শাখার সার্ভেয়ার শহীদুল ইসলাম, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সাবেক প্রধান সহকারী (রাজস্ব শাখা) মোহাম্মদ ইউনুছ, ময়মনসিংহের ফুলপুর ৩ নম্বর ভাইটকান্দি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন আহমেদ, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নির্বাহী প্রকৌশলী (মেরিন) মো. মহিউদ্দিন, গলাচিপা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন মোহন, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তালমা কৃষি প্রজনন কেন্দ্রের অফিস সহকারী মো. আসলাম খান, অ্যালকো ফার্মা লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার (কমার্শিয়াল) মো. শাখাওয়াত হোসেন, বরিশাল মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বোর্ডের উপপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন, কুড়িগ্রাম ফুলবাড়ি উপজেলার মৎস্য কর্মকর্তা মো. মাহমুদুন্নবী মিঠু, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সাবেক সিভিল সার্জন ডা. নিশিত নন্দী মজুমদার, রাজবাড়ী সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী চৌধুরী সাজ্জাদ আরেফিন, কোম্পানীগঞ্জ পূর্ব মুছাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম, যশোর উপজেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা কাজী আনোয়ারুল আলম, পদুয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক, চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সহকারী কলেজ পরিদর্শক এ কে ফজলুল হক, সুন্দরবন শরণখোলা স্টেশন কর্মকর্তা মো. আবদুল মান্নান, ঢাকা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী মিজানুল করিম, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের প্রাণিসম্পদ কোয়ারেনটাইনের ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান মো. আকতার হোসেন, ঢাকার বেগম বদরুন্নেছা সরকারি মহিলা কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোছা. খুজিস্তা আক্তার বানু, বরিশাল জেলা রেজিস্ট্রার নৃপেন্দ্র নাথ সিকদার, মাতুয়াইল ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড অ্যান্ড মাদার হেলথের (আইসিএমএইচ) সহকারী সার্জন ডা. জোহুরা খাতুনের নামও অব্যাহতির তালিকায়। দুদক বলছে, অনিষ্পন্ন তদন্তসহ ২০২২ সাল পর্যন্ত মোট ১ হাজার ৯৯৭টি মামলা চলমান। এসব মামলার মধ্যে ২২৪টির তদন্ত শেষে চার্জশিট বা অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। ৯৩টি মামলার এফআরটি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৪টি মামলা তদন্তের জন্য অন্য সংস্থায় পাঠানো হয়েছে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন