সরকারী কর্ম কমিশনের (পিএসসি) গৃহীত সর্বশেষ দুই বিসিএসে (৪৫তম ও ৪৬তম) প্রশ্নপত্র কিনে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন অসংখ্য প্রার্থী। ফাঁস হওয়া প্রশ্নগুলো বিভিন্ন চক্র-উপচক্রের মাধ্যমে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে হাতে পেয়েছেন চাকরিপ্রার্থীরা। তেমনই দুই প্রার্থী সৈয়দ হাজ্জাজ বিন রাজ এবং কাজী মারফিকুর রহমান। পিএসসির সর্বশেষ গৃহীত ৪৬তম বিসিএসে তাদের রেজিস্ট্রেশন নম্বর যথাক্রমে ১১০৪৫৫৬৭ এবং ১১০৫৯৬৪৩।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিসিএসের মতো গুরুত্বপূর্ণ এই নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন এসব প্রার্থীদের হাতে গিয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী এবং আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন নিষিদ্ধ ঘোষিত বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সহ-সভাপতি জীবন রায় ২৫ লাখ টাকার চুক্তিতে সৈয়দ হাজ্জাজ বিন রাজকে এ প্রশ্ন দেন। রাজ প্রশ্ন পাওয়ার পর তা সরবরাহ করেছেন তার বন্ধু কাজী মারফিকুর রহমানকে তিনিও সর্বশেষ বিসিএসে প্রশ্ন পেয়েছেন। এছাড়াও এ প্রশ্ন রাজের হাত ধরে গিয়েছে তার ভাইয়ের কাছেও। তবে তিনি পরপর দুটি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও উত্তীর্ণ হতে পারেননি কোনোটিতেই।
আমি বিজি প্রেসের গাড়িচালক মো. মিজানের কাছ থেকে প্রশ্নপত্রগুলো পেয়েছি। মিজান সবসময় নিজেকে ঠিকাদার বলে পরিচয় দিতেন। তিনি আমাকে কোনো প্রার্থী থাকলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে অনুরোধ করলে রাজ প্রশ্ন পায়। রাজ যে বুথে ছিলেন সেখানে ৪৫তম বিসিএসের আরও ৪০-৪৫ জন প্রার্থী ছিলেন—জীবন রায়, বিসিএসের প্রশ্নফাঁসকারী চক্রের সদস্য।
ঢাবি শিক্ষার্থী জীবন রায় বিসিএসের এসব প্রশ্ন পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছাপা-প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সরকারী মুদ্রণালয় (বিজি প্রেস) থেকে। বিজি প্রেসের বহিষ্কৃত এক সাবেক কর্মকর্তার গাড়িচালক মো. মিজান ওরফে এমডি মিজান জীবন রায়কে এসব প্রশ্ন সরবরাহ করেছেন বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন তিনি।
বিজি প্রেসের গাড়িচালক মো. মিজান নিজের ঠিকাদার পরিচয়ের আড়ালে দেশের শীর্ষ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস করতেন। প্রশ্নফাঁস করে চলা অন্ধকার জগতে তিনি পরিচিত একজন ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে। তার হাত ধরেই এ চক্রে জড়ান ঢাবি শিক্ষার্থী জীবন রায়।
শুরুতে বিষয়গুলো কোনোভাবেই স্বীকার করতে চাননি প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকা ঢাবি শিক্ষার্থী জীবন রায়। তবে সব তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে তার কাছে জানতে চাওয়ার পর জীবন রায় জানান, বিজি প্রেসের বহিষ্কৃত এক সাবেক কর্মকর্তার গাড়িচালক মো. মিজান ওরফে এমডি মিজানের কাছ থেকে প্রশ্নপত্রগুলো পেয়েছেন। মিজান ঠিকাদার পরিচয়ে তার সাথে উঠাবসা করতেন। এমনকি বিভিন্ন সময় মিজান তার সাথে ঢাবির জগন্নাথ হলে ছিলেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।
জীবন রায় বলেন, আমার সাথে পরিচয়ের এক পর্যায়ে মিজান আমাকে সরকারি চাকরির কোনো প্রার্থী থাকলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতে অনুরোধ জানান। এরপর আমি তাকে প্রার্থীদের সাথে যোগাযোগ করিয়ে দিতাম। রাজ এবং তার বন্ধুও এভাবেই প্রশ্ন পেয়েছেন। রাজ যে বুথে ছিলেন সেখানে ৪৫তম বিসিএসের আরও ৪০-৪৫ জন প্রার্থী ছিলেন।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ছাপাখানা বিজি প্রেস থেকে প্রশ্ন সরবরাহের বিষয়টি স্বীকার করেছেন প্রতিষ্ঠানটির বাইন্ডার আকরাম হোসেন এবং পোর্টার মজনু মিয়া।
জানতে চাইলে আকরাম হোসেন বলেন, ২০০৮ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমি আর মজনু একসাথে কাজ করতাম এবং সকল পরীক্ষার প্রশ্ন বের করতাম। ২০১৮ সালোর পর থেকে আমি এ কাজ থেকে সরে আসলেও মজনু এটি চালিয়ে যায়।
আর মজনু মিয়া বলছেন, এমডি মিজান আমাকে টাকার লোভ দেখিয়ে কাজগুলো করিয়েছে। প্রতিটি প্রশ্ন বের করার বিনিময়ে তিনি আমাকে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা দিতেন।
তবে বিভিন্ন মাধ্যমে চেষ্টা করেও বিসিএসের প্রশ্ন পেয়ে ৪৫তম এবং ৪৬তম বিসিএসে পরীক্ষা দেওয়া সৈয়দ হাজ্জাজ বিন রাজ এবং কাজী মারফিকুর রহমানের কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়াও ঢাকার মিরপুর এবং ধানমন্ডি এলাকায় তার ঠিকানায় খোঁজ করেও তাদের সন্ধান পাওয়া সম্ভব হয়নি।
সরকারী মুদ্রণালয় (বিজি প্রেস) থেকে কীভাবে এসব প্রশ্ন বাইরে আসে এবং তার সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তাদের বিষয়ে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে— এসব বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে। প্রতিষ্ঠানটির ডেপুটি ডিরেক্টর (ডেপুটি সেক্রেটারি) মো. তাজিম-উর-রহমান এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। এছাড়াও একই বিষয়ে বক্তব্য দিতে অপারগতা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মকর্তারাও।
সরকারী কর্ম কমিশন (পিএসসি) বরাবরের মতোই অস্বীকার করেছে বিসিএসের প্রশ্নফাঁস হওয়ার বিষয়ে। জানতে চাইলে পিএসসির সদ্য দায়িত্ব নেওয়া চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মোবাশ্বের মোনেমসহ সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি।
তবে কমিশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এস. এম মতিউর রহমান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বিসিএসের প্রশ্নফাঁসের বিষয়গুলো নিয়ে কমিশন তদন্ত করছে। আগের তদন্তের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে, তার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত সবাইকে জানানো হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন