ফের দেশে ফিরে এলো গায়েবি মামলা। দীর্ঘ প্রায় ষোল বছর দেশে গায়েবি মামলায় জেল খেটেছেন হাজার হাজার বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মী। এতে একদলীয় শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট দেশের মানুষ ক্ষুব্ধ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এরই জের ধরে জুলাইয়ে কোটার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জন্ম হয়। ধীরে ধীরে তা তীব্র হয়। জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে সরকার। এর দায়ে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রধান শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। হাসিনা দেশ থেকে পালালেও তার আমলে সৃষ্টি গায়েবি মামলা পালায়নি। বরং বর্তমান সময়ে এসে গায়েবি মামলা ফিরে আসার পাশাপাশি মামলা বাণিজ্যও বেড়েছে বহুগুণ। জুলাই-আগস্ট হত্যাকাণ্ডে দেশের বিভিন্ন থানায় মামলা করেন নিহতদের স্বজনরা। এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে আসামি করা হয়েছে। কিন্তু এসব মামলায় নিরীহ অনেক মানুষকে ব্যক্তিগত শত্রুতা, এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্বে আসামি করার অভিযোগ রয়েছে। কোনোদিন রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলন ভিন্নদিকে প্রভাবিত করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা ছিল না এমন ব্যক্তিও আসামি হয়েছেন। নিহতদের যে স্বজন বাদী হয়ে মামলা করেছেন তারা নিজেরাই অনেক আসামিকে চিনেন না। কখনো তাদের নামও শুনেননি। এসব হত্যা মামলায় আসামি করা হয়েছে হাজার হাজার ব্যক্তিকে। এ ছাড়া কোনো কোনো মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে আরও কয়েক শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলার এজাহারের বর্ণনা একই। উপরের সারির আসামিরা একই। নিচের সারিতে যারা আসামি তাদের নামের ক্ষেত্রে ভিন্নতা থাকলেও অভিযোগ আছে এসব আসামিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, হয়রানি ও শত্রুতাবশত আসামি করা হয়েছে। ঢালাওভাবে এসব মামলার কারণে ভুক্তভোগীদের সুবিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া অন্তত ৩০টি মামলার এজাহার বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। আন্দোলন দমাতে ছাত্র-জনতাকে নির্মমভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলাকারী, হত্যার ইন্ধনদাতা ও নির্দেশ প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব মামলায় তৎকালীন সরকারি দলের নেতৃস্থানীয় হাই-প্রোফাইল ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হত্যা মামলা প্রমাণের জন্য কিছু আলামত লাগে। কিন্তু গণহত্যা মামলা আদালতে গেলে অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে। কারণ এসব হত্যা মামলা প্রমাণের যথেষ্ট আলামত তদন্ত সংশ্লিষ্টদের কাছে নেই। অনেক ভুক্তভোগীর ময়নাতদন্তও করা হয়নি। ঢালাওভাবে শত শত আসামিকে মামলা করার জন্য এসব মামলা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও হচ্ছে ব্যাপক। কেউ কেউ বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের মতো আবারো গায়েবি মামলা ফিরে এসেছে। ওই সময় বিএনপি নেতাকর্মীদের দমিয়ে রাখার জন্য বিভিন্ন থানায় ডজন ডজন মামলা দেয়া হতো। মূলত নেতাকর্মীদের হয়রানি করার জন্য তৎকালীন পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা মামলার বাদী হতেন। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে করা এসব মামলার আসামি, স্থান, সময় নিয়ে তখন নানা বিভ্রান্তি ছিল। অনেক মৃত ও প্রবাসে থাকা ব্যক্তিদেরও আসামি করা হয়েছে। ঘটনাস্থলে কখনোই উপস্থিত ছিলেন না এমন ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে। অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে অবস্থান করা এবং নিরীহ ব্যক্তিরাও মামলার আসামি হয়েছেন। ব্যক্তিগত শত্রুতাবশত টাকার বিনিময়ে অনেকের নাম এজাহারে ঢুকানোর অভিযোগও ছিল। কাল্পনিক ঘটনায় করা বেশির ভাগ মামলার এজাহারের বর্ণনাও একই ছিল। থানা পুলিশ ও ডিবি এসব মামলার রেফারেন্সে নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করতো। গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেকে বছরের পর বছর পরিবার পরিজন নিয়ে বাড়ি ছাড়া ছিলেন। বিএনপি সভা সমাবেশ বা আন্দোলনের ডাক দিলে আগের কয়েকদিন গ্রেপ্তার অভিযান চালিয়ে নেতাকর্মীদের আদালতে পাঠানো হতো। আওয়ামী লীগ সরকারের এসব গায়েবি মামলা নিয়ে তখন মানবাধিকার সংগঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন মহল তীব্র নিন্দা ও উদ্বেগ জানিয়েছিল। ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মধ্যদিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। আড়ালে আবডালে থাকা বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো সামনে চলে আসে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আন্দোলনে নিহতদের স্বজনদের বলপ্রয়োগ করে বাদী করে বিভিন্ন থানা ও আদালতে মামলা হয়। ঢালাওভাবে আসামি করায় প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এসব মামলা। এসব মামলাকে আওয়ামী লীগ শাসনামলের কাল্পনিক মামলার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে।
বাদী চিনেন না আসামিদের: যাত্রাবাড়ী থানায় দায়ের করা কয়েকটি হত্যা মামলার এজাহার পর্যালোচনা করে দেখা যায়, সবগুলোতে প্রায় একই ধরনের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। আলাদা আলাদা হত্যা মামলা হলেও সেগুলোতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ একই মন্ত্রীদের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ঢালাওভাবে আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদীরা জানিয়েছেন, এসব মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অধিকাংশকেই তারা চেনেন না। রাজনৈতিক দলের প্রভাবে ঢালাওভাবে মামলাগুলো দেয়া হয়েছে। এমনকি মামলার বাদী হওয়ার জন্য হুমকির শিকার হতেও হয়েছে অনেককে। যাত্রাবাড়ী থানার ৬/৭৯২ নং মামলার এজাহারে দেখা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে ইমরান হোসেন (১৯) নিহত হন। ওই ঘটনায় নিহতের মা কোহিনূর আক্তার বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ একাধিক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৯৮ জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা করেন। এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা আরও অনেকের নামে মামলা দেয়া হয়। তবে মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের অনেকেই বাদী কোহিনূর আক্তার চেনেন না বলে মানবজমিনকে জানিয়েছেন। তিনি জানান, রাজনৈতিকভাবে চাপাচাপির কারণে এভাবে এতজনের নামে মামলা করতে হয়েছে তাদের। কোহিনূর বলেন, মামলা করেছি, এখন যা হওয়ার হবে। রাজনৈতিকভাবে অনেক চাপাচাপি ও ঝামেলা ছিল। যারা শহীদ হয়েছেন তাদের স্মরণ না করে তখন যার যার রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত ছিল তারা। সে কারণে অনেক চাপাচাপিতে মামলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, যাদের নামে মামলা হয়েছে তাদের কিছু মানুষকে চিনি। সবাইকে চিনি না। আমার ছেলেকে যে মেরেছে তা নয়, সারা বাংলাদেশে যাদের মারা হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে একই হুকুমদাতা, একই উস্কানিদাতা হিসেবে মামলা করা হয়েছে। আমার একজন মামা ও একজন আইনজীবী মামলা করতে সহায়তা করেছেন। মামা জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করেন। যাত্রাবাড়ী থানার ৪৫/৮৩১ নং মামলাতেও অজ্ঞাতনামাসহ শতাধিক আসামি করে মামলা দেয়া হয়েছে। এরমধ্যে ৪৬ জনের নাম উল্লেখ করা হলেও তাদের সবাইকে ঠিকমতো চেনেন না বলে জানান মামলার বাদী মামুনুর রশিদ। তাকে হুমকি দিয়ে কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা যাত্রাবাড়ী এসে আসামিদের নাম উল্লেখ করে মামলা দিয়েছে। বাদী মামুনুর রশিদ বলেন, আমরা তখন মানসিকভাবে ভালো ছিলাম না। লাকসাম থেকে লোকজন ঢাকায় এসে তারাই এই নামগুলো দিয়েছে। তারা বলেছে, আমি বাদী হয়ে তাদের মতো করে মামলা না করলে, আমাদের বিরুদ্ধেই পুলিশকে বাদী করে মামলা দিয়ে দিতো। যাত্রাবাড়ী থানার ১০/৭৯৬ নং মামলাতে ৪৪২ জন আসামির নাম দিয়ে হত্যা মামলা করা হয়েছে। এই মামলাতেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ একাধিক মন্ত্রী, আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মী, পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অজ্ঞাতনামা আরও অনেককে আসামি করা হয়েছে। মামলার বাদী মো. আবু বক্কর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ নং ওয়ার্ডের আহ্বায়ক। এক মামলায় এতজনকে আসামি করার কারণ জানতে চইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি না হয়ে তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় তো আপনি ছিলেন না। মাঠে আমরা আন্দোলন করেছি। গুলির শব্দ শুনেছি। অনেক কিছু চোখে দেখছি। মোবাইলে আমি কোনো স্টেটমেন্ট দিবো না।
এজাহার-আসামি একই: জুলাই- আগস্টের হত্যাকাণ্ডে নিউমার্কেট থানায় চলতি বছরের আগস্ট মাস থেকে নভেম্বর মাসে দুইটি হত্যা মামলা হয়েছে। দুইটি মামলায়ই আসামি করা হয়েছে ১৩৮ জনকে এবং অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে ৩৪০ জনকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত-নিহত হওয়ার ঘটনায় গত ২১শে আগস্ট আব্দুর রহমান নামে এক ব্যক্তি বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর-৪/৯০। সেখানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৩১ জনকে আসামি করা হয়। ঘটনার দিন নিউমার্কেট থানার নীলক্ষেত এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্ট ৪০ থেকে ৫০ জন পুলিশ কর্মকর্তা ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ব্যক্তিবর্গসহ আরও ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। মামলার বাদী আব্দুর রহমান মানবজমিনকে বলেন, গত ১৯শে জুলাই আমার ভগ্নিপতি নিউমার্কেট এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন। মাথার পেছনে গুলি লাগলে সেদিনই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। এ ঘটনায় গত ২১শে আগস্ট নিউমার্কেট থানায় মামলা করি। আমাদের সন্দেহ থেকে আসামিদের নামগুলো দিয়েছি। পুলিশ তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিবে। গত ২১শে আগস্ট নিউমার্কেট থানায় সামসি আরা জামান নামে এক নারী আরেকটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর-৩/৮৯। আন্দোলনে অংশ নিয়ে তার সন্তান তাহির জামান প্রিয় (২৭) গুলিতে নিহত হন। এই মামলায় শেখ হাসিনাসহ ৭ জনকে আসামি করা হয় এবং অজ্ঞাতনামা ৩০ থেকে ৪০ জন পুলিশ এবং বিজিবি’র কর্মকর্তা এবং সদস্যও রয়েছেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখন পর্যন্ত রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানায় মোট ৩৩টি মামলা দায়ের হয়েছে। বেশির ভাগ মামলাতেই প্রধান আসামি শেখ হাসিনা। এ ছাড়া মামলার আসামি হয়েছে সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক এমপি জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন-অর-রশীদসহ আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে। মোট ৩৩টি মামলায় ৫ হাজারের বেশি মানুষকে আসামি করা হয়েছে। সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহত হওয়ার ঘটনায় গত ১২ই নভেম্বর মিস্টার হোসেন নামে একজন বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ ২৭৭ জনকে আসামি করে মামলা করেছে মোহাম্মদপুর থানায়। মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইফতেখার হাসান বলেন, আমাদের কাজ মানুষকে সেবা দেয়া, আমরা সেটাই করছি। কার নামে কে মামলা দিচ্ছে বা তার পেছনে কী উদ্দেশ্য বা বাণিজ্য হচ্ছে কিনা আমরা তা বলতে পারবো না। আমাদের এখান থেকে কোনো মামলার কাগজও দেয়া যাবে না। মামলা সম্পর্কে আমাদের তথ্য দেয়া নিষেধ। গণমাধ্যম কর্মীরা যদি মামলার বিষয়ে বাদীর সঙ্গে কথা বলে তাহলে আমাদের তদন্ত কাজে সমস্যা হতে পারে। তাই মামলার বিষয়ে জানতে হলে আদালতে যেতে হবে। গণহত্যার ঘটনায় রামপুরা থানায় যে ১৫টি মামলা হয়েছে তার অন্তত ১৩টিতেই শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। সব মামলায় প্রায় ৮০০ জনকে আসামি করা হয়েছে। ঘুরেফিরে সব মামলায় আসামিরা একই। মামলায় ঘটনাস্থলও প্রায় কাছাকাছি দেখানো হয়েছে।
বিদেশে থেকেও আসামি: গত ২৪শে জুলাই মেয়েকে দেখতে কানাডা যান এভিআর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান হাসিব আলম তালুকদার। কিন্তু বিদেশে থাকলেও তিনি গণহত্যা মামলার আসামি হয়েছেন। তার ছোট ভাই আশিককেও আসামি করা হয়েছে। যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গত ৫ই আগস্ট নিহত হন পিকআপ চালক মো. শাহীন। এই ঘটনায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন তার স্ত্রী স্বপ্না বেগম। গত ৭ই সেপ্টেম্বর ঢাকার যাত্রাবাড়ী থানায় এ মামলা দায়ের করা হয়। মামলায় ৮৭ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাত আরও ২ হাজার ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। ঐ মামলায় ১৮ নম্বর আসামি করা হয়েছে হাসিব আলমকে ও ৪৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে তার ভাই আশিকুর রহমানকে। হাসিব আলম তালুকদার জানিয়েছেন, তিনি ২৫শে জুলাই কানাডা চলে যান। এখনো তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। তার ধারণা বরিশালের বাউফলকেন্দ্রিক কেউ হয়রানি করার উদ্দেশ্যে এই মামলার সঙ্গে তার নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে। একইভাবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ৫ই আগস্ট রাজধানীর মিরপুর-১৪ কাফরুলে নিহত হন ভোলার চরফ্যাশনের মো. ফজলু। এ ঘটনায় বিদেশে থেকেও হত্যার অভিযোগে মামলার আসামি হয়েছেন ওমান প্রবাসী লোকমান। মামলায় ৪৯ নং আসামি করা হয়েছে তাকে। অথচ ঘটনার সময় তিনি ওমানে ছিলেন, বর্তমানেও তিনি ওমানেই অবস্থান করছেন। জানা যায়, এই মামলায় এমন অনেকেই আছেন যারা ঘটনার সময় ঢাকায় ছিলেন না। কেউ কেউ নিজ কর্মস্থলে ছিলেন। মামলা সূত্রে জানা যায়, এ হত্যার ঘটনায় দেশের বিভিন্ন জেলার ৭১ জনসহ অজ্ঞাত আরও ২/৩শ’ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। এসব আসামির মধ্যে ৫ জন ভোলার লালমোহন উপজেলার বাসিন্দা। আদাবর থানায় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নামেও মামলা হয়েছে। অথচ তিনিও আন্দোলনের সময় বিদেশে ছিলেন। শুধু বিদেশে অবস্থানরতরাই নয় রাজনীতি বা ছাত্র-জনতার আন্দোলনবিরোধী ছিলেন না, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরিসহ অন্যান্য পেশার সঙ্গে সাধারণ জীবনযাপন করেও অনেকে আসামি হয়ে এখন থানায় থানায় ঘুরছেন।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গণহত্যা মামলার তদন্ত নিয়ে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের অনেক বেগ পেতে হবে। ঢালাওভাবে মনগড়া যেভাবে আসামি করা হয়েছে এসব মামলার তদন্ত করে চার্জশিট দেয়াই চ্যালেঞ্জ হবে। আর চার্জশিট দিলেও মামলার বিচার কার্যক্রম শুরু হলে যথেষ্ট তথ্য প্রমাণ ও আলামতের অভাবে আসামিদের শাস্তি পর্যন্ত নাও হতে পারে। এ কারণে অনেক আসামি অপরাধ করা সত্ত্বেও আইনের ফাঁকফোকরের কারণে মুক্তি পেয়ে যেতে পারে। কারণ আন্দোলনে যারা নিহত হয়েছেন তাদের অনেকেরই ময়নাতদন্ত হয়নি। হত্যা মামলায় মৃত্যুর প্রকৃত কারণ বের করার জন্য ময়নাতদন্ত রিপোর্ট খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর কথা বলা হলেও সরাসরি কে গুলি করে হত্যা করেছে তারও প্রমাণ নেই। তাকে শনাক্ত করাও কঠিন হবে। মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদেরকে হুকুমদাতা ও নির্দেশদাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে করে মামলার গোড়ায়ই গলদ থেকে যাচ্ছে।
সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক মানবজমিনকে বলেন, একটা মামলায় যদি ২০০ আসামি থাকে। কে সম্পৃক্ত ছিল আর কে ছিল না। তার কি ভূমিকা ছিল এগুলো তদন্ত করে রিপোর্ট দেয়া প্রায় অসম্ভব হবে। ফলে এসব এজাহারের মামলার বিচার হওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ মনে হচ্ছে। মামলা বাণিজ্য নিয়ে তিনি বলেন, এদিকে সরকার পর্যাপ্ত দৃষ্টি দিচ্ছে না। পুলিশের মধ্যেও অনেক ওলটপালট হয়েছে।
এদিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বরিশাল পুলিশ লাইন্সে এক অনুষ্ঠানে বৃহস্পতিবার বলেছেন, কারও নামে হয়রানিমূলক মামলা করা হলে বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আমরা এ ধরনের একটি সার্কুলার দিয়েছি, যেন এ ধরনের মামলা না নেয়া হয়। তিনি বলেন, এখন অনেক মামলা হচ্ছে, তাতে অনেক নিরপরাধ লোকদের ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। আমি বাহিনীর প্রধানদের বলছি, যারা এ ধরনের মামলা করছে, তাদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন নেয়ার জন্য। যদি এ ধরনের মামলা নেয়া হয়, তাহলে বাদীর বিরুদ্ধে যেন অ্যাকশন নেয়। এর আগে ঢালাও মামলা নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা ওঠার পর সরকারের পক্ষ থেকে পুলিশ বাহিনীকে যাচাই বাছাই করে মামলা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। মঙ্গলবার আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলও বলেছেন, দেশে ঢালাও মামলার প্রবণতা দেখা দিয়েছে যা বিব্রতকর। এসময় তিনি বলেন, দু’টি বিষয়ে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের কাছে সহায়তা চেয়েছেন। বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে গায়েবি মামলা হতো। সরকারের পক্ষ থেকেও গায়েবি মামলা দিতো। আর এখন আমরা সরকারের পক্ষ থেকে কোনো মামলা দিচ্ছি না। সাধারণ লোকজন, ভুক্তভোগী, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ তারা অন্যদের ব্যাপারে ঢালাও মামলা দিচ্ছে। ঢালাও মামলার একটা মারাত্মক প্রকোপ দেশে দেখা দিয়েছে। এটি আমাদের অত্যন্ত বিব্রত করে।
অপরাধ বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বিগত সময়ে আমরা মামলা বাণিজ্য নামক একটি প্রক্রিয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়েছি। ব্যক্তি ওই অপরাধের সঙ্গে কোনোভাবে সম্পৃক্ত না, অথবা ব্যক্তি জীবিত নেই বা দেশে থাকেন না- এদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে। এসকল মামলায় উদ্দেশ্য ছিল দু’টি, সেটি হলো- সরকার রাজনৈতিকভাবে বিরোধী মত অথবা তার বিপরীত যে পক্ষ ছিল অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, অথবা এলাকা বা রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে দূরে রাখা। আর পুলিশের একটি অংশ এখান থেকে আর্থিকভাবে সুবিধাভোগী হয়েছে। এসকল মামলা যাদেরকে দিয়েছে তাদের কাছ থেকে নামটাকে বাদ দিবে বা আসামির সংখ্যাটা নিচের দিকে দিবে এরকম নানা ফন্দি ফিকির অথবা উপায়গুলো উপস্থাপন ওই অভিযুক্ত ব্যক্তি বা তার পরিবারের কাছ থেকে নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা নিয়েছে। এখন গত ৫ই আগস্টের পরে কিন্তু আমাদের এরকম হয়রানি, গায়েবি মামলা, মামলা বাণিজ্য বা অন্যান্য প্রসঙ্গ এগুলো থাকবে না এই প্রত্যাশা কিন্তু আমাদের সকলেরই ছিল। প্রথম দুই মাস আমরা এর খুব একটা বেশি উপস্থিতি দেখিনি। কিন্তু পুলিশের মধ্যে একটি অংশ হয়তো এরকম মনে করছে যে, আসলে পরিস্থিতি একটি সময় গিয়ে পরিবর্তন হবে এবং তারা আগে যা করতেন সেটি হয়তো তারা করার সুযোগ পাবেন। এই প্রসঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকেই বলা হয়েছে যে, গায়েবি মামলার সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে, মানুষের নামে মিথ্যা মামলার সংখ্যাটা বেড়ে যাচ্ছে বা মানুষকে নানাভাবে কোথাও না কোথাও হয়রানি করা হচ্ছে এবং এই মামলা দেয়া না দেয়া এই প্রসঙ্গগুলোকে নিয়ে আর্থিক ভাগ-বাটোয়ারার প্রসঙ্গগুলো তৈরি হচ্ছে। এখন এই সবকিছু মিলে আমাদের যে পরিবর্তন বা সংস্কারের মধ্যদিয়ে আমরা যদি সুবিধাটা করতে চাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আইনপ্রয়োগের প্রসঙ্গ ধরে যত ধরনের অন্যায়-অনিয়ম কিংবা মানুষের অধিকারবহির্ভূত বা বিরোধী যে সমস্ত ব্যবস্থাগুলোর অভিযোগ আছে সেই ব্যবস্থাগুলোকে কিন্তু বাদ দিতে হবে।
তিনি বলেন, এই গায়েবি মামলা পরিমাণে বা সংখ্যায় অল্প হলেও আবার ফিরে এসেছে বা ফিরে আসার চেষ্টা করছে। যাদের মাধ্যমে ফিরে আসছে তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করা প্রয়োজন। অন্যথায় আমরা যদি আবার সেই পুরনো সংস্কৃতিতে ফিরে যাই তখন যে বাস্তবতা দাঁড়াবে সেই প্রসঙ্গগুলো কিন্তু আমাদের এই সংস্কারের কার্যক্রমকে সাধারণ মানুষের মাঝে নানাভাবে প্রশ্ন তৈরি করবে এবং মানুষ কিন্তু আবার হয়রানি হওয়া এবং তার নাগরিক অধিকার থেকে নিরাপত্তার প্রশ্নে, মতামত প্রকাশের প্রশ্নে অর্থাৎ সাংবিধানিক অধিকার ভোগ করতে গিয়ে সে কিন্তু আবার পুলিশকে দোষারোপ করবে এবং পুলিশের সঙ্গে আবার জনগণের আস্থার যে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার কথা সেটির পরিবর্তে সংশয় ও ভয় তৈরি হবে। কোনোভাবে যাতে নাগরিকের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি না হয় এই প্রসঙ্গে সতর্ক থাকতে হবে। তৌহিদুল হক বলেন, এই মামলাগুলো আমি দেখি যে একটা আজব মামলা। যিনি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যিনি বাদী তিনি আসামিদের চিনেন না। যখন একটি অনিয়ম দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকে এই অনিয়মটাকে লাগাম টেনে ধরতে একটা সময় লাগে। যারা সুবিধা নিবে বা নিয়েছে তাদের অনেকেই এখন মাঠে আছে। এই অনিয়মটাকে চর্চা করার চেষ্টা করবেন বা চেষ্টা করছেন। জুলাই বিপ্লবে কোনো পরিবারের একজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এখন তাকে পুঁজি করে রাজনৈতিকভাবে অথবা অন্য কোনো স্বার্থকে পূরণ করার জন্য এইভাবে যদি আইনি কাঠামো বা ঘটনার পরিপন্থি মামলার সংখ্যাগুলো যখন তৈরি হয় এটি যখন গণমাধ্যমে আসে তখন কিন্তু মানুষের সেই আস্থার জায়গাটি নিয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন তৈরি হয়। এই ধরনের মামলার কিন্তু আইনিভাবে মেরিট বা ভিত্তি দুর্বল থাকে। যদি একজনও সত্যিকার অর্থে অভিযুক্ত থাকেন তিনিও কিন্তু একটা সময় গিয়ে ওইভাবে মামলার আসামি হওয়ার কারণে তিনিও পার পেয়ে যান। মামলা যদি করার মূল উদ্দেশ্য থাকে প্রকৃত অভিযুক্তকে বিচারের মুখোমুখি করার তাহলে মামলাগুলো এমন হওয়ার কথা না। সেক্ষেত্রে সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি একটি নির্দেশনা ছিল যে, মামলা করার আগে যাচাই-বাছাই করবেন- এটি আরও জোরালো হওয়া প্রয়োজন সেটি কিন্তু আমরা দেখছি না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও যাতে কারও দ্বারা ব্যবহৃত না হন অথবা কেউ যাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সামনে রেখে তার ব্যক্তিগত কোনো উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য এই মামলাকে সামনে রেখে যেন হয়রানি করতে না পারেন সেদিকে সতর্ক থাকলে এই অবস্থাগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন